কবির কাটা মাথা কাপড় শুকানোর তারে ঝুলিয়ে রেখেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা

কবির কাটা মাথা কাপড় শুকানোর তারে ঝুলিয়ে রেখেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা

২৩ মার্চ!

পাকিস্তান দিনটিকে ‘পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে উদ্‌যাপন করে। এই উদ্‌যাপনের কারণ কিন্তু একজন বাঙালি রাজনীতিবিদ। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে তিনি তুলে ধরেছিলেন ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব। যেটিকে ইতিহাসে ‘লাহোর প্রস্তাব’ হিসেবেও বলা হয়।

তবে ১৯৭১ সালে এসে মার্চের ২৩ তারিখ আবেদন হারিয়েছিল বাঙালিদের কাছে। পাকিস্তান দিবসে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা উদ্‌যাপন করেছিল ‘প্রতিরোধ দিবস’। ঢাকাসহ সমগ্র দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের পতাকা। পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্র কৌশলে সেদিন অধিবেশন সমাপ্তির মুহূর্তে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজায়নি। বিশেষ অনুষ্ঠান দিয়ে অধিবেশন সমাপ্তির সময়সূচি পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাত ১২টার পর। ততক্ষণে ক্যালেন্ডারের পাতায় ২৪ মার্চ শুরু হয়ে গেছে। প্রতিরোধ দিবস শেষ। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজানোই যায় তখন।

বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ তারিখ ছিল ২৩ মার্চ। সেদিনই ঢাকা থেকে বের হওয়া নারী বিষয়ক পত্রিকা বেগম–এ এক তরুণ নারী কবির আগুনঝরা এক কবিতা ছাপা হলো। কবির নাম মেহেরুন্নেছা…

জনতা জেগেছে..

মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা দুরন্ত দুর্বার,

সাত কোটি বীর জনতা জেগেছে এই জয় বাংলার।

পাহাড়, সাগর নদীপ্রান্ত জুড়ে—

আমরা জেগেছি নব চেতনার ন্যায্য নবাঙ্কুরে।

আমরা দিয়েছি সব- ভীরুতাকে পূর্ণ জলাঞ্জলি-

কায়েমি স্বার্থবাদীর চেতনা আমরা দিয়েছি নাড়া

জয় বাঙলার সাত কোটি বীর, মুক্তি সড়কে খাড়া।

গণতন্ত্রের দীপ্ত শপথ কণ্ঠে কণ্ঠে সাধা-

মিরপুরে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী বিহারি মোহাজেররা ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছিল। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি
মিরপুরে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী বিহারি মোহাজেররা ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছিল। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

কবি মেহেরুন্নেছা মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে ঢাকার সাহিত্য বলয়ে খুব বেশি পরিচিত যে ছিলেন, এ কথা বলা যাবে না। তবে একটু একটু করে তাঁর শানিত কলম পরিচিত হয়ে উঠছিল...‘মেহেরুন্নেছা মেয়েটা মন্দ লেখে না’—ঢাকার উন্নাসিক এলিট কাব্যাঙ্গনে এমন পরিচিতিই ছিল তাঁর। লিখতে খুব ভালোবসতেন তিনি। যদিও অভাবের সংসার। কলকাতার খিদিরপুরে জন্ম ও বেড়ে ওঠার পর ১৯৫০ সালে পুরো পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসা মেহেরুন্নেছা তখন অনেকের কাছেই ‘মোহাজের’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। ঢাকার মিরপুর থেকে প্রতিদিন বাসে করে, রিকশায় চেপে কিংবা হেঁটে ঢাকার এলিট সাহিত্য বলয়ে ঢুঁ মারাটাকে মেহেরুন্নেছা নিজের অস্তিত্বের অংশই মনে করতেন। ক্যানসারে মৃত বাবার অনুপস্থিতিতে দুই ছোট ভাই আর বিধবা মায়ের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার সুকঠিন দায়িত্বটাও ছিল তাঁর কাঁধেই মূলত। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আগেই। তাঁর ছিল আলাদা সংসার।

সেই মেহেরুন্নেছাই পাকিস্তানিদের দোসর বিহারিদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। এতটাই যে ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর পর নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করতেও বাঁধেনি তাদের।

কলকাতার খিদিরপুরে ১৯৪২ সালে জন্ম মেহেরুন্নেছার। কলকাতায় তাদের সহায়-সম্পত্তি খুব বেশি না থাকলেও মোটামুটি সচ্ছলতা ছিল তাদের। বাবা আবদুর রাজ্জাক ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কলকাতার কালীবাজারে একটি কাপড়ের দোকান ও ভবানীপুরে ছিল তাঁর একটি জুতার দোকান। কিন্তু ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় সেই দোকান দুটি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেওয়া হয়। মোটামুটি স্বচ্ছল জীবনযাপন করা পরিবারটি তখন পথে বসে যায়। কলকাতায় টিকে থাকতে আবদুর রাজ্জাক কয়লার দোকানে কাজ নিয়েছিলেন। মেহেরুন্নেছাকে তাই খুব বেশি পড়াশোনা করাতে পারেননি। ১৯৫০ সালের দিকে কলকাতায় বৈরি পরিবেশে টিকতে না পেরে ঢাকায় চলে আসেন তারা। কিন্তু এখানেও তাদের ভাগ্য সহায় হয়নি। ঢাকায় বিভিন্ন কল–কারখানায় শ্রমিকের চাকরি করেই কাটছিল সংসার। মেহেরুন্নেছা সেই ছোটবেলা থেকেই বাবাকে সাহায্য করতে নানা ধরনের কাজে লেগে পড়েন। মেধাবী ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা খুব বেশিদূর করতে পারেননি। কিন্তু পড়া ও জানার আগ্রহ থেকে লেখালেখিটা ভালোই রপ্ত করে ফেলেছিলেন। কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন খুব। কবিতা ছিল তাঁর মানসিক তৃপ্তি।

যদিও মধ্য পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে শুধু লেখালেখি করে যাওয়ার বিলাসিতা মেহেরুন্নেছা কখনোই দেখাতে পারেননি। বিভিন্ন জায়গায় খুটিনাটি কাজ করেই সংসার চালাতে হতো তাঁকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকাটাও একটা বড় বাঁধা ছিল তাঁর সামনে। সেই সময় ফিলিপস রেডিও কোম্পানিতে কাজ একটা জুটিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাতে লেখালেখির সময় তিনি পাচ্ছিলেন না তেমন। ফিলিপসে সে সময় ইংরেজি ও উর্দুতে অভ্যন্তরীণ পত্রিকা ছাপা হতো। তিনি যোগ দিয়ে বাংলা সংস্করণ প্রকাশ করতে রাজি করিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষকে। সেই চাকরির পাশাপাশি পাকিস্তানি খবর, দৈনিক পাকিস্তান এমনকি সংগ্রাম পত্রিকাতেও প্রুফ রিডার বা সম্পাদনা সহকারীর পার্ট টাইম কাজ করতেন। অনুলিখনের কাজ করেছেন আমেরিকান সেন্টারেও। ‘রানু আপা’ নামে একটা কলামও লিখতেন। ওই সময় সেই ‘রানু আপা’ কলাম আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। তবে প্রচণ্ড পরিশ্রমের পরও সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন তিনি।

রাজনৈতিকভাবে বরাবরই সচেতন ছিলেন মেহেরুন্নেছা। মধ্য ষাটের বিভিন্ন আন্দোলনে মিছিলে হেঁটেছেন তিনি। এর আগেও মধ্য পঞ্চাশে কিশোরী বয়সে তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা দাবি নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। সে সময় ‘ইত্তেফাক, ‘মাসিক মোহাম্মদী’ ‘কাফেলা’ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতো। কাফেলা পত্রিকায় ‘রাজবন্দী’ শিরোনামের একটি কবিতা লিখে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরে পড়ে যান। সে সময় তাকে গ্রেপ্তার করা না হলেও পরিবারকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। ওই সময় বাবা আবদুর রাজ্জাকের অনুরোধে কিছু দিন রাজনৈতিক লেখালেখি বন্ধ রাখেন মেহেরুন্নেছা।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জড়িয়ে পড়েছিলেন কর্মী হিসেবে। মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের ডি ব্লক, ১২ নম্বর রোডের বাড়িতে থাকতেন। সেখানেই গণঅভ্যুত্থানের সমর্থনে গঠন করেছিলেন মিরপুর অ্যাকশন কমিটি। বিহারি অধ্যুষিত এলাকায় এই অ্যাকশন কমিটি তাঁর জন্য ছিল বড় ঝুঁকিই। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বাঙালির প্রতিরোধ দিবসেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। নিজ বাড়িতে তুলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ২৩ মার্চেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লেখক সংগ্রাম শিবির আয়োজিত বিপ্লবী কবিতাপাঠের আসরে হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবীরসহ অন্যান্য কবিদের সঙ্গে মেহেরুন্নেছাও স্বরচিত কবিতাপাঠে অংশ নেন। ড. আহমদ শরীফ সেই আসরে সভাপতিত্ব করেছিলেন। লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার জন্য যা ছিল যথেষ্টই।

মুক্তিযুুদ্ধের প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুন্নেছা। ছবি: সংগৃহীত
মুক্তিযুুদ্ধের প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুন্নেছা। ছবি: সংগৃহীত

২৭ মার্চ, ১৯৭১।

তাঁর মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বাড়িতে হামলা চালায় স্বাধীনতাবিরোধী বিহারি সন্ত্রাসীরা। জানা যায় মিরপুরের সে সময়ের কুখ্যাত বিহারি সন্ত্রাসী নেহাল গুণ্ডা, হাসিব হাশমী, আখতার গুণ্ডা ও আব্বাস চেয়ারম্যান দলবল নিয়ে মেহেরুন্নেছাদের বাড়ি আক্রমণ করে। দুই ভাইকে প্রথমে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের যে বিবরণ পাওয়া যায়, সেটি নারকীয়। বিহারি গুণ্ডারা মেহেরুন্নেছা ও তাঁর মায়ের সামনেই দুই ছেলেকে জবাই করে হত্যা করে। সেই দৃশ্য দেখে মা মূর্চ্ছা গেলে তাঁকে ওই অবস্থাতেই হত্যা করা হয় গলা কেটে। মেহেরুন্নেছাকেও গলা কেটে হত্যা করা হয়। শুধু তা–ই নয়, মেহেরুন্নেছার কাটা মাথা চুলসহ কাপড় শুকানোর তারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। জানা যায় বিহারি সন্ত্রাসীরা যখন বাড়ি আক্রমণ করে তখন মেহেরুন্নেছার মা পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে মন গলেনি নরঘাতকদের। মেহেরুন্নেছা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম নারী শহীদ।

২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসে মেহেরুন্নেছার সক্রিয়তা মিরপুরের পাকিস্তানপন্থী বিহারিদের ক্ষুব্ধ করেছিল। তখনই হিট লিস্টে নাম উঠে যায় তাঁর। ২৫ মার্চ ঢাকায় সেনাবাহিনী নামল। শুরু হলো গণহত্যা। সেই সময় মিরপুর এলাকা মূল ঢাকা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্নই ছিল। ২৫ মার্চের কালরাতে মিরপুরে সেনাবাহিনী সেভাবে অভিযান চালায়নি। অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হওয়ার কারণেই হয়তো। ওই সময় ঢাকার কেন্দ্র থেকে অনেকেই মিরপুরে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে মেহেরুন্নেছা ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের বাঙালি পরিবারগুলোর জন্য মিরপুর মোটেও নিরাপদ ছিল না বিহারী মোহামেজরদের কারণেই। মেহেরুন্নেছাকে অনেকেই খবর পাঠিয়ে দ্রুত মিরপুর ত্যাগের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু নানা কারণেই তাঁর পক্ষে পুরো পরিবার নিয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরিণাম এক প্রতিভাধর কবির সপরিবারে অসময়ে চলে যাওয়া।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা আছে কবি মেহেরুন্নেছার কবিতার পাণ্ডুলিপি
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা আছে কবি মেহেরুন্নেছার কবিতার পাণ্ডুলিপি

জীবদ্দশায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্যপাতায় টুকটাক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে যেতে পারেননি। তাঁর যা কিছু কাব্য স্মৃতি আছে, সেগুলো বিভিন্ন সংকলনে সংগৃহীত হলেও কোনো একক কাব্যগ্রন্থ তাঁর নেই।

নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ২৪ বছর পর ১৯৯৫ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে কবি মেহেরুন্নেছাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হয় স্মারক ডাকটিকিটের মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ একজন নারী কবি ও সাহিত্যিক। তাঁকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণে এই দীর্ঘসূত্রতা সত্যই অবাক করার মতো ব্যাপার।

সূত্র: শিক্ষক বাতায়ন ওয়েবসাইট ও বিভিন্ন স্মৃতিচারণমূলক লেখা

সম্পর্কিত