বর্তমানে যা ঘটছে তা নিঃসন্দেহে একটি যুগের অবসান। এটি আসলে দুটি যুগের মধ্যকার একটি উপ-যুগ এবং একটি মূল যুগের ইতি। এই যুগের সমাপ্তি হলো বিশ্ব ব্যবস্থার ওপর পশ্চিমা আধিপত্যের অবসান। এই আধিপত্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলোর মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যের হাতে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু এই আধিপত্য মূলত ১৭৫০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় ২৫০ বছর ধরে স্থায়ী ছিল। আপনি এর সঙ্গে আরও একটি ২৫০ বছরের সময়কাল যোগ করতে পারেন, যা ১৫০০ সালে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার দিয়ে শুরু হয়েছিল।
এই আধিপত্য বিস্তার শুরু হয়েছিল কলম্বাস এবং ভাস্কো দা গামার সমুদ্রযাত্রার মাধ্যমে। ইউরোপ থেকে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় দিকেই এই সমুদ্র যাত্রাগুলো ইউরোপীয় বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের সূচনা করে। তবে পুরোনো বিশ্বে ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। মানুষ মূলত পুরোনো বিশ্বের রোগগুলোর কাছে পরাজিত হয়েছিল। পুরোনো বিশ্বে এশিয়া সহজে ইউরোপের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। প্রায় ২৫০ বছর ধরে ইউরোপীয় শক্তিগুলো তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৯ শতকে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ইউরোপীয়দের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
আমরা সবাই এমন একটি যুগে বড় হয়েছি যেখানে ধরে নেওয়া হতো যে, বিশ্ব পরিচালনা করে ইউরোপ এবং ১৯৪৫ সালের পর থেকে ইউরোপ ও আমেরিকা। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৫০ সালে যদি আপনি বৈশ্বিক পরিস্থিতি দেখেন, তাহলে দেখবেন, বিপুল সম্পদ, আর্থিক ক্ষমতা, প্রযুক্তিগত ক্ষমতা এবং পারমাণবিক যুগের সবকিছুই এই পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বের হাতে ছিল। এগুলো তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নেরও সঙ্গে ছিল। কিন্তু চীন, ভারত, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা সেখানে ছিল না।
বেশ মজার ব্যাপার হলো, পশ্চিমা বিশ্ব কেবল ক্ষমতার দিক থেকেই নয়, জনসংখ্যার দিক থেকেও তাদের শিখরে পৌঁছেছিল। আমাদের মনে রাখা উচিত, তখন আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় ইউরোপের জনসংখ্যা আনুপাতিক হারে অনেক বেশি ছিল। তখন ইউরোপের জনসংখ্যা আফ্রিকা ও তার প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি ছিল। এখন তা ওই দুই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। আমি ১৯৫৪ সালে ইউরোপের নেতৃত্বাধীন একটি বিশ্বে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, তারপরেও এটি যে একটি পশ্চিমা-নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না।
আমার মনে হয়, আমরা এখন শত শত উপায়ে দেখতে পাচ্ছি যে সেই যুগ শেষ হয়ে গেছে। এটি সম্ভবত ২৫ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তখনই তা তেমনভাবে বোঝা যায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, যখন একটি নতুন বহু মেরুর বিশ্ব (multipolar world) উদ্ভূত হচ্ছিল—বিশেষ করে চীনের উত্থান এবং কেবল চীনের নয়, ভারত ও অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে; তখন আমেরিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু দাবি করে বসে। তারা বলছিল, এটি কেবল একটি পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বই নয়, বরং আমেরিকা এখন বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি। অর্থাৎ এটি একটি এককেন্দ্রিক বিশ্ব (unipolar world) হয়ে উঠেছে।
এটি ছিল একটি চরম ভুল ধারণা। প্রচণ্ড ঔদ্ধত্য, যা ছিল খুবই ভুল সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত। কারণ, ওয়াশিংটনের লোকেরা খুব বেশি বুদ্ধিমান নয়। আমি আপনাকে সম্পূর্ণ নিশ্চিত করতে পারি, তারা সত্যিই জানে না তারা কী করছে। কিন্তু যাই হোক না কেন, তারা তাদের এককেন্দ্রিকতার দাবি করছিল ঠিক সেই সময়ে, যখন পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বের ইতি ঘটছিল। এর ফলে গত ২৫ বছর ধরে বাস্তবতা ও ঔদ্ধত্যের মধ্যে একটি সংঘাত চলছে।
আমেরিকা এবং ইউরোপের অবশিষ্ট অংশ–যার মধ্যে ব্রিটেন সবচেয়ে বেশি ভুল ধারণায় আছে, বাস্তবতা ও তাদের নিজেদের ধারণার মধ্যে ব্যবধান সবচেয়ে বেশি। তারা মনে করে যে, পশ্চিমারাই বিশ্বকে পরিচালনা করে। তারা ভাবে, আমরা পুতিন, শি জিনপিং, মোদি, লুলা–যাকে খুশি তাকে বলতে পারি কী করতে হবে, কারণ আমরাই পশ্চিম। আমরাই আমেরিকা।
কিন্তু বিশ্ব যে মৌলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই মৌলিক পরিবর্তন সম্পর্কে দুটি বিষয় উল্লেখ করার মতো:
প্রথমত, আমি এটিকে খুবই অবাক করা এবং সাধারণ ধারণার বিপরীত মনে করি। কারণ আমরা পশ্চিমে একটি বোকাদের স্বর্গে বাস করি। যদি আপনি আমেরিকার (প্রায় ৩৪ কোটি), ইউরোপীয় ইউনিয়নের ও যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা যোগ করেন, তাহলে এই উত্তর আটলান্টিক বিশ্বের মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৯০ কোটি। এটি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০% এর সামান্য বেশি। যদি আপনি এর সঙ্গে জাপান, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং আরও কয়েকটি স্থান যোগ করেন, তাহলে এটি প্রায় ১২% হয়।
এই সংখ্যাগুলো আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানান দেয়। আজকের বিশ্বে, যেখানে প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট সর্বত্র, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র নয়টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে বিশ্বের মাত্র ১২% মানুষ কীভাবে মনে করতে পারে যে, তারা এখনো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে?
আমরা যা কিছু দেখছি, তার মূল কারণ এটিই: আমরা আমাদের ইংরেজিভাষী পশ্চিমা মিডিয়া এবং রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ জগতে একটি ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে বাস করছি। যেখানে ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস, লন্ডন, বার্লিন, প্যারিস মনে করে যে তারাই বিশ্বের কেন্দ্র। আমি অকপটে বলছি, এক শ বছর আগে এটি ভালো-মন্দ উভয় দিক মিলিয়ে সত্যি ছিল। কিন্তু এখন আর সে দিন নেই। এমনকি এর ধারে কাছেও নেই।
বর্তমানে আমাদের দুটি প্রধান জোট আছে। একটি হলো ব্রিকস (BRICS), যার সদস্য দেশগুলোর জনসংখ্যা এবং জিডিপি প্রায় বিশ্বের অর্ধেক। এই জোটটি মূলত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পাঁচটি দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এখন এখানে মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইন্দোনেশিয়াও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি একটি বৈশ্বিক সংস্থা, যা ব্রাজিল থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এতে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া এবং এশিয়া রয়েছে।
এছাড়াও আছে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO), যা মূলত একটি এশিয়ান-ইউরেশিয়ান গ্রুপ হিসেবে শুরু হয়েছিল। এতে রয়েছে চীন, ভারত, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের মধ্যে চারটি–কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান। এর সঙ্গে বেলারুশ, ইন্দোনেশিয়া এবং আরও কিছু অংশীদার যুক্ত হয়েছে। এটি একটি এশীয় জোট। এই দুটি জোট একে অপরের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
দুটি জোটেরই জনসংখ্যা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক, যদিও তাদের সদস্যপদ হুবহু এক নয়, কিন্তু তাদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা আছে। প্রথমত, তারা বিশ্ব অর্থনীতির দ্রুত বর্ধনশীল অংশ। এবং দ্বিতীয়ত, তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে কোনো নির্দেশ শুনতে চায় না। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা কয়েক মাস আগে সবচেয়ে ভালোভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কোনো সম্রাটের দরকার নেই।’
অর্থাৎ, তাদের মূল কথা হলো, তারা মার্কিনবিরোধীও নয়। এটি একটি মৌলিক ভুল বোঝাবুঝি। তারা আসলে স্বাভাবিক সম্পর্ক চায়। আমি বছরের পর বছর ধরে তাদের সবাইকে বলে আসছি যে আপনারা আমেরিকাকে বিশ্বাস করতে পারেন না। কারণ তারা তাদের ভ্রান্ত ধারণায় আজ পর্যন্ত আধিপত্যের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এটি কোনো প্রচার নয়। আমেরিকার ঘোষিত নীতি হলো যাকে তারা ‘প্রাইমেসি’ বা সামরিক ভাষায় ‘ফুল স্পেকট্রাম ডমিন্যান্স’ বলে। এই ধারণা নিয়েই আমি ২০ বছর ধরে ওয়াশিংটনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে আপনারা পাগল। কারণ আমেরিকা একা। আপনারা বিশ্বের মাত্র ৪.২%। আমরা এখন আর ১৯৪৫, ১৯৫০, এমনকি ১৯৯০ সালে নেই।
সঠিকভাবে পরিমাপ করলে চীনের অর্থনীতি মার্কিন অর্থনীতির চেয়ে বড়। এটি কোনো কল্পকথা নয়, এটি বাস্তবতা। শিল্প সক্ষমতার দিক থেকেও চীন অনেক বড়। আর আমি বছরে কয়েকবার চীনে যাই। সেখানে দেখতে পাই, চীন অনেক প্রযুক্তিতে আমেরিকার চেয়ে এগিয়ে। সব কিছুতে না হলেও এমন অনেক প্রযুক্তিতে, যা বিশ্বের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
আগামী ২০ বছর ধরে চীন বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে। তারা সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনেও সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করবে, কারণ বিশ্বে তাদের কার্যত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
তারা শূন্য কার্বন নিঃসরণকারী সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণেও আধিপত্য বিস্তার করবে, যা গ্রিস এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারাই এই জাহাজগুলো তৈরি করে। আমেরিকা বা ইউরোপ এসব জাহাজ তৈরি করে না, বা করলেও অনেক কম সংখ্যায় করে। এরকম প্রযুক্তির একটি দীর্ঘ তালিকা রয়েছে।
মূল কথা হলো, আমাদের নিজেদের বোঝা এবং মহত্ত্বের ভ্রান্ত ধারণা, যা কয়েকশ বছরের প্রকৃত ক্ষমতা থেকে এসেছে। এগুলোকে নতুন করে সাজানো উচিত। এই ক্ষমতা আমার মতে, সুন্দরভাবে বা দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহৃত হয়নি। তাই, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, আমি এটিকে খুব আকর্ষণীয় কিছু মনে করি না।
একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি সারা জীবন অ্যাডাম স্মিথের নীতি অনুসরণ করেছি। কারণ তিনি ছিলেন একজন প্রকাশ্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘মার্কিন উপনিবেশগুলো ছেড়ে দাও এবং তাদের সঙ্গে বাণিজ্য কর। তাদের মালিকানা রাখার দরকার নেই। শুধু তাদের সঙ্গে বাণিজ্য করলেই চলবে।’ এটি একটি খুব ভালো দৃষ্টিভঙ্গি।
যারা বলেন, ‘কমপক্ষে ইউরোপ তার জ্ঞান ও বিজ্ঞান ছড়িয়েছে’, তাদের জন্য বলছি: হ্যাঁ, ইউরোপ তা করেছে। কিন্তু সাম্রাজ্য, যুদ্ধ, বিজয়, ইচ্ছাকৃত দুর্ভিক্ষ এবং আরও অনেক কিছুর মাধ্যমে এটি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তারা বাণিজ্য, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে মানবিক সম্পর্কের মাধ্যমেও তা করতে পারতো।
এখন আমাদের বিশ্ব অনেক বেশি সমতাপূর্ণ, বিশেষ করে সাক্ষরতা, শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং শিল্প সক্ষমতার দিক থেকে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমা বিশ্বকে ছাড়িয়েও গেছি। কিন্তু তারপরেও পশ্চিমারা এই ধারণায় মগ্ন যে তারা পশ্চিমা-নেতৃত্বাধীন বিশ্বকে রক্ষা করছে, যদিও সেই যুগ শেষ হয়ে গেছে।
**চলবে...