আফগানিস্তানের জন্য পাতা ফাঁদে নিজেই পড়ল পাকিস্তান

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
আফগানিস্তানের জন্য পাতা ফাঁদে নিজেই পড়ল পাকিস্তান
ট্রাকগুলোতে আফগান নাগরিকদের মালপত্র বোঝাই করা হয়েছে, যারা পাকিস্তান আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার পর নিজ দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন। ছবিটি ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের চামান সীমান্তে তোলা। ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় পাকিস্তান এখন বছরে এক বিলিয়ন ডলার হারাতে চলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আফগানিস্তান এর জবাবে ইরান ও ভারতের দিকে বাণিজ্য সরিয়ে নিচ্ছে। ইসলামাবাদ বারবার হওয়া জঙ্গি হামলার প্রতিক্রিয়ায় সীমান্ত পেরিয়ে বিমান হামলা শুরু করার পর ঘটনাগুলোর এই ধারাকবাহিকতা আরও গতি পেয়েছে।

জাপানের গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র গত সপ্তাহে বলেছেন, “আফগানিস্তানের তালেবান সরকার (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান-টিটিপি বা পাকিস্তানি তালেবানকে সমর্থন দেওয়ার কারণে আমরা সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দিয়েছি এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্য স্থগিত করেছি।”

টিটিপি একটি পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠী যারা আফগানিস্তানে থেকে পাকিস্তানে হামলা চালায়। গত অক্টোবরে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানে কথিত টিটিপির আস্তানায় বিমান হামলা চালায়। এরপর দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষের শুরু হয়। এরপর থেকে দেশ দুটির অভিন্ন সীমান্ত গত ১১ অক্টোবর থেকে বন্ধ রয়েছে।

নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে, আফগানিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী মোল্লা আবদুল গনি বারাদার আফগান ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের বিকল্প বাণিজ্য পথ খুঁজতে বলেন এবং পাকিস্তারনে সঙ্গে থাকা বর্তমান চুক্তিগুলো তিন মাসের মধ্যে গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন।

এই সীমান্ত বন্ধের প্রভাব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের ওপর সম্পূর্ণ বিপরীত ফল এনেছে।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাকিস্তানের পরিসংখ্যান বলছে, অক্টোবরে আফগানিস্তানে পাকিস্তানের রপ্তানি ৫৭% কমেছে। ২০২৪ সালে প্রতিবেশি দেশে পাকিস্তানের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮০ কোটি মার্কিন ডলার। একই বছর মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে পাকিস্তানের রপ্তানি, যার বেশিরভাগই আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে যায়, প্রায় ২৭ কোটি ডলারে পৌঁছেছিল। সীমান্ত বন্ধের কারণে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছেন।

ইনফোগ্রাফ: চরচা
ইনফোগ্রাফ: চরচা

পাকিস্তান ফার্মাসিউটিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (পিপিএমএ) জানিয়েছে, তারা এরই মধ্যে বাণিজ্য স্থগিতের হওয়ার প্রধান শিকারে পরিণত হয়েছে।

পিপিএমএ’র চেয়ারম্যান তাহির আজম সম্প্রতি বলেন, “বাণিজ্য রুট বন্ধের পর পাক-আফগান সীমান্তে কোটি কোটি রুপির ওষুধ বহনকারী কয়েক ডজন কন্টেইনার আটকে আছে।”

পাক-আফগান জয়েন্ট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিও (পিএজেসিসিআই) ক্ষুব্ধ। সংগঠনটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জিয়া উল হক সরহাদি নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, আটকে থাকা কার্গোগুলি গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য সাত থেকে দশ দিনের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া উচিত।

জিয়া উল হক সরহাদি বলেন, “এই পণ্যগুলো নষ্ট হতে দেওয়া ব্যবসায়ী, পরিবহণকারী এবং উভয় দিকের জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর।”

সীমান্ত বন্ধের কারণে পাকিস্তানের অভিবাসী শ্রমিক, যারা কাজের জন্য সীমান্ত পার হন তাদের পরিবারও সমস্যায় পড়েছে।

অল-পাকিস্তান কাস্টমস বন্ডেড ক্যারিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জালত খান আচাকজাই বলেন, “চমন-এর হাজার হাজার মানুষ, যারা আফগানিস্তানে দিনমজুর হিসাবে কাজ করতেন, তারা এখন আটকা পড়েছেন। যাদের অনেকেই সীমান্তের অন্য দিকে ব্যবসা করেন, তাদের বৈধ পাসপোর্ট আছে, কিন্তু তাদের জন্য পাকিস্তানে ফেরা খুবই কঠিন।”

সীমান্ত বন্ধের কারণে আফগানিস্তানও অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হবে কারণ এর অনেক রপ্তানি পণ্য বিশেষত খাদ্য এবং কয়লা, পাকিস্তানে যায়।

করাচিভিত্তিক ব্রোকারেজ ও বিনিয়োগ ব্যাংক জেএস গ্লোবালের একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, আফগানিস্তান তার রপ্তানির ৪১% পাকিস্তানে পাঠায় এবং ট্রানজিট বাণিজ্য বাদ দিয়ে তার সরাসরি আমদানির ১৪% দেশটি থেকে কেনে।

তবে কাবুল এখন বিদ্যমান বাণিজ্য রুটগুলি প্রসারিত করে এবং ইরান, ভারত ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে নতুন সুযোগ খুঁজে পাকিস্তানের ওপর থেকে তার নির্ভরতা কমাতে চাইছে।

আফগানিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী নূরউদ্দিন আজিজি ২০ নভেম্বর থেকে পাঁচ দিনের জন্য ভারত সফর করেন। তার সফরকালে, একজন আফগান অ্যাটাশেকে ভারতে নিযুক্ত করার বিষয়ে উভয় দেশ একমত হয়। উভয় পক্ষ আফগান স্বর্ণ খনি কার্যক্রমে বিনিয়োগকারী ভারতীয় ব্যবসাগুলিকে পাঁচ বছরের কর ছাড় দিতে এবং ভারত-আফগানিস্তানের মধ্যে একটি এয়ার কার্গো করিডর স্থাপন করতেও সম্মত হয়েছে।

আফগানিস্তান এবং ভারতের মধ্যে এর মধ্যেই এক ধরনের বাণিজ্য অংশীদারত্ব রয়েছে। কারণ স্থলবেষ্টিত দেশ আফগানিস্তানের রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকরা পাকিস্তানি বন্দরগুলো এড়িয়ে চলতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহার করে। গত অক্টোবরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বন্দরটি চালু রাখার জন্য নয়াদিল্লিকে ছয় মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা মওকুফ করে।

ইনফোগ্রাফ: চরচা
ইনফোগ্রাফ: চরচা

ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করা আফগান আমদানিকারকদের জন্য উপকারী হবে। কারণ চাবাহার থেকে পণ্য আসার জন্য ছয় থেকে আট দিন অপেক্ষা করতে হয়। করাচি থেকে এলে তারা এর অর্ধেক সময়ে পণ্য হাতে পাবেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আফগান সরকার ইরান ও ভারতের দিকে বাণিজ্য সরিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

ইসলামাবাদভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ গুল বলেন, “দীর্ঘমেয়াদে আফগান বাণিজ্যে পাকিস্তান তার প্রাসঙ্গিকতা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। এই নতুন বিন্যাসের ফলে যে খরচ হবে তা আফগানিস্তানের চেয়ে পাকিস্তানের ওপর বেশি চাপ বাড়াবে।”

পাকিস্তানের ওপর এই খরচ শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। করাচির ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সহকারী অধ্যাপক আদিল নাখোদা বলেন, “মধ্য এশিয়ায় আরও নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ক্ষমতাও পাকিস্তানের জন্য হ্রাস পাবে, কারণ আফগানিস্তান এই ধরনের বাণিজ্য সংযোগের জন্য একটি প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট।”

তবে, আদিল নাখোদা কাবুলের বাণিজ্যকে পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “ইরান উল্লেখযোগ্য নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন এবং এর নিজস্ব আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কার্যক্রমে সীমা রয়েছে। এটি ভারত এবং আফগানিস্তানের বাণিজ্যকে, বিশেষ করে প্রয়োজনীয় এবং অন্যান্য পণ্য সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে বাধা দিতে পারে।”

সম্পর্কিত