কেন ‘হার্ডলাইনে’ এনসিপি

তাসীন মল্লিক
তাসীন মল্লিক
কেন ‘হার্ডলাইনে’ এনসিপি
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লোগো

রাজনীতির মাঠে এখন এক জটিল অবস্থানে পৌঁছেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। প্রতীক ইস্যুতে অনড় অবস্থান, নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার হুমকিসহ কয়েকটি ইস্যুতে দলটি ‘হার্ডলাইনে’ যাবে বলে অনেকেই মনে করছেন। দলটির নেতাদের ভাষ্য, ভবিষ্যত রাজনীতির কৌশল হিসেবে তারা অনড় অবস্থানের দিকে যাচ্ছে।

ভোটের প্রতীক হিসেবে ‘শাপলা’ না পেলে নিবন্ধন এবং আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে এনসিপি। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন ও কয়েকটি সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে রাজপথে নামার ঘোষণাও দিয়েছে দলটি।

গত ৪ অক্টোবর দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে লিঁয়াজো রেখেছে এবং তারা নিজেদের ‘সেফ এক্সিটের’ কথাও ভাবছে।’’

গত বৃহস্পতিবার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে তিনি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক পাঁচজন মহাপরিচালকসহ বেশ কয়েকজন সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়েও মন্তব্য করেন। সেনাবাহিনীকে ‘কলঙ্কমুক্ত’ করতে হলে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত’ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনতেই হবে বলে জোর দেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলাম।

এদিকে, গত ৯ অক্টোবর এনসিপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই বৈঠকের পর এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের বলেন, তার দল দল শাপলা ছাড়া নিবন্ধন মানবে না এবং নির্বাচনেও যাবে না।

রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজেনর পক্ষে এনসিপি। সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের বিপরীতে দলটির অবস্থান।

শাপলা ইস্যুটিকে নিজেদের রাজনৈতিক মর্যাদা এবং অস্তিত্বের সংকট হিসেবে নিয়েছে এনসিপি। গণভোট এবং সামরিক কর্মকর্তাদের বিচার কেন্দ্র করে দলটির কৌশল, নিজেদের নীতিগত অবস্থানকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখানো আর ‘সেফ এক্সিটের’ ইস্যু মূলত রাজনৈতিক বার্তা, এটিকে কেন্দ্র করে অন্তবর্তী সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে তারা।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার চরচাকে বলেন, “আমরা অবশ্যই চাপ সৃষ্টি করতে চাই। যেন সরকার গণঅভ্যুত্থানের পথ থেকে সরে না যায়। তাদের সামনে যে কয়দিন বাকি আছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে সুষ্ঠ নির্বাচন উপহার দেওয়া। এটা থেকে তারা তারা যেন বিচ্যুত না হয়।’’

শাপলা যেখানে মর্যাদার প্রশ্ন

শাপলা প্রতীক এনসিপিকে দেওয়া না দেওয়াকে এনসিপি রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্ন হিসেবে দেখছে। ইসির স্পষ্ট কথার পরেও এনসিপি তার জায়গা থেকে এক চুলও নড়েনি।

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা এনসিপির এই অনমনীয় অবস্থানকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি বলেন, “নিবন্ধন যদি আমাদেরকে দিতে হয় এবং নিবন্ধন প্রশ্ন সেটা শাপলা দিয়েই হবে। শাপলা ছাড়া এনসিপি নিবন্ধন হবে না এবং এনসিপিও শাপলা ছাড়া নিবন্ধন মানবে না।”

গত ৯ অক্টোবর সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে সংবাদিকদের মুখোমুখি হন এনসিপি নেতারা। ছবি: চরচা
গত ৯ অক্টোবর সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে সংবাদিকদের মুখোমুখি হন এনসিপি নেতারা। ছবি: চরচা

এনসিপি মনে করে, ইসির ওপর কোনো ‘অদৃশ্য প্রভাব’ কাজ করছে, যা প্রতীক ইস্যুকে জটিল করে তুলছে। তাদের অভিযোগের তীর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) দিকে। প্রতীকের জন্য রাজপথে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে পাটওয়ারী স্পষ্ট করেন, ‘‘তারা (ইসি) গত মিটিংয়ে আমাদের ডিজিএফআইয়ের কিছু উদাহরণ দিয়েছিল, বিভিন্ন সংস্থার উদাহরণ দিয়েছিল। সেটাও আমরা আজকে বলেছি— যে আপনারা যদি কোথাও থেকে প্রেশার ফিল করেন বা কেউ আপনাদেরকে চাপ দিয়ে থাকে, আপনারা আমাদেরকে জানান, আমরা আপনাদের সঙ্গে কিছু বলব না। আমরা তাদের রাজপথে মোকাবিলা করব।’’

সেফ এক্সিট: রাজনৈতিক বার্তা

নাহিদ ইসলামের পর এনসিপির একাধিক নেতা উপদেষ্টাদের ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন। এ ইস্যুতে তাদের অবস্থানও সরকার ও অন্তর্বর্তী প্রশাসনের উপর একধরনের চাপ প্রয়োগের কৌশল।

দলটির একাধিক নেতার ভাষ্য, অন্তর্বর্তী প্রশাসনের একাধিক উপদেষ্টার পক্ষপাতমূলক আচরণের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিতেই এমন মন্তব্য করা হয়। নাম উল্লেখ না করলেও উপদেষ্টারা কেউ বিএনপির পক্ষে আবার কেউ জামায়াতের পক্ষে কাজ করছেন বলে অভিযোগ তাদের। এমনকি ‘শাপলা’ প্রতীক নিয়ে সংকটের পেছনে একজন উপদেষ্টার হস্তক্ষেপও এমন মন্তব্যের পেছনের কারণ বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা।

‘সেফ এক্সিট’ সংক্রান্ত বক্তব্য এনসিপির রাজনৈতিক কৌশল ও হার্ডলাইন অবস্থানকে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে। দলটি সরকারের প্রতি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, নিজেদের মর্যাদা, প্রতীক এবং রাজনীতিতে ভূমিকার ওপর কোনো আপস করবে না। একই সঙ্গে তারা রাজনৈতিক চাপে সরকারের ও অন্তর্বর্তী প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া যাচাই করতে চাচ্ছে।

এনসিপি নেতাদের ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে মন্তব্যের জেরে কয়েকজন উপদেষ্টা এরইমধ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

সারোয়ার তুষার চরচাকে বলেন, ‘‘সেফ এক্সিট মানে পালিয়ে যাবে সেটা না। সেফ এক্সিট মানে হচ্ছে এক ধরনের নেগোসিয়েশন করে ফেলছে। অনেক উপদেষ্টার আচরণে কথাবার্তায়, বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডে আমাদের কাছে মনে হয় তারা সারেন্ডার করেছে।’’

‘‘তারা (উপদেষ্টারা) যাদের নেক্সট গভার্মেন্ট মনে করছে, সেরকম কোনো দলের সঙ্গে অনেক কিছু কম্প্রোমাইজ করছে। গণ আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তাদের যা করার দরকার সেগুলো তারা আসলে ডেলিভার করতে পারছে না।’’

গণভোট ও বিচার: ভবিষ্যতের কৌশল

নির্বাচনের আগে গণভোট এবং সামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের ইস্যুকে কেন্দ্র করে এনসিপির অবস্থান তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশলকে প্রভাবিত করছে। দলটি এই বিষয়গুলোকে কেবল নীতিগত দাবির হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করছে। যা আগামী নির্বাচনে দলটিকে ভোটারদের সামনে জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে দায়বদ্ধ প্রমাণে ভূমিকা রাখবে।

দল গঠনের পর এনসিপি রাষ্ট্র সংস্কারের রাজনীতিকে মুখ্য করে তুলতে চাইছে। ফলে সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অগ্রিম বিজয় নিশ্চিত করতে চায়। আর সামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের ক্ষেত্রে আপসহীন অবস্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিশ্রুতির প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখতে চায়।

এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব তাহসিন রিয়াজ চরচাকে বলেন, ‘‘আমাদের অন্যতম তিনটি এজেন্ডা হল: সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। সংস্কারের প্রক্রিয়া এগোচ্ছে, বিচার প্রক্রিয়াও এগোচ্ছে। বিশেষ করে হাইকোর্ট ডিভিশন যেভাবে কাজ করছে, আমরা তা অ্যাপ্রিশিয়েট করছি। আমরা সংস্কার এবং বিচারের প্রশ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’’

দলের একাধিক নেতা মনে করছেন, এই কৌশল ভবিষ্যতে এনসিপিকে রাজনৈতিক মর্যাদা রক্ষায় সহায়তা করবে। রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য নীতিগত সীমা ছাড়বে না দলটি। ভবিষ্যতে এই কৌশল নীতি ও ক্ষমতার সমন্বয় ঘটিয়ে দলকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে শক্ত অবস্থানে রাখবে।

সম্পর্কিত