চরচা ডেস্ক

সম্প্রতি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন নিয়ে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘে পাস হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে নিউইয়র্ক ডিক্লারেশন। অথচ গাজায় প্রতিদিন শত শত মানুষ মরছে ইসরায়েলের বর্বর হামলায়। ইতিমধ্যে সরকারি ঘোষিত হিসাবে এই সংখ্যা ৬৫ হাজারের বেশি। অন্য হিসাব বলছে দু লাখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় গণহত্যার নজির নেই বললেই চলে। গাজা প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরই অংশ। আরেক অংশ পশ্চিম তীর। গাজার গণহত্যার ঘটনায় পশ্চিম তীরও কীভাবে ফিলিস্তিনিদের হাত থেকে ইসরায়েলের দখলে চলে যাচ্ছে তা কেউই আর খেয়াল করছে না। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বে তার বন্ধুদের পূর্ণ সমর্থনে ইসরায়েল সেখানে এক-রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করছে। ক্রমে মুছে ফেলছে ফিলিস্তিনিদের নিজেদের দেশ গড়ার স্বপ্ন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজাকে জনশূন্য করার ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিম তীর নিরবে দখলে করে চলেছেন। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু সৌদি আরব দখলেও অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। ঈশ্বর প্রতিশ্রুত সেই বৃহত্তর ইসরায়েল গড়ার রূপকার হতে চাচ্ছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নেতানিয়াহু।
সম্প্রতি পশ্চিম তীরে ইসরায়েলে নিরব দখল নিয়ে একটি বিশ্লেষণ মূলক প্রতিবেদন করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ক্রেডল। তারা মূলত পশ্চিম এশিয়া ও আরব দেশ নিয়ে সংবাদ, বিশ্লেষণ, মতামত প্রকাশ করে থাকে।
‘জুডিয়া এবং সামারিয়া’ কীভাবে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় নীতি হলো
দ্য ক্রেডল লিখছে, সম্প্রতি তেল আবিবে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ওয়েস্ট ব্যাংক” শব্দটি সঠিক নয়। এর বদলে তিনি এর বাইবেলীয় নাম, “জুডিয়া ও সামারিয়া” ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন যে, জেরুসালেম হলো “ইহুদি রাষ্ট্রের অবিসংবাদিত ও অবিভাজ্য রাজধানী।”
আসলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন মন্তব্য ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের একটি বড় কৌশলের অংশ। তারা দখল করা পশ্চিম তীরকে ধীরে ধীরে নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার জন্য ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গল্পকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
বছরের পর বছর ধরে তেল আবিব সেখানে অবৈধ বসতি স্থাপন, জোর করে জমি দখল এবং ফিলিস্তিনিদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলার মতো আগ্রাসী নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি তারা হেবরন (আল-খলিল) শহরে শত শত নতুন বাড়ি তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। এসব বাড়িঘরের অবস্থান ইব্রাহিমি মসজিদের পাশেই। এই মসজিদটি এখন ইসরায়েলের দখলে এবং একটি সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের এই কৌশল কোনো সাধারণ সামরিক শাসন নয়। এটি আসলে ধাপে ধাপে পুরো অঞ্চলকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। তারা আইনি মারপ্যাঁচ, প্রত্নতত্ত্ব, বসতি সম্প্রসারণ এবং রাজনৈতিক কারসাজির মাধ্যমে পশ্চিম তীরের ভূগোল ও জনসংখ্যাকে এমনভাবে বদলে দিচ্ছে যাতে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর মূল লক্ষ্য হলো এই অঞ্চলকে তথাকথিত ‘বাইবেলীয় ইসরায়েল ভূমি’-র অংশ করা, যা ফিলিস্তিনিদের জাতীয় পরিচয় ভেঙে দিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে ইহুদি-ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।
এই দখলদারিত্বের মূলে আছে সেই ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী ধারণা যে ‘জুডিয়া ও সামারিয়া’ হলো ইহুদিদের জন্মগত অধিকার। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই জায়নবাদী আন্দোলন এবং বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি ভূমি দখলকে নিজেদের অধিকার মনে করে। তাদের কাছে এটা কোনো দখল নয়। বরং তাদের ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত এক পবিত্র ‘প্রত্যাবর্তন’।
তবে ইসরায়েলের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরাও এই দাবির কঠোর সমালোচনা করছেন। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক রাফি গ্রিনবার্গ প্রত্নতত্ত্বকে এভাবে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে কোনো একক গোষ্ঠীর একচেটিয়া অধিকারের প্রমাণ নেই। বরং সেখানে বারবার বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়– যেমন ক্যানানীয়, রোমান, বাইজেন্টাইন, খ্রিস্টান ও ইসলামিক। গ্রিনবার্গ বলেন, “প্রত্নতত্ত্ব এমন কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ দেয় না, যা এই কট্টরপন্থী সরকার চায়। তাই তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য গালগল্প তৈরি করতে হয়।”
এসব থেকেই বোঝা যায়, বাইবেলীয় গল্পটি আসলে একটি রাজনৈতিক দখলদারিত্বের অজুহাত মাত্র। এটি জমি ও সম্পদ নিয়ে চলা একটি রাজনৈতিক লড়াইকে ইতিহাস ও পৌরাণিক গল্পের যুদ্ধ হিসেবে তুলে ধরে। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদেরকে এমন বহিরাগত হিসেবে দেখানো হয়, যাদের এই ভূমির সঙ্গে কোনো ঐতিহাসিক সম্পর্ক বা অধিকার নেই।
ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিকতা
১৯৪৮ সালের নাকবার (বিপর্যয়) পর পশ্চিম তীর জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন ইসরায়েল এটিকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করত। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। তখন তারা এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়: কীভাবে ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে নিজেদের দেশের সঙ্গে পুরোপুরি মিশিয়ে না দিয়ে অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে দায়ান ‘খোলা সেতু নীতি’ নামে একটি কৌশল গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে জর্ডান নদীর ওপর দিয়ে মানুষ ও পণ্য চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনি অর্থনীতিকে সচল রাখা এবং তাদের শাসনের ভার না নেওয়া। একই সঙ্গে, তারা গোপনে ফিলিস্তিনিদের স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ার জন্য উৎসাহিত করত। এ সময় তারা কিছু কৌশলগত জায়গায়, যেমন জর্ডান উপত্যকা এবং জেরুসালেমের আশপাশে, বসতি স্থাপন শুরু করে।
১৯৭৪ সালে যখন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ফিলিস্তিনিদের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তখন ইসরায়েল নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করে। তারা পিএলও-কে পাশ কাটিয়ে স্থানীয় ফিলিস্তিনি নেতাদের নিয়ে ‘ভিলেজ লীগ’ নামে প্রশাসনিক দল গঠন করে। ইসরায়েল এদেরকে নিজেদের সহযোগী হিসেবে কাজ করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি এই দলগুলোকে বিশ্বাসঘাতক মনে করে। ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা (গণঅভ্যুত্থান) শুরু হলে এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
এই কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি উভয় পক্ষ গোপনে আলোচনা শুরু করে, যার ফল স্বরূপ ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীরকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়।
এরিয়া এ: পশ্চিম তীরের প্রায় ১৮ শতাংশ, যেখানে প্রধান শহরগুলো আছে। এটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পূর্ণ বেসামরিক ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকে।
এরিয়া বি: প্রায় ২১ শতাংশ, যেখানে শহরগুলোর আশপাশের গ্রামগুলো আছে। এটি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি যৌথ নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানে থাকে।
এরিয়া সি: পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশেরও বেশি, যেখানে ইসরায়েলি বসতি, সীমান্ত অঞ্চল, বাইপাস রাস্তা এবং বেশির ভাগ কৃষিজমি ও জল সম্পদ আছে। এটি সম্পূর্ণ ইসরায়েলি বেসামরিক ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকে।
অসলো চুক্তির পর ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জনসংখ্যা কেন্দ্রগুলো পরিচালনার ভার ছেড়ে দিয়ে এরিয়া সি-এর বিশাল অংশ নিজেদের দখলে রাখার দিকে মনোযোগ দেয়। এ জন্য তারা আইনি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে। যেমন, ইসরায়েল প্রত্নতত্ত্ব আইন সংশোধন করে দখলকৃত ভূমিতে তাদের এখতিয়ার বাড়াচ্ছে। যদিও তারা বলে যে এটি ইহুদি ঐতিহ্য রক্ষার জন্য করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ঘোষণা করে ফিলিস্তিনিদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কেন একটি পুতুল মাত্র
কোনো ভূখণ্ডকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সেখানকার জনসংখ্যাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের, বিশেষ করে এরিয়া সি-তে বসবাসকারীদের, এলাকা ছাড়তে বাধ্য করার জন্য বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি করে।
সম্প্রতি, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনি গ্রাম, শহর এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে হামলা বাড়িয়েছে। একই সাথে, বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়ই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায়, যা সেখানে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। এর ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে নিজেদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে।
এই দখলদারিত্বের কৌশলকে সম্পূর্ণ করার জন্য ইসরায়েল ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পদ্ধতিগতভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ)-কে পুরোপুরি ভেঙে যেতে দেয় না, কারণ তাহলে তাদেরই ফিলিস্তিনিদের প্রশাসনের দায়িত্ব নিতে হবে। বরং তারা পিএ-কে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে, এর কর্মকর্তাদের চলাচলে বাধা দিয়ে এবং তাদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে একটি দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিণত করেছে।
ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বকে ভেঙে দেওয়ার জন্য ইসরায়েল আবার সেই পুরানো কৌশল ব্যবহার করছে: স্থানীয় পর্যায় থেকে সহযোগী নেতা তৈরি করা। তারা গোত্র প্রধান, গ্রামের মোড়ল এবং প্রবীণদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে এমন কাঠামো তৈরি করতে চাইছে যারা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এটি ১৯৮০-র দশকে ব্যর্থ হওয়া ভিলেজ লীগ প্রকল্পের মতোই। এর উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনি সমাজকে বিভক্ত করা এবং একটি জাতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা না করে স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে তাদেরকে পরিচালনা করা।
সাম্প্রতিক কিছু প্রস্তাব, যেমন ‘হেবরন আমিরাত’ বা যুদ্ধের পর গাজায় যুদ্ধবাজদের দিয়ে প্রশাসন চালানোর পরিকল্পনা, এই কৌশলেরই অংশ। আপাতদৃষ্টিতে এসব নীতিকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে দেখানো হলেও, বাস্তবে এগুলো হলো ধাপে ধাপে পুরো অঞ্চলকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার এক সুদূরপ্রসারী কৌশলের অংশ।
আইন, প্রত্নতত্ত্ব, বসতি স্থাপন, জনসংখ্যাগত চাপ, রাজনৈতিক দমন ও সামাজিক বিভাজনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ইসরায়েল একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে। এর ফলে জর্ডান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে যে বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে, তা কোনো সাম্য বা নাগরিকত্বের ভিত্তিতে গঠিত নয়, বরং এটি এক গোষ্ঠীর ওপর অন্য গোষ্ঠীর আধিপত্যের একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা। অনেক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি ইসরায়েলি সংস্থাগুলোও একে “বর্ণবাদ” বলে অভিহিত করেছে।
বসতি স্থাপন, ভূমি বিভাজন এবং পশ্চিম তীরকে বিচ্ছিন্ন অংশে পরিণত করার এই অব্যাহত প্রক্রিয়ার কারণে তথাকথিত ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’ এখন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন নিয়ে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘে পাস হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে নিউইয়র্ক ডিক্লারেশন। অথচ গাজায় প্রতিদিন শত শত মানুষ মরছে ইসরায়েলের বর্বর হামলায়। ইতিমধ্যে সরকারি ঘোষিত হিসাবে এই সংখ্যা ৬৫ হাজারের বেশি। অন্য হিসাব বলছে দু লাখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় গণহত্যার নজির নেই বললেই চলে। গাজা প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরই অংশ। আরেক অংশ পশ্চিম তীর। গাজার গণহত্যার ঘটনায় পশ্চিম তীরও কীভাবে ফিলিস্তিনিদের হাত থেকে ইসরায়েলের দখলে চলে যাচ্ছে তা কেউই আর খেয়াল করছে না। আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বে তার বন্ধুদের পূর্ণ সমর্থনে ইসরায়েল সেখানে এক-রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করছে। ক্রমে মুছে ফেলছে ফিলিস্তিনিদের নিজেদের দেশ গড়ার স্বপ্ন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজাকে জনশূন্য করার ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিম তীর নিরবে দখলে করে চলেছেন। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু সৌদি আরব দখলেও অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। ঈশ্বর প্রতিশ্রুত সেই বৃহত্তর ইসরায়েল গড়ার রূপকার হতে চাচ্ছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নেতানিয়াহু।
সম্প্রতি পশ্চিম তীরে ইসরায়েলে নিরব দখল নিয়ে একটি বিশ্লেষণ মূলক প্রতিবেদন করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য ক্রেডল। তারা মূলত পশ্চিম এশিয়া ও আরব দেশ নিয়ে সংবাদ, বিশ্লেষণ, মতামত প্রকাশ করে থাকে।
‘জুডিয়া এবং সামারিয়া’ কীভাবে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় নীতি হলো
দ্য ক্রেডল লিখছে, সম্প্রতি তেল আবিবে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ওয়েস্ট ব্যাংক” শব্দটি সঠিক নয়। এর বদলে তিনি এর বাইবেলীয় নাম, “জুডিয়া ও সামারিয়া” ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন যে, জেরুসালেম হলো “ইহুদি রাষ্ট্রের অবিসংবাদিত ও অবিভাজ্য রাজধানী।”
আসলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন মন্তব্য ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের একটি বড় কৌশলের অংশ। তারা দখল করা পশ্চিম তীরকে ধীরে ধীরে নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার জন্য ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গল্পকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
বছরের পর বছর ধরে তেল আবিব সেখানে অবৈধ বসতি স্থাপন, জোর করে জমি দখল এবং ফিলিস্তিনিদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলার মতো আগ্রাসী নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি তারা হেবরন (আল-খলিল) শহরে শত শত নতুন বাড়ি তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। এসব বাড়িঘরের অবস্থান ইব্রাহিমি মসজিদের পাশেই। এই মসজিদটি এখন ইসরায়েলের দখলে এবং একটি সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের এই কৌশল কোনো সাধারণ সামরিক শাসন নয়। এটি আসলে ধাপে ধাপে পুরো অঞ্চলকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। তারা আইনি মারপ্যাঁচ, প্রত্নতত্ত্ব, বসতি সম্প্রসারণ এবং রাজনৈতিক কারসাজির মাধ্যমে পশ্চিম তীরের ভূগোল ও জনসংখ্যাকে এমনভাবে বদলে দিচ্ছে যাতে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর মূল লক্ষ্য হলো এই অঞ্চলকে তথাকথিত ‘বাইবেলীয় ইসরায়েল ভূমি’-র অংশ করা, যা ফিলিস্তিনিদের জাতীয় পরিচয় ভেঙে দিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে ইহুদি-ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।
এই দখলদারিত্বের মূলে আছে সেই ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী ধারণা যে ‘জুডিয়া ও সামারিয়া’ হলো ইহুদিদের জন্মগত অধিকার। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই জায়নবাদী আন্দোলন এবং বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি ভূমি দখলকে নিজেদের অধিকার মনে করে। তাদের কাছে এটা কোনো দখল নয়। বরং তাদের ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত এক পবিত্র ‘প্রত্যাবর্তন’।
তবে ইসরায়েলের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদেরাও এই দাবির কঠোর সমালোচনা করছেন। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক রাফি গ্রিনবার্গ প্রত্নতত্ত্বকে এভাবে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে কোনো একক গোষ্ঠীর একচেটিয়া অধিকারের প্রমাণ নেই। বরং সেখানে বারবার বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়– যেমন ক্যানানীয়, রোমান, বাইজেন্টাইন, খ্রিস্টান ও ইসলামিক। গ্রিনবার্গ বলেন, “প্রত্নতত্ত্ব এমন কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ দেয় না, যা এই কট্টরপন্থী সরকার চায়। তাই তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য গালগল্প তৈরি করতে হয়।”
এসব থেকেই বোঝা যায়, বাইবেলীয় গল্পটি আসলে একটি রাজনৈতিক দখলদারিত্বের অজুহাত মাত্র। এটি জমি ও সম্পদ নিয়ে চলা একটি রাজনৈতিক লড়াইকে ইতিহাস ও পৌরাণিক গল্পের যুদ্ধ হিসেবে তুলে ধরে। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদেরকে এমন বহিরাগত হিসেবে দেখানো হয়, যাদের এই ভূমির সঙ্গে কোনো ঐতিহাসিক সম্পর্ক বা অধিকার নেই।
ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিকতা
১৯৪৮ সালের নাকবার (বিপর্যয়) পর পশ্চিম তীর জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন ইসরায়েল এটিকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করত। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। তখন তারা এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়: কীভাবে ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে নিজেদের দেশের সঙ্গে পুরোপুরি মিশিয়ে না দিয়ে অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে দায়ান ‘খোলা সেতু নীতি’ নামে একটি কৌশল গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে জর্ডান নদীর ওপর দিয়ে মানুষ ও পণ্য চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনি অর্থনীতিকে সচল রাখা এবং তাদের শাসনের ভার না নেওয়া। একই সঙ্গে, তারা গোপনে ফিলিস্তিনিদের স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ার জন্য উৎসাহিত করত। এ সময় তারা কিছু কৌশলগত জায়গায়, যেমন জর্ডান উপত্যকা এবং জেরুসালেমের আশপাশে, বসতি স্থাপন শুরু করে।
১৯৭৪ সালে যখন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ফিলিস্তিনিদের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তখন ইসরায়েল নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করে। তারা পিএলও-কে পাশ কাটিয়ে স্থানীয় ফিলিস্তিনি নেতাদের নিয়ে ‘ভিলেজ লীগ’ নামে প্রশাসনিক দল গঠন করে। ইসরায়েল এদেরকে নিজেদের সহযোগী হিসেবে কাজ করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি এই দলগুলোকে বিশ্বাসঘাতক মনে করে। ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা (গণঅভ্যুত্থান) শুরু হলে এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
এই কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি উভয় পক্ষ গোপনে আলোচনা শুরু করে, যার ফল স্বরূপ ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীরকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়।
এরিয়া এ: পশ্চিম তীরের প্রায় ১৮ শতাংশ, যেখানে প্রধান শহরগুলো আছে। এটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পূর্ণ বেসামরিক ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকে।
এরিয়া বি: প্রায় ২১ শতাংশ, যেখানে শহরগুলোর আশপাশের গ্রামগুলো আছে। এটি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি যৌথ নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানে থাকে।
এরিয়া সি: পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশেরও বেশি, যেখানে ইসরায়েলি বসতি, সীমান্ত অঞ্চল, বাইপাস রাস্তা এবং বেশির ভাগ কৃষিজমি ও জল সম্পদ আছে। এটি সম্পূর্ণ ইসরায়েলি বেসামরিক ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকে।
অসলো চুক্তির পর ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জনসংখ্যা কেন্দ্রগুলো পরিচালনার ভার ছেড়ে দিয়ে এরিয়া সি-এর বিশাল অংশ নিজেদের দখলে রাখার দিকে মনোযোগ দেয়। এ জন্য তারা আইনি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে। যেমন, ইসরায়েল প্রত্নতত্ত্ব আইন সংশোধন করে দখলকৃত ভূমিতে তাদের এখতিয়ার বাড়াচ্ছে। যদিও তারা বলে যে এটি ইহুদি ঐতিহ্য রক্ষার জন্য করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ঘোষণা করে ফিলিস্তিনিদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কেন একটি পুতুল মাত্র
কোনো ভূখণ্ডকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সেখানকার জনসংখ্যাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের, বিশেষ করে এরিয়া সি-তে বসবাসকারীদের, এলাকা ছাড়তে বাধ্য করার জন্য বিভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি করে।
সম্প্রতি, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনি গ্রাম, শহর এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে হামলা বাড়িয়েছে। একই সাথে, বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়ই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায়, যা সেখানে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। এর ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে নিজেদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে।
এই দখলদারিত্বের কৌশলকে সম্পূর্ণ করার জন্য ইসরায়েল ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পদ্ধতিগতভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ)-কে পুরোপুরি ভেঙে যেতে দেয় না, কারণ তাহলে তাদেরই ফিলিস্তিনিদের প্রশাসনের দায়িত্ব নিতে হবে। বরং তারা পিএ-কে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে, এর কর্মকর্তাদের চলাচলে বাধা দিয়ে এবং তাদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করে একটি দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিণত করেছে।
ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বকে ভেঙে দেওয়ার জন্য ইসরায়েল আবার সেই পুরানো কৌশল ব্যবহার করছে: স্থানীয় পর্যায় থেকে সহযোগী নেতা তৈরি করা। তারা গোত্র প্রধান, গ্রামের মোড়ল এবং প্রবীণদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে এমন কাঠামো তৈরি করতে চাইছে যারা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এটি ১৯৮০-র দশকে ব্যর্থ হওয়া ভিলেজ লীগ প্রকল্পের মতোই। এর উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনি সমাজকে বিভক্ত করা এবং একটি জাতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা না করে স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে তাদেরকে পরিচালনা করা।
সাম্প্রতিক কিছু প্রস্তাব, যেমন ‘হেবরন আমিরাত’ বা যুদ্ধের পর গাজায় যুদ্ধবাজদের দিয়ে প্রশাসন চালানোর পরিকল্পনা, এই কৌশলেরই অংশ। আপাতদৃষ্টিতে এসব নীতিকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসেবে দেখানো হলেও, বাস্তবে এগুলো হলো ধাপে ধাপে পুরো অঞ্চলকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার এক সুদূরপ্রসারী কৌশলের অংশ।
আইন, প্রত্নতত্ত্ব, বসতি স্থাপন, জনসংখ্যাগত চাপ, রাজনৈতিক দমন ও সামাজিক বিভাজনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ইসরায়েল একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে। এর ফলে জর্ডান নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে যে বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে, তা কোনো সাম্য বা নাগরিকত্বের ভিত্তিতে গঠিত নয়, বরং এটি এক গোষ্ঠীর ওপর অন্য গোষ্ঠীর আধিপত্যের একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা। অনেক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি ইসরায়েলি সংস্থাগুলোও একে “বর্ণবাদ” বলে অভিহিত করেছে।
বসতি স্থাপন, ভূমি বিভাজন এবং পশ্চিম তীরকে বিচ্ছিন্ন অংশে পরিণত করার এই অব্যাহত প্রক্রিয়ার কারণে তথাকথিত ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান’ এখন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।