কেন আইএমএফকে প্রত্যাখ্যান করল সেনেগাল

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
কেন আইএমএফকে প্রত্যাখ্যান করল সেনেগাল
আইএমএফ’র লোগো। ছবি: রয়টার্স

সেনেগালের সরকারি আর্থিক ঘাটতি পূরণ করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা (বেইলআউট) প্রয়োজন। এই বিষয়টি নিয়ে দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে।

আইএমএফ চাইছে বেইলআউট অনুমোদনের আগে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটি সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করুক, কিন্তু সেনেগাল এটা করতে চাইছে না। কারণ দেশটির অর্থনীতি ‘জাঙ্ক বন্ড’ পর্যায়ের গভীরে নেমে গেছে।

মাসের শুরুর দিকে, ক্রেডিট রেটিং সংস্থা এসঅ্যান্ডপি জানিয়েছে সেনেগালের সরকারি আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল।

গত ১৪ নভেম্বর এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলে, “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর আদায় বৃদ্ধি করার পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও ঋণ ও সুদের বোঝা এত বেশি যে, সেনেগালের অর্থনীতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে, যদি না কোনো সমন্বিত সরকারি কর্মসূচি ছাড়া গ্রহণ করা হয়।”

গত বছর আইএমএফ সেনেগালের ১.৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন কর্মসূচি স্থগিত করে, কারণ আগের প্রশাসন সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার তথ্য গোপন করেছিল। অর্থনীতি স্থিতিশীল করার জন্য সরকার কী পদক্ষেপ নেবে তা নির্ধারণে ডাকার ও আইএমএফের মধ্যে নতুন বেইলআউট প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা চলমান আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষই কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি।

সেনেগালের ঋণ কতটা?

সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসঅ্যান্ডপি অনুমান করেছে, ২০২৪ সালের শেষে সেনেগালের সরকারি ঋণ বেড়ে ৪২.১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা দেশের মোট জিডিপির ১১৯ শতাংশ। এর ফলে সেনেগাল আফ্রিকার সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় ঢুকে পড়েছে। এই হিসাবের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর ঋণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যা মোট জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ।

২০০৮ সাল থেকে অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য দেশটি ব্যাপকভাবে ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু কোভিড মহামারী পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক সুদের হার বেড়ে যাওয়ার ফলে ঋণ আরও বেড়েছে। ব্যয় বৃদ্ধির অনুপাতে আয় বৃদ্ধি ঘটেনি। ফলে সেনেগালের অর্থনীতির উপরে চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঋণের বোঝা কমাতে সরকার এখন আর্থিক ঘাটতি কমানোর দিকে নজর দিচ্ছে, অর্থাৎ সরকারি ব্যয় যে পরিমাণ কর রাজস্বকে ছাড়িয়ে যায়, তা ২০২৪ সালে জিডিপির ১২.৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে আগামী বছরে ৫.৪ শতাংশে আনা এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা। কিন্তু এসঅ্যান্ডপির মতে অর্থনীতির অবস্থা এতটা আশাব্যঞ্জক নয়।

সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী বছরে জিডিপির ৮.১ শতাংশ এবং ২০২৭ সালে ৬.৮ শতাংশ আর্থিক ঘাটতি থাকতে পারে। এসঅ্যান্ডপির অনুমান জিডিপির অনুপাতে ঋণ আগামী বছরে ১২৩ শতাংশে পৌঁছাবে, যা ২০২৭ সালে সামান্য কমতে পারে।

আইএমএফের সঙ্গে বর্তমান সংকটের কারণ কী?

২০২৪ সালের মার্চ মাসে বাসিরু দিওমায়ে ফে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। তিনি অযোগ্য ঘোষিত বিরোধী নেতা উসমান সোনকোর পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, যাকে তৎকালীন পর্যটন মন্ত্রীকে নিয়ে মানহানির একটি মামলার কারণে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ভোটের পরে, সোনকো ফে-এর প্রধানমন্ত্রী হন।

একই বছরের সেপ্টেম্বরে নবনির্বাচিত পাস্তেফ পার্টির সরকার দেশের আর্থিক ব্যবস্থার ওপর একটি নিরীক্ষা করার নির্দেশ দেয়। সেনেগালের নিরীক্ষা কর্তৃপক্ষ কোর্ট অব অডিট অনুসন্ধানে পায় যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্যাকি সালের প্রশাসন সরকারি ঋণের পরিমাণ অনেক কম দেখিয়েছে।

কোর্ট অব অডিটের অনুমান, সেনেগালের জিডিপির অনুপাতে প্রকৃত ঋণ প্রায় ১০০ শতাংশের কাছাকাছি, যেখানে আগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। এতে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলারের গোপন ঋণের খবর প্রকাশিত হয়, যা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো নিয়েছিল এবং হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

আইএমএফ নিরীক্ষকদের এই মূল্যায়নকে আমলে নিয়ে এটিকে সালে প্রশাসনের ‘সচেতন সিদ্ধান্ত’ হিসেবে বিবেচনা করে। যা সেনেগালের প্রকৃত ঋণের খবর আড়াল করেছিল। ফলে আইএমএফ সেনেগালের জন্য ২০২৩ সালে অনুমোদিত ১.৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচি স্থগিত করে।

বাসিরু দিওমায়ে ফে-এর নির্বাচনী প্রচারের বিলবোর্ড। ছবি: রয়টার্স
বাসিরু দিওমায়ে ফে-এর নির্বাচনী প্রচারের বিলবোর্ড। ছবি: রয়টার্স

আইএমএফ-এর ঋণ সাধারণত বিভিন্ন কিস্তিতে প্রদান করা হয়। যখন আইএমএফ সেনেগালের ঋণ কর্মসূচি স্থগিত করে, তখন পর্যন্ত মোট অর্থের ৭০০ মিলিয়ন ডলারের ছাড়পত্র অনুমোদন করা হয়েছিল। এখন আইএমএফ-এর নির্বাহী বোর্ডকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা এই অর্থ দেবে কি না। যদি সিদ্ধান্ত ডাকারের বিরুদ্ধে যায়, তবে বোর্ড সরকারকে দেওয়া অর্থ ফেরত দিতে বলতে পারে। আর সিদ্ধান্ত যদি অনুকূল হয়, আইএমএফ কর্মসূচি চালু রাখতে পারে এবং শিগগিরই পরবর্তী কিস্তি দিতে পারে।

আইএমএফ-এর এই ১.৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সেনেগালের ২০২৪ সালের মোট আর্থিক ঘাটতির প্রায় অর্ধেকের সমান। এটি সরকারি ব্যয়ের জন্য অত্যাবশ্যক অর্থ জোগান দেবে। এটি ছাড়া সেনেগালের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে।

আইএমএফ কেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না?

গত ৬ নভেম্বর পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশে দুই সপ্তাহের সফর শেষে আইএমএফ–এর মিশন প্রধান এডওয়ার্ড জেমায়েল বলেন, “আমরা দেখছি যত দ্রুত সম্ভব সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি নিষ্পত্তি করা যায়।” এর কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী সোনকো জানান আইএমএফ-এর প্রতিনিধি দল সেনেগালকে ঋণ পুনর্গঠন করতে বলেছে, যার ফলে দেশের পরিশোধযোগ্য অর্থের পরিমাণ কমে যাবে। কিন্তু এ ধরনের ব্যবস্থায় সাধারণত সরকারি ব্যয় হ্রাস পেলেও দেশের প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে যায়।

যেসব দেশ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় তারা সাধারণত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, কারণ আর্থিক স্থিতিশীলতা আনতে তাদের ব্যয় কমাতে হয়, ফলে জনসেবা ব্যাহত হয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থাও কমে যায়, যা সরকারের জন্য ঋণ নেওয়া আরও কঠিন করে তোলে।

৮ নভেম্বর পাস্তেফ কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে সোনকো বলেন, তিনি আইএমএফ-এর প্রস্তাবিত ঋণ পুনর্গঠনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে আইএমএফ-এর এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলে ডাকারের সামনে খুব বেশি বিকল্প নেই, সোনকোকে এটা মনে রাখতে হবে। এখন প্রধানমন্ত্রীকে আইএমএফকে একটি বিশ্বাসযোগ্য আর্থিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করে দেখাতে হবে, যা ঋণ পুনর্গঠনে না গিয়ে সেনেগালের আর্থিক অবস্থাকে স্বাভাবিক করবে।

কিন্তু জেমায়েল ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছেন যে সরকারের ২০২৬ সালের বাজেট খুবই ‘উচ্চাভিলাষী’, যেখানে উচ্চমাত্রার কর বৃদ্ধি রয়েছে। তিনি বলেন, “এমনটা আগে কখনো হয়নি। তাই আইএমএফকে সতর্ক থাকতে হবে।”

সেনেগালের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে?

সোনকোর আইএমএফ-এর পুনর্গঠন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। গত ১০ নভেম্বর, সোনকোর মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রথম দিনে সেনেগালের ডলার বন্ড ৪ শতাংশ কমে ৭৩.১ ডলারে নেমে আসে, যার মেয়াদ ছিল ২০৩১ সাল পর্যন্ত। অন্যদিকে, ২০৪৮ সালে পরিশোধযোগ্য বন্ড ২.৪ সেন্ট কমে ৬০.৩০ ডলারে পৌঁছায়।

অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের আফ্রিকা বিশ্লেষক লিউনার এস্তেরহুইজেন বলেন, “পরিস্থিতি খুব সংকটজনক, ঋণের মাত্রা অনেক বেশি, এবং শিগগিরই আইএমএফ–এর অর্থায়ন পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”

২০২০ সাল থেকে জাম্বিয়া, ঘানা, ইথিওপিয়া এবং চাদ-সব দেশই তাদের ঋণ পুনর্গঠনে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এটি খুবই দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া এবং এর সঙ্গে কিছু অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাও যুক্ত আছে। ফলে আফ্রিকার অন্যান্য দেশের সরকার কাছে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে আগ্রহী নয়।

ঋণের ভারে জর্জরিত আরেকটি দেশ কেনিয়া। গত বছর ঋণ পুনর্গঠনের পরিবর্তে কর বৃদ্ধি ও ভর্তুকি কমানোর মতো ব্যয়বহুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দেশের বাজেট ঘাটতি কমানোর লক্ষ্য নিয়ে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু এর ফলে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়, যা মিতব্যয়ী নীতির রাজনৈতিক ঝুঁকিকে স্পষ্ট করে তোলে।

সেনেগালের রাজনীতিতে কি এর প্রভাব পড়বে?

চ্যাথাম হাউসের আফ্রিকা কর্মসূচির পরামর্শক পল মেলির মতে, সোনকো আইএমএফ-প্রস্তাবিত সংস্কার কর্মসূচির বিরোধিতা করছেন, কারণ তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় সেনেগালের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা ক্ষুণ্ন করতে চান না। মেলি আরও বলেন যে সোনকো প্রেসিডেন্ট ফায়ের সঙ্গে ‘উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক’ মোকাবিলা করছেন। চলতি মাসের শুরুর দিকে সোনকোর দল ফা-এর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত জোট গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, এর দ্বারা বোঝা যায় তিনি ক্ষমতা সুসংহত করার চেষ্টা করছেন।

যদিও সোনকোর দায়িত্ব ফা-এর অধীনে কিন্তু তিনি নিজেও একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত, যিনি দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারেন।

মেলি বলেন, “সোনকো কখনোই একজন অধস্তন প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি,”

সেনেগালের আর্থিক পরিস্থিতি সোনকোর জন্য একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তিনি এখনো তার ‘সার্বভৌমত্ব’-কেন্দ্রিক অবস্থান বজায় রাখতে চান, কিন্তু দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করার জন্য তাকে আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসতে হতে পারে।

সেনেগাল ঋণ সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারে?

সম্প্রতি সেনেগাল সরকার তামাক, মদ, জুয়া এবং অনলাইনে অর্থ লেনদেনে নতুন কর আরোপ করেছে। ব্যয় সংকোচনের অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তারা বিদেশ ভ্রমণ ব্যয় এবং গাড়ি ক্রয়ও সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

পল মেলি বলেন, ভারসাম্য রক্ষা করা সরকারের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক সংকট ব্যাপক হলেও সরকারের কাছে জনসাধারণের প্রত্যাশা এখনো অনেক। যদি সরকার আইএমএফ-এর কাছে নতি স্বীকার করে, তাহলে ২০২৭ সালের পৌরসভা নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে এর প্রভাব পড়তে পারে। তাছাড়া নাগরিক অসন্তোষের কারণ হতে পারে এটি।

সূত্র: আল জাজিরা

সম্পর্কিত