অবাধ্যকে বাধ্য করতে চীনের কী কৌশল?

অবাধ্যকে বাধ্য করতে চীনের কী কৌশল?
ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

কূটনীতিক বৈরিতার ক্ষেত্রে চীন এক ধরনের রক্ষণশীল নীতি (ল অব কনজারভেশন) মেনে চলে। বিষয়টা কিছুটা এমন যে, চীন কূটনীতিক শত্রুর তালিকায় সংখ্যা বাড়ায় না। তবে ওই নির্দিষ্ট সংখ্যার মধ্যেই টার্গেট বদলাতে থাকে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, এই তালিকা থেকে সম্প্রতি কানাডা ও দক্ষিণ কোরিয়া বেরিয়ে এসেছে, পরিবর্তে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জাপান।

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট চীনের কূটনীতিক অবস্থানকে এভাবে ব্যাখ্যা করলেও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো বটেই, তারও আগের আঞ্চলিক ইতিহাসের দিকে নজর দিলে চীন ও জাপান বা চীন–দক্ষিণ কোরিয়া কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে এ ভাষ্য অতিসরলীকরণের দোষে দুষ্ট হতে বাধ্য।

জাপানের সঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক সম্পর্কের অবনমন হয়েছে মূলত জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির এক বক্তব্যের পর। তাকাইচি তার ওই বক্তব্যে বলেছিলেন, চীন যদি কখনো তাইওয়ানে হামলা করে, তবে জাপানও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। বরং তারাও তাদের সামরিক বাহিনী মোতায়েন করবে।

জাপানের এমন আচরণ চীনের চোখে সীমালঙ্ঘন। তাইওয়ান ইস্যুকে চীন সবসময়ই নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করে। আর এখানে জাপানের এমন বক্তব্য চীনের জন্য তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সামিল। জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক নৃশংস দখলদার শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তাই জাপানের এমন হস্তক্ষেপ চীন সহজভাবে নেবে না।

চীন যখন শক্তভাবে কথা বলে প্রায়শই তার বস্তুগত পরিণতি থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও চীন জাপানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক খাবার আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, চীনা নাগরিকদের জাপানে ভ্রমণ না করার সতর্কতা জারি এবং চীনে জাপানি কনসার্ট ও চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করা।

প্রশ্ন হলো–দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্বে চীন এমন রূঢ় অর্থনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করে আসলে কী অর্জন করতে চায়?

অনেকের কাছে একে খামখেয়ালীপনা মনে হতে পারে বা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো বোকামিও মনে হতে পারে। তবে চীনের এই চোখ রাঙানিকে মার্কিন ব্লকে থাকা দেশগুলো থোড়াই কেয়ার করে। কারণ, এমন যেকোনো কিছুতে, এমনকি সামরিক পদক্ষেপের ক্ষেত্রেও তারা মনে করে যে, ত্রাতা হিসেবে আমেরিকা ঠিক তার পাশে থাকবে।

যেমন, চীনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার কারণে জাপানে তাকাইচির অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। ফলে তিনি তার চীনবিরোধী মন্তব্য মোটেও প্রত্যাহার করছেন না। ঐতিহাসিকভাবে বৈরী অবস্থানে থাকা দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ প্রবণতা নতুন নয়। একটা জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকেই নাগরিকেরা তখন নিজের নেতার অবস্থানকে পাঠ করে বা করতে চায়। নেতারাও তখন এর সুযোগ নিতে চেষ্টা করে।

তবে চীনের এ রকম আচরণের আরও বড় কারণ আছে। চীনের এমন কূটনৈতিক বৈরিতাকে বলা হয় ‘ডগহাউস ডিপ্লোম্যাসি’। চীন গত দুই দশক ধরেই ‘ডগহাউস ডিপ্লোম্যাসি’কে তাদের অন্যতম কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে।

চীনের কূটনীতির ক্ষেত্রে এই ‘ডগহাউস ডিপ্লোম্যাসি’ শব্দবন্ধ প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। এই ধারণাটির কেন্দ্রে আছে–বৈরী পক্ষ বা দেশকে সতর্ক করতে তার ওপর বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। চীন এর আগে দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের ওপর একই কৌশল আরোপ করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন সংবাদমাধ্যম ও তাদের বয়ানে চীনের এ কূটনৈতিক কৌশলকে আলাদাভাবে শনাক্তের প্রয়াস দেখা গেলেও এই একই কৌশল কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত আমেরিকা দিনের পর দিন প্রয়োগ করে আসছে।

যা হোক, দেশ হিসেবে চীন এ কৌশল গত দুই দশক ধরে প্রয়োগ করছে। তবে চীনের মতো বড় দেশের এ ধরনের কৌশল তাদের জন্যই বড় ক্ষতির কারণ হবে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু এর পেছনে চীনের যুক্তিও খুব পোক্ত। তাদের ভাষ্য, দীর্ঘমেয়াদে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর, অনেক দেশের আচরণই এতে বদলে যায়।

নির্দিষ্ট লক্ষ্যের চেয়ে বরং ডগহাউসের উপস্থিতিই মুখ্য বিষয়। এ ভয় বিদেশি সরকারগুলোকে চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়–এমন কিছু না করতে বাধ্য করে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও শি জিনপিং। ছবি: রয়টার্স
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও শি জিনপিং। ছবি: রয়টার্স

চীনের সাথে বাণিজ্যে সমস্যায় পড়া প্রথম দিকের দেশগুলোর মধ্যে তারা ছিল, যারা তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামার সঙ্গে সাক্ষাতের সাহস দেখিয়েছিল। কারণ, এ বিষয়টিকে বেইজিং বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা হিসেবে দেখে। সময়ের সঙ্গে চীন আরও বড় অপরাধের জন্য অর্থনৈতিক শাস্তি দেওয়া শুরু করে।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে চীনা মানবাধিকার কর্মীকে নরওয়ের নোবেল কমিটির শান্তি পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত, ২০১২ সালে ফিলিপাইনের সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরে ছোটখাটো সংঘর্ষ এবং ২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের কথা বলা যায়।

অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাবিদদের তৈরি একটি ডেটাবেজ ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ‘অস্ত্র হিসেবে বাণিজ্য’কে ব্যবহারের প্রায় ১০০টি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রেই চীন আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছে।

কিন্তু চীন তার এ ধরনের কাজকে কখনোই কূটনৈতিক বৈরিতা বা পরোক্ষ বাণিজ্যিক শাস্তি হিসেবে প্রচার করে না। তাই এ ধরনের অভিযোগ উঠলে চীনের পক্ষে খুব সহজেই তা অস্বীকার করা সম্ভব হয়। তবে যাদের ওপরে চীন খড়্গহস্ত হয়, সেটার সময় আর নিষেধাজ্ঞার ধরন দেখলে দেশটির আসল উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না।

এখানে লিথুয়ানিয়ার কথা বলা যেতে পারে। অন্য দেশে তাইওয়ানকে ‘তাইপে’ সম্বোধন করলেও লিথুয়ানিয়া যখন এই রীতি ভেঙে ২০২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘তাইওয়ান’ বলা শুরু করে, তখন বাধে বিপত্তি। লিথুয়ানিয়ার ব্যবসায়ীরা খেয়াল করে যে, চীনের কাস্টমস থেকে লিথুয়ানিয়াকে একদম মুছে ফেলা হয়েছে। তারা কোনো কিছুই আর চীনে পাঠাতে পারছে না।

লিথুয়ানিয়াই শুধু নয়, কানাডাও চীনের রোষাণলে পড়েছে। ২০১৮ সালে আমেরিকার অনুরোধে হুয়াওয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে আটক করে দেশটি। এর পর তারা কানাডা থেকে ক্যানোলা আমদানি বন্ধ করে দেয়। চীন অবশ্য এর কারণ হিসেবে নিরাপত্তা ইস্যু দেখিয়েছিল।

একভাবে দেখলে চীনের এই অর্থনৈতিক কৌশলগুলোর সাফল্য নিয়ে সংশয় হতে পারে। যেমন, দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকান ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ বন্ধ করেনি। আবার সময়ের সাথে সাথে চীনের চাপও প্রশমিত হয়েছে। আবার, লিথুয়ানিয়া তাইওয়ানের বিষয়ে কোনো আপস না করলেও ধীরে ধীরে চীনে তাদের পণ্য রপ্তানিও শুরু হয়েছে। কিন্তু জাপানের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। চীনের দৃষ্টিকোণ থেকে জাপান বারবার তার সীমা লঙ্ঘন করেছে।

গভীরভাবে লক্ষ্য করলে চীনের এই নীতির সুদূরপ্রসারী প্রভাব বোঝা যায়। চীনের ডগহাউস ডিপ্লোমেসির উৎপত্তিই ধরা যাক। দালাই লামার সাথে কিছু বৈঠকের পর যখন বিভিন্ন দেশ চীনের রোষানলে পড়ল, তারপর থেকে তারা এমন বৈঠকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পাঠানোর বদলে তুলনামূলক নিম্নপদস্থদের পাঠানো শুরু করে। অন্য দেশগুলোও লিথুয়ানিয়ার মতো বিপদে পড়া এড়িয়ে চলেছে। তারা তাইওয়ান নাম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকছে। সম্প্রতি চীনের এই আমদানি নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তাই তারা এখন সি চিনপিংয়ের সমালোচনা কমিয়ে এনেছে।

ডগহাউস ডিপ্লোমেসির কারণে কিন্তু চীনকে তেমন অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না। এসব নিয়ে যত মাতামাতিই হোক না কেন, চীনের এসব নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা থাকে না। কারণ, তারা সবাইকে টার্গেট করে না। এই যেমন ফিলিপাইনকে শাস্তি দিতে যখন সেখান থেকে কলা আমদানি বন্ধ করল, তখন ঠিকই তারা ভিয়েতনামকে কলা আমদানির উপযুক্ত বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে।

তাই চীন তাদের নাগরিকদের জাপান ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করলেও এর উপযুক্ত বিকল্প ঠিকই তারা খুঁজে বের করবে। কিন্তু যে দেশ চীনের টার্গেটে পরিণত হয়, তারা এত সহজে বিকল্প খুঁজে নিতে পারে না। কারণ, চীনের বাজার এত বিস্তৃত যে, তার বিকল্প পাওয়া কঠিন।

ট্রাম্পের তুলনায় বাণিজ্যিক কূটকৌশলে চীন অত্যন্ত দক্ষ। নিজেদের অল্পবিস্তর লোকসান করে হলেও প্রতিপক্ষের পাকা ধানে মই দেওয়াই তাদের মূল উদ্দেশ্য।

চীনেরও কি ক্ষতি হচ্ছে?

যখন কোনো দেশ চীনের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সেই দেশের জনগণ দীর্ঘ সময়ের জন্য চীনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ক্ষেপণাস্ত্র-প্রতিরক্ষা বিতর্ক শুরুর পর দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল, তা কিন্তু এখনো রয়ে গেছে। এমনকি ট্রাম্পকে নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মানুষ এখনো চীনকে বিশ্বাস করে না।

আর কোনো দেশের মানুষের মধ্যে যদি এমন বৈরী মনোভাব তৈরি হয়, তবে সেই দেশের সরকারের সাথে দীর্ঘমেয়াদে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির সম্ভাবনা কতটা, সে প্রশ্ন থেকে যায়।

চীনের মতে এভাবে মাঝেমধ্যে ভয়ভীতি দেখানোর মাধ্যমে যদি অন্য দেশের সামনে নিজেকে ক্ষমতাধর হিসেবে দেখানো যায়, তাহলে তা-ই ভালো। এতে পর্যটক ও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা ঘাবড়ে গেলেও বিদেশি সরকারগুলোকে বশে রাখা যায়।

জাপানের সাথে চলমান দ্বন্দ্বের মধ্যেই বেইজিংয়ের কূটনীতিকরা জানাচ্ছেন যে, চীন তাদের দিকটি ব্যাখ্যার জন্য বৈঠকে বসতে চায়। তাদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাইওয়ানের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দিয়েছে। তাই তাইওয়ানের স্বাধীনতার প্রতি অন্য দেশের সামান্যতম সমর্থন বা উসকানির জন্য চড়া মূল্য গুনতে হবে।

তাই জাপানের ওপর চীনের যে বাণিজ্যিক বৈরিতা, তা জাপানকে ডগহাউসে ফেলার জন্য মূল কারণ নয়, বরং তাদেরকে সীমা দেখিয়ে দেওয়ার জন্যও জরুরি বলে তারা মনে করে। এ জন্য অন্য দেশগুলো ধীরে ধীরে ডগহাউস থেকে বের হয়ে গেলেও জাপানের জন্য তা এত সহজ হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।

সম্পর্কিত