১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীন বরাবরই পাকিস্তানকে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে এসেছে। ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক, সেই ১৯৫১ সাল থেকেই চীন ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুই দেশের মধ্যে তখন থেকেই অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক ছিল অনেক গভীর। সমাজতান্ত্রিক চীন ষাটের দশকের শেষ দিকে পাকিস্তানের মাধ্যমেই আমেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানের অখন্ডতাকে সমর্থন জানিয়েছে চীন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পাকিস্তানি সেনারা যখন পর্যুদস্ত তখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার প্রবল আশাবাদ ছিল চীন শেষ পর্যন্ত সৈন্য পাঠিয়ে হলেও পাকিস্তানকে রক্ষা করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। চীন ‘নৈতিক’ সমর্থন জানিয়ে গেলেও ‘প্রত্যক্ষ’ সমর্থনটা পাকিস্তান পায়নি কেন?
অথচ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল উচ্চকণ্ঠ। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌন এন লাই ভারতের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, “ভারত যেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরণীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে।’ চৌন এন লাই বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহকে পুরোপুরি পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরণীন’ ব্যাপার বলেছিলেন। এমনকি তিনি বলেছিলেন, ভারত যদি পাকিস্তানে কোনো ধরনের আক্রমণ করে বা আগ্রাসন চালায়, তাহলে চীন পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় সমর্থন দেবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিশ্রুতির বন্ধুত্ব ছিল চীনের। ছবি: সংগৃহীত
জুন মাস থেকে পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে চীন প্রতিদিন প্রায় ১০০টির লরি ভর্তি সামরিক সরঞ্জাম পাঠাতো। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ মোকাবিলা করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে সহায়তা করেছিল চীন। চীনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনে মেতেছিল। শুধু ১৯৭১ সালেই চীন পাকিস্তানকে ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সামরিক সাহায্য পাঠিয়েছিল।
একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চীনের নৈতিক সমর্থন পাকিস্তানের প্রতি ছিল। সেই নৈতিক সমর্থন পেয়েই তারা বাঙালি নিধনে মেতেছিল ইচ্ছেমতো। তবে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণের মুখে বৈরি পরিবেশ আর পরিস্থিতিতে ক্রমাগত নিজেদের মনোবল হারিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। যুদ্ধটাকে অনেকটা আন্তর্জাতিক রূপ দিতেই ডিসেম্বরের শুরুতে ভারত আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। উল্টো ১৬ পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড চীনা বাহিনীর আশায় হাপিত্যেশ শুরু করে। শেষ পর্যন্ত চীন পাকিস্তানের সমর্থনে যুদ্ধে জড়ায়নি। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক সুলতান হোসেন খান তাঁর আত্মজীবনী ‘মেমোরিজ অ্যান্ড রিফ্লেকশনস অব অ্য পাকিস্তানি ডিপ্লোম্যাট’ বইয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা তুলে ধরেছেন, ‘চীনের রাষ্ট্রদূত আমাকে বলেছেন যে পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন আমরা অব্যাহত রাখব, তবে এ লড়াইয়ে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষমতা সীমিত। যদি আমরা তা করি, তার ফল হবে খুবই সংকীর্ণ। তাই এ ব্যাপারে খুব বেশি আশা না করাই ভালো।’
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সেনা–নেতৃত্ব চীনা সাহায্যের আশায় ছিল। সে আশা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ছবি: সংগৃহীতপাকিস্তানিদের আত্মসমর্পনের দলিলে সই করা, পূর্বঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী তাঁর ‘বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বরের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, “চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, শুধু ৩৬ ঘণ্টা টিকে থাকো। উত্তর দিক দিয়ে হলুদ সেনারা আসছে। একই সঙ্গে দক্ষিণ দিক দিয়ে আসছে সাদারা।’ গুল হাসান হলুদ সেনা বলতে চীনা সৈন্য আর ‘সাদা’ বলতে আমেরিকানদের বুঝিয়েছিলেন।
হলুদ সেনা তো আসেই–নি! দক্ষিণ দিক দিয়ে সাদারাও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে সাহায্য দিতে আসেনি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইয়াহিয়া খানকে সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর উপকূলে পাঠানো কথা বললেও সেটি আসার আগেই পাকিস্তানকে মেনে নিতে হয়েছিল লজ্জার আত্মসমর্পন।