চরচা ডেস্ক

বিশ্ব রাজনীতি নতুন করে রূপ নিচ্ছে। এক সময় আমেরিকা ছিল একক আধিপত্যবাদী শক্তি–কিন্তু সেই একমেরু বিশ্বব্যবস্থা এখন অতীত হতে চলেছে। তার জায়গায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এক নতুন বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে আমেরিকা ও চীনের পাশাপাশি ভারত, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর ভূমিকাও ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আগামী দশক তাই হবে প্রতিযোগিতা, ভারসাম্য এবং পুনর্বিন্যাসের সময়।
বৈশ্বিক কাঠামোর বদল: নতুন শক্তির উত্থান
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এক আলোচনায় অধ্যাপক কিশোর মাহবুবানি এবং ভারতের সাবেক কূটনীতিক অজয় বিসারিয়া এই পরিবর্তনগুলোর গভীরে আলোকপাত করেন। ইউটিউবের একটি চ্যানেলে এই দীর্ঘ আলোচনা প্রকাশ করা হয়েছে।
অধ্যাপক মাহবুবানি, যিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক ও বিশ্লেষক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত, বলেন-চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের মতো ঐতিহ্যবাহী শক্তিগুলোকেও পেছনে ফেলেছে। তার মতে, এটি গত দুই হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। তিনি আরও বলেন, ভারতের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেওয়া সময়ের দাবি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী আসন পাওয়া তাই প্রতীকী নয়, বরং বাস্তবতার প্রতিফলন।
অজয় বিসারিয়া বিশ্লেষণ করেন, মার্কিন রাজনীতির অনিশ্চয়তা, ভারত-মার্কিন সম্পর্কের টানাপড়েন এবং পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে কৌশলগত নিরপেক্ষতা বজায় রেখে আমেরিকা ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার ভারতের সূক্ষ্ম কূটনীতি।
একমেরু নয়, বহুমেরুর পথে বিশ্ব
দুই বক্তার মতে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে একমেরু বা দ্বিমেরু হিসেবে দেখা এখন আর সম্ভব নয়। বরং এটি একটি জটিল বহুমেরু পরিবেশ, যেখানে আমেরিকা ও চীন প্রধান মেরু হলেও ভারত, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোও প্রভাব বিস্তার করছে।
ভারত এখন এক ‘ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি’-যে একদিকে আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখছে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা করছে। এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ভারতের প্রয়োজন নমনীয় কূটনীতি, কঠোর জোট নয়।
আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক: সহযোগিতা নাকি টানাপোড়েন?
‘ট্রাম্প-বিপ্লব’ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে নির্দেশনাহীনতার সৃষ্টি করেছে, যার প্রভাব পড়েছে ভারতের ওপরও। বাণিজ্য শুল্ক, কূটনৈতিক তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং জনমতের অমিল দুই দেশের সম্পর্কে সাময়িক টানাপোড়েন তৈরি করেছে। তবে ভারতের কৌশলগত কূটনীতি-রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বজায় রেখে আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক পুনর্গঠন-এই প্রতিযোগিতার ভেতরেই ভারসাম্যের পথ তৈরি করছে। এটি ইঙ্গিত দেয়, মধ্যম শক্তিগুলোও এখন বৈশ্বিক শক্তির খেলায় কার্যকর ভূমিকা নিতে সক্ষম।
উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির নতুন প্রতিযোগিতা
যদিও চীন দ্রুত উত্থান ঘটাচ্ছে, তারপরেও আমেরিকা এখনো উদ্ভাবন ও গবেষণায় শীর্ষে। এর কারণ, শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মুক্তচিন্তার সংস্কৃতি। অন্যদিকে চীনের বিশাল বিনিয়োগ-বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স ও উৎপাদন খাতে-তাদের ভবিষ্যতের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। ফলে পৃথিবী এখন এক নতুন ‘উদ্ভাবনের দ্বৈত কেন্দ্র’-এর দিকে এগোচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।
এশিয়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণী: প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন
চীন, ভারত ও আসিয়ানের সম্মিলিত জনসংখ্যা এখন এক বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠন করছে। ২০০০ সালে এদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ কোটি; ২০৩০ সালের মধ্যে তা তিনশ’ কোটিতে পৌঁছবে বলে ধারণা। এই শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা ও ভোগব্যয়ই এশিয়াকে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির মূল কেন্দ্র করে তুলছে। এর ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক একীকরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন আরও অপরিহার্য হয়ে উঠবে।
অস্থিতিশীলতা ও সুযোগের সমান্তরাল বাস্তবতা
দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শাসনের ব্যর্থতা এবং যুবসমাজের মোহভঙ্গ-এই তিনটি বিষয় অঞ্চলটির স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
তবে একই সঙ্গে এগুলো নতুন সুযোগও তৈরি করছে-বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রগুলোয়। ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের উচিত কেবল মুনাফার দিকে না তাকিয়ে সুশাসন, স্থিতিশীলতা ও টেকসই সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করা।
দর্শক নয়, সক্রিয় অংশগ্রহণকারী
বিশ্বব্যবস্থা এখন দ্রুত পরিবর্তনের পথে। ক্ষমতার কেন্দ্র সরে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পূর্বে, আর প্রযুক্তি হয়ে উঠছে নতুন শক্তির মাপকাঠি। এই বাস্তবতায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের একটাই বার্তা-তারা যেন নিজেদেরকে দর্শক নয়, বরং ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনীতি গঠনের সক্রিয় অংশীদার হিসেবে প্রস্তুত করেন।
বিশ্ব এখন আর একমেরু নয়; এটি বহু কণ্ঠ, বহু শক্তি ও বহু সম্ভাবনার মঞ্চ। আগামী দশক নির্ধারণ করবে-এই ভারসাম্য কে কতটা দক্ষতার সঙ্গে রক্ষা করতে পারে।

বিশ্ব রাজনীতি নতুন করে রূপ নিচ্ছে। এক সময় আমেরিকা ছিল একক আধিপত্যবাদী শক্তি–কিন্তু সেই একমেরু বিশ্বব্যবস্থা এখন অতীত হতে চলেছে। তার জায়গায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এক নতুন বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে আমেরিকা ও চীনের পাশাপাশি ভারত, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর ভূমিকাও ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আগামী দশক তাই হবে প্রতিযোগিতা, ভারসাম্য এবং পুনর্বিন্যাসের সময়।
বৈশ্বিক কাঠামোর বদল: নতুন শক্তির উত্থান
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এক আলোচনায় অধ্যাপক কিশোর মাহবুবানি এবং ভারতের সাবেক কূটনীতিক অজয় বিসারিয়া এই পরিবর্তনগুলোর গভীরে আলোকপাত করেন। ইউটিউবের একটি চ্যানেলে এই দীর্ঘ আলোচনা প্রকাশ করা হয়েছে।
অধ্যাপক মাহবুবানি, যিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক ও বিশ্লেষক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত, বলেন-চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের মতো ঐতিহ্যবাহী শক্তিগুলোকেও পেছনে ফেলেছে। তার মতে, এটি গত দুই হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। তিনি আরও বলেন, ভারতের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেওয়া সময়ের দাবি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী আসন পাওয়া তাই প্রতীকী নয়, বরং বাস্তবতার প্রতিফলন।
অজয় বিসারিয়া বিশ্লেষণ করেন, মার্কিন রাজনীতির অনিশ্চয়তা, ভারত-মার্কিন সম্পর্কের টানাপড়েন এবং পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে কৌশলগত নিরপেক্ষতা বজায় রেখে আমেরিকা ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার ভারতের সূক্ষ্ম কূটনীতি।
একমেরু নয়, বহুমেরুর পথে বিশ্ব
দুই বক্তার মতে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে একমেরু বা দ্বিমেরু হিসেবে দেখা এখন আর সম্ভব নয়। বরং এটি একটি জটিল বহুমেরু পরিবেশ, যেখানে আমেরিকা ও চীন প্রধান মেরু হলেও ভারত, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোও প্রভাব বিস্তার করছে।
ভারত এখন এক ‘ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি’-যে একদিকে আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখছে, অন্যদিকে চীনের সঙ্গেও অর্থনৈতিক সহযোগিতা করছে। এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ভারতের প্রয়োজন নমনীয় কূটনীতি, কঠোর জোট নয়।
আমেরিকা-ভারত সম্পর্ক: সহযোগিতা নাকি টানাপোড়েন?
‘ট্রাম্প-বিপ্লব’ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে নির্দেশনাহীনতার সৃষ্টি করেছে, যার প্রভাব পড়েছে ভারতের ওপরও। বাণিজ্য শুল্ক, কূটনৈতিক তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং জনমতের অমিল দুই দেশের সম্পর্কে সাময়িক টানাপোড়েন তৈরি করেছে। তবে ভারতের কৌশলগত কূটনীতি-রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বজায় রেখে আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক পুনর্গঠন-এই প্রতিযোগিতার ভেতরেই ভারসাম্যের পথ তৈরি করছে। এটি ইঙ্গিত দেয়, মধ্যম শক্তিগুলোও এখন বৈশ্বিক শক্তির খেলায় কার্যকর ভূমিকা নিতে সক্ষম।
উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির নতুন প্রতিযোগিতা
যদিও চীন দ্রুত উত্থান ঘটাচ্ছে, তারপরেও আমেরিকা এখনো উদ্ভাবন ও গবেষণায় শীর্ষে। এর কারণ, শক্তিশালী শিক্ষা ব্যবস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মুক্তচিন্তার সংস্কৃতি। অন্যদিকে চীনের বিশাল বিনিয়োগ-বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স ও উৎপাদন খাতে-তাদের ভবিষ্যতের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। ফলে পৃথিবী এখন এক নতুন ‘উদ্ভাবনের দ্বৈত কেন্দ্র’-এর দিকে এগোচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।
এশিয়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণী: প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন
চীন, ভারত ও আসিয়ানের সম্মিলিত জনসংখ্যা এখন এক বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণী গঠন করছে। ২০০০ সালে এদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ কোটি; ২০৩০ সালের মধ্যে তা তিনশ’ কোটিতে পৌঁছবে বলে ধারণা। এই শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা ও ভোগব্যয়ই এশিয়াকে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির মূল কেন্দ্র করে তুলছে। এর ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা, অর্থনৈতিক একীকরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন আরও অপরিহার্য হয়ে উঠবে।
অস্থিতিশীলতা ও সুযোগের সমান্তরাল বাস্তবতা
দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শাসনের ব্যর্থতা এবং যুবসমাজের মোহভঙ্গ-এই তিনটি বিষয় অঞ্চলটির স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
তবে একই সঙ্গে এগুলো নতুন সুযোগও তৈরি করছে-বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রগুলোয়। ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের উচিত কেবল মুনাফার দিকে না তাকিয়ে সুশাসন, স্থিতিশীলতা ও টেকসই সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করা।
দর্শক নয়, সক্রিয় অংশগ্রহণকারী
বিশ্বব্যবস্থা এখন দ্রুত পরিবর্তনের পথে। ক্ষমতার কেন্দ্র সরে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পূর্বে, আর প্রযুক্তি হয়ে উঠছে নতুন শক্তির মাপকাঠি। এই বাস্তবতায় ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের একটাই বার্তা-তারা যেন নিজেদেরকে দর্শক নয়, বরং ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনীতি গঠনের সক্রিয় অংশীদার হিসেবে প্রস্তুত করেন।
বিশ্ব এখন আর একমেরু নয়; এটি বহু কণ্ঠ, বহু শক্তি ও বহু সম্ভাবনার মঞ্চ। আগামী দশক নির্ধারণ করবে-এই ভারসাম্য কে কতটা দক্ষতার সঙ্গে রক্ষা করতে পারে।