বিশ্বে অনিয়মের নির্বাচন যেভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
বিশ্বে অনিয়মের নির্বাচন যেভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে
প্রতীকী ছবি। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

রাশিয়ায় গত বছর হওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ফলাফল ঘোষণার আগেই বিশ্বজুড়ে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল ভ্লাদিমির পুতিনই বিপুল ব্যবধানে জয়ী হবেন। ওই বছর মার্চের ১৫ থেকে ১৭ তারিখে অনুষ্ঠিত ভোটে রাশিয়ার নির্বাচন কমিশনের দাবি, তিনি পেয়েছেন ৮৭% ভোট এবং ভোটার উপস্থিতি নাকি রেকর্ড ৭৭.৫%। অথচ বাস্তবতা হলো—বিরোধীদের হয় কারাগারে, নয়তো নির্বাসনে, অনেকের মৃত্যু হয়েছে। অবৈধভাবে দখলকৃত ইউক্রেনের অংশগুলোতে ভোট হয়েছে বন্দুকের মুখে। সবকিছুই ছিল কঠোর তদারকির আওতায়। ওই বছর বাংলাদেশে হওয়া সাধারণ নির্বাচনেও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের শুরুতে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ছয় মাসের মাথায় পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। গণআন্দোলনের মুখে গত পাঁচই অগাস্ট ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা।

এমন পরিস্থিতি এখন বিশ্বের অনেক দেশেই দেখা যায়।  বিশ্বজুড়ে এ ধরনের অনিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন ক্রমশ সাধারণ হয়ে উঠছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)–এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৭৬টি দেশে নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২৮টিতে ভোট কোনোভাবেই পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এ থেকে স্পষ্ট যে ৭৬টির মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনে চলে, যেখানে নির্বাচন শুধুই বৈধতার ছদ্মবেশ, আর নাগরিকদের আনুগত্যের পুরস্কার দেওয়ার একটি হাতিয়ার।

facist

একনায়করা ভোট জেতেন নানা উপায়ে—ফলাফল জাল করে, নির্বাচনী ব্যবস্থা নিজের পক্ষে ঘুরিয়ে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে, বিরোধীদের হয়রানি ও ভয় দেখিয়ে, কিংবা সরাসরি ঘুষ দিয়ে। প্রশ্ন হলো, প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশগুলো এসব ভুয়া নির্বাচনের জবাব কীভাবে দিতে পারে?

এ পরিস্থিতিতে বিদেশি সরকারগুলোর হাতে খুব কার্যকর কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক দেশগুলো ভুয়া নির্বাচন অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু এর প্রভাব খুবই সীমিত, এমনকি নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও। ভেনেজুয়েলায় ২০১৯ সালে পশ্চিমা ও দক্ষিণ আমেরিকার গণতান্ত্রিক দেশগুলো হুয়ান গুয়াইদোকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, সেনাবাহিনী যেহেতু নিকোলাস মাদুরোর হাতে ছিল, তিনি ক্ষমতায় থেকে যান। আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মাদুরোর অবস্থান অটুট থাকে। বর্তমানে আমেরিকাও কার্যত মাদুরোকেই স্বীকৃতি দিয়েছে।

আবার কঙ্গোতে ২০১৯ সালে ভোট গণনার পর জানা যায়, মার্টিন ফায়ুলু ৬০% ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে ফেলিক্স শিসেকেদি ৩৯% ভোটে জয়ী। অনিয়মের কথা উল্লেখ করলেও আমেরিকা শিসেকেদিকে স্বীকৃতি দেয়। এভাবে ভুয়া নির্বাচন মেনে নেওয়া পশ্চিমা বিশ্বের গণতন্ত্ররক্ষক ভাবমূর্তিকে ক্ষয় করছে, এমন এক সময়ে যখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রই দুর্বল হয়ে পড়ছে।

আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউক্রেন রাশিয়ার নির্বাচনের ফলাফলকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। তবুও তারা নিজ নিজ রুশ দূতাবাসে শান্তিপূর্ণ ভোট আয়োজন নিশ্চিত করেছে। এতে প্রকৃত গণতন্ত্রগুলো এক অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখে পড়েছে—একদিকে তারা গণতন্ত্র প্রচারের নৈতিক বাধ্যবাধকতায় আছে, অন্যদিকে বিশ্ব ক্রমশ কম গণতান্ত্রিক হয়ে পড়ছে।

রাশিয়ার নির্বাচন কেবল একটি উদাহরণ। বিশ্বজুড়ে ভুয়া নির্বাচনের বাস্তবতা প্রমাণ করে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা। অস্বীকৃতি বা নিষেধাজ্ঞা হয়তো নৈতিক অবস্থানকে জোরদার করে, কিন্তু স্বৈরশাসকের ক্ষমতার ভিত্তি খুব কমই নাড়াতে পারে। বরং এর ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়—গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উচিত কি শুধু প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানে থাকা, নাকি বিশ্ব রাজনীতিতে গণতন্ত্র রক্ষায় নতুন কৌশল খোঁজা?

তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, ইকোনমিস্ট

সম্পর্কিত