ভোটে অন্যদের জেতানো প্রশান্ত হারলেন কেন

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
ভোটে অন্যদের জেতানো প্রশান্ত হারলেন কেন
নির্বাচনে জেতা তো দূরের কথা, একটি আসনও পায়নি প্রশান্তের দল। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের অন্যতম ভোটকুশলী হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন প্রশান্ত কিশোর। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও বিহারের নীতীশ কুমারসহ অনেকেই তার পরামর্শ ও কৌশল অনুসরণ করে ভোটের মাঠে বাজিমাত করেছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি লিখেছে, ভারতীয় রাজনীতি, বিশেষ করে নির্বাচনী মঞ্চের পেছনের জাদুকর হিসেবে পরিচিত ৪৮ বছর বয়সী প্রশান্ত নিজের বেলায় সফল হতে পারলেন না। বছরের পর বছর যে খেলায় তিনি অন্যদের জিতিয়েছেন, সেই একই খেলায় মাঠে নেমে হারলেন।

সর্বশেষ বিহারের বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে ‘জন সুরাজ’ নামে নিজের একটি দল গড়েন প্রশান্ত। আশ্বাস দিয়েছিলেন, ভারতের দরিদ্রতম এই রাজ্যটির দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতা ভাঙবেন তিনি।

গত দুই বছরে পুরো রাজ্যে পায়ে হেঁটে নিজ দলের প্রচার চালিয়েছেন প্রশান্ত। বিহারের ২৪৩টি আসনের মধ্যে প্রার্থী দিয়েছিলেন ২৩৮টিতে। তবে নির্বাচনে জেতা তো দূরের কথা, একটি আসনও পায়নি প্রশান্তের দল।

কেন এই পরাজয়

ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন প্রশান্ত। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিককেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে এই আকর্ষণকে ভোটে পরিণত করতে পারেননি তিনি।

ইতিহাস বলছে, ১৯৮৩ সালে আঞ্চলিক দল তেলেগু দেশম পার্টির (টিডিপি) উত্থানের পর থেকে খুব কম নতুন দলই ভারতের রাজনীতিতে নিজেদের জায়গা করে নিতে পেরেছে।

যে কয়েকটি দল এই জায়গা পেয়েছে তারমধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস ও ওড়িশার বিজু জনতা দল। এরা মূলত প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ভিত্তি থাকা দলগুলো ভেঙে নতুন দল গঠন করেছিল।

এর বাইরে ১৯৮৫ সালে আসামের ‘অসম গণ পরিষদ (এজিপি)’, এর বহু বছর পরে সংকটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয়েছিল আম আদমি পার্টি (আপ)। এরা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।

রাজনৈতিক ব্লিশেষক রাহুল ভার্মার মতে, জন সুরাজ দল কোনো গণআন্দোলন থেকে জন্ম নেয়নি; বা কোনো প্রবল সরকারবিরোধী ক্ষোভের মুহূর্তে আত্মপ্রকাশ করেনি।

নানামুখী সমস্যা থাকলেও বিহারে মোটামুটি স্থিতিশীলতা রয়েছে, তেমন গণ অসন্তোষ ছিল না।

প্রশান্ত কিশোর সরাসরি কোনো আসনে প্রার্থী না হওয়ার জনমনে আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে বলেও মনে করেন বিশ্লেষক সৌরভ রাজ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
প্রশান্ত কিশোর সরাসরি কোনো আসনে প্রার্থী না হওয়ার জনমনে আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে বলেও মনে করেন বিশ্লেষক সৌরভ রাজ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

দিল্লিভিত্তিক ইন্ডিয়ান স্কুল অব ডেমোক্রেসির সৌরভ রাজ বলেন, জন সুরাজ পার্টিকে একটি বুদ্ধিভিত্তিক ও কৌশলগত প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করেছিলেন প্রশান্ত। এটি ‘রাজনীতিতে শূন্যস্থান’ পূরণ করবে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি। তার দলের পদযাত্রা সেই বুদ্ধিভিত্তিক ধারণাকে জনগণের আন্দোলনে রূপ দিতে চেয়েছিল। তবে একটি নতুন দলেরও গ্রহণযোগ্যতার জন্য যে স্বতস্ফূর্ত উদ্দীপনা দরকার, সেটি তৈরিতে জন সুরাজ পার্টির ঘাটতি ছিল।

বিবিসি লিখেছে, শাসনব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, কাজ ও শিক্ষার জন্য বাধ্যতামূলক অভিবাসনের মতো সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত এমন অনেক বিষয় তিনি সামনে এনেছিলেন, তবে তার পুরো প্রচার ব্যবস্থা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর তরুণদের ওপর নির্ভর করে চালানো হয়েছে।

তবে সেখানে জনগণকে আকৃষ্ট করার মতো আবেগীয় শক্তি ছিল না। তাছাড়া প্রশান্ত কিশোর সরাসরি কোনো আসনে প্রার্থী না হওয়ার জনমনে আস্থাহীনতা তৈরি হতে পারে বলেও মনে করেন সৌরভ রাজ।

এই ফলাফল আবার একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে, কেবল মনোযোগ পেলেই সংগঠন গড়ে ওঠে না, আর শক্তিশালী তৃণমূল উপস্থিতি ছাড়া অতিরিক্ত প্রচার অনেক সময় উল্টো প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করতে পারে।

সৌরভ রাজ আরও বলেন, দলটির পরিচিতি থাকলেও এর কোনো স্বাভাবিক সামাজিক ভিত্তি নেই। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ বা শহরকেন্দ্রিক কোনো ভোটব্যাংকই দলটির পক্ষে কাজ করেনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাহুল ভার্মা বিষয়টিকে আরও সহজ করে বলেন, “ব্যবসার মতো রাজনীতিতেও স্টার্টআপের ব্যর্থতাই বেশি-সফলতার দেখা কালেভদ্রে মেলে।”

রাহুল বলেন, একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন দৃশ্যমানতা, সুসংঠিত কাঠামো, ভোটার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। কিন্তু প্রশান্ত প্রচার চালিয়েছেন তরুণদের লক্ষ্য করে, তাদের প্রার্থীদের বেশিরভাগই ছিল প্রথমবার নির্বাচন করছেন এমন।

ফলে মিডিয়া কাভারেজেও আধিপত্য বজায় রাখা প্রশান্তর ভরাডুবি হয়েছে ৭৪ বছর বয়সী অভিজ্ঞ নেতা নীতীশ কুমারের জোটের কাছে।

সৌরভ রাজের মতে, বর্তমান ভারতীয় ভোটাররা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং একই সঙ্গে তারা অত্যন্ত বাস্তববাদী।

জন সুরাজ যেসব ইস্যু সামনে এনেছিল, তা অনেক আকষর্ণীয় হলেও কোনো পরিচিত বা প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন কোনো প্রার্থী না থাকায় ভোটাররা ভরসা করতে পারেননি বলে মনে করেন সৌরভ।

তবে জন সুরাজের জন্য এটিই শেষ নয়। নির্বাচন হারলেও বিহারে থেকে তৃণমূল সংগঠন ও এজেন্ডাকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি আগেও দিয়েছিলেন প্রশান্ত।

সৌরভের ধারণা, যদি জন সুরাজ মাঠ পর্যায়ে উপস্থিতি বজায় রাখতে পারে, স্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারে এবং নির্বাচন পরবর্তী স্থবিরতা এড়িয়ে যেতে পারে তাহলে একটি শক্ত ভিত তৈরি করতে পারে দলটি।

বিহারের এক গ্রামের একজন ভোটার স্থানীয় একজন প্রতিবেদককে বলেন, পরের নির্বাচনে মানুষ হয়তো প্রশান্ত কিশোরের ডাকে সাড়া দেবেন। এখন তিনি মাত্র শুরু করছেন। তিনি এমন কোনো সুপারহিরো নন যে এক লাফে উড়ে যাবেন।

সম্পর্কিত