সংশোধিত আরপিও

রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকার হরণ, না আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ

রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকার হরণ, না আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ
ছবি: চরচা

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও-তে বড় পরিবর্তন এনেছে। পরিবর্তনের মধ্যে আছে–ইভিএম ব্যবহার বাতিল, ‘না ভোট’ পুনর্বহাল, প্রার্থীদের দেশি-বিদেশি আয় ও সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশের বাধ্যবাধকতা ও পলাতক আসামিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা। নতুন সংশোধনীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া পলাতক আসামিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বলে জানানো হয়েছে। এসব সংশোধনী নিয়ে তেমন কোনো মতপার্থক্য বা আপত্তি নেই রাজনৈতিক দলগুলোর।

কিন্তু গোল বাধিয়ে দিয়েছে জোটের প্রার্থীদের প্রতীকের বিষয়টি। নতুন সংশোধনীতে বলা হয়েছে–কোনো দল জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও নিজেদের প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে হবে। অর্থাৎ বড় দলের সঙ্গে জোট বেধে তাদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল। আগে প্রতীক পছন্দের বিষয়টি দলের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হতো। জোটভুক্ত দলগুলো ইচ্ছা করলে নিজের বা বড় শরিকের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের আসরে অবতীর্ণ হতে পারত। এতে ওই বড় দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভোট তার পক্ষে পেতে সুবিধা হতো।

সমস্যাটা এখানেই। ছোট শরিকদের যেমন বড়র ভোট পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে, তেমনি বড় শরিকের ছোট দলের বড় নেতাদের জিতিয়ে আনার একটা দায় ও তাগিদ থাকে। সেই জায়গা থেকে বিএনপির মতো বড় দল এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ গত শুক্রবার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আদেশের (নতুন আরপিও) জন্য যেসব সংশোধনী এসেছে, তার অধিকাংশের সঙ্গে তারা একমত। কিন্তু প্রতীকের বিষয়ে তারা সম্মত হননি। তার বক্তব্য, সুষ্ঠু রাজনীতির স্বার্থে, নির্বাচনের স্বার্থে এটা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনে ও সরকারের কাছে তারা এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিতে পারেন।

সালাউদ্দিন আহমেদের এই বক্তব্যে জোট সঙ্গী সম্ভাব্য ছোট দলগুলোর প্রতি বিএনপির দায় ও তাগিদের বিষয়টি স্পষ্ট। ছোট শরিকেরাও বিএনপির মতো বড় দলের কাছে এই ধরনের দায়িত্বশীলতা আশা করে। আবার এই দায় ও তাগিদের মধ্যে আরেক বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। অনেক ছোট দলই এবারই প্রথম নির্বাচন করছে। এর আগের (২০২৪) নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। আবার ২০১৮ সালে তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতৃত্বে জোট বেঁধে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিল। এমনকি জামায়াতে ইসলামীও ছিল সেই জোটে। আর সবাই জানে, ভোট ছাড়া দলীয় প্রতীক তেমন একটা ব্যবহার হয় না। ফলে ছোট দলের নির্বাচনী প্রতীক মানুষের পক্ষে মনে রাখা কঠিন।

সেজন্য গণমাধ্যমের কল্যাণে ছোট দলের অনেক নেতাকেই হয়ত দেশের মানুষ চেনে, তারা কোন দলের এটাও জানে। কিন্তু ওই দলের প্রতীক কোনটা তা সবাই জানে না, এটা হলফ করেই বলা যায়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, সরকার ১৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যে নির্বাচনের সব কাজ শেষ করতে চায়। তার অর্থ হলো–দলগুলোর কাছে নির্বাচনের জন্য সময় আছে তিন মাসের একটু বেশি। এত অল্প সময়ে দলীয় প্রতীক ভোটারদের কাছে পরিচিত করানো খুবই কঠিন। এ বাস্তবতা মেনে নেওয়াই ভালো।

জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)-এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ সমকাল পত্রিকাকে বলেছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তকে তিনি নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন এটা কাদের চাপে, কী জন্য করেছে, সেটা সরকারকেই বলতে হবে। এ রকম কাজ তো শেখ হাসিনা করতেন। জোটবদ্ধ নির্বাচনে প্রতীক উন্মুক্ত থাকা দরকার। ববি হাজ্জাজের দলের প্রতীক সিংহ–এটা আসলে কতজন জানেন! বিএনপি জোট থেকে ঢাকা–১৩ আসনে তাকেই প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি নিজেও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী। কিন্তু তাতে বাদ সাধল সরকারের সংশোধিত আরপিও।

ছবি: চরচা
ছবি: চরচা

ববি হাজ্জাজ যেমন খোলামেলা, অনেকেই তেমনটি নন। কারণ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সুপারিশ ও সরকারের সম্মতি ছোট দলগুলোকে প্রকাশ্যে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তাদের যোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। কারণ কেউ যদি বলেন, তারা বড় দলের প্রতীক ব্যবহার করতে চান, তাহলে এ প্রশ্নও উঠবে যে আপনাদের নিবন্ধন ও প্রতীক নেওয়ার কী দরকার ছিল? আর বড় দলের প্রতীক ব্যবহার করতে হলে ওই দলে যোগ দিন। এসব যুক্তি কিন্তু পাবলিক খায় ভালো। যারা রাজনীতি করেন তারা বিষয়টি সবচেয়ে ভালো জানেন।

সেজন্য নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, এবারও ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করতে চান। তবে নিয়মের বেড়াজালে একেবারেই সম্ভব না হলে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা তার হতাশারই প্রকাশ বলে মনে হয়। অথচ এই মাহমুদুর রহমান মান্না বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বহু দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) প্রতীক গরুর গাড়ি। দলের চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ এবার ঢাকা থেকে নির্বাচন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নগর এলাকার প্রার্থী হয়েও কেতাদুরস্ত আন্দালিবের কুছ পরোয়া নেই গরুর গাড়ি নিয়ে। তিনি গরুর গাড়ি নিয়ে নির্বাচন করতে চান। তবে সুযোগ থাকলে জোটের প্রতীক ধানের শীষ নিতে আগ্রহী। দুই নেতার কথাতে পরিষ্কার যে, তাদের প্রথম পছন্দ ধানের শীষ, নিজের দলের প্রতীক নয়। এটাই নির্বাচনী বাস্তবতা। আসলে ভোটের বাজারে রাজপথ ও ভোটারের মনের দূরত্ব যোজন যোজন।

আবার এটাও মানতে হবে, জোট সঙ্গী হয়েও নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করাটা মর্যাদার এবং আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার একটা বড় সুযোগ। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের যেমনটা মনে করেন–দলীয় প্রতীক দলের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই নিবন্ধিত দলগুলোর নিজস্ব পরিচয়ে যাওয়াই ভালো। আর এই কাজটি কখনো না কখনো শুরু করতেই হতো। কাউকে এ কাজে প্রথম হতে হতো। পরীক্ষার্থীদের মতো, ‘আরেকটু সময় পেলে আরও ভালো প্রস্তুতি নিতে পারতাম’–বলার সুযোগ রাজনীতিতেও কী খুব দরকার?

তবে এখানেও একটা বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। আর সেটা হলো জোট সঙ্গী দলগুলোর মধ্যে যারা নিবন্ধিত তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। আবার অনিবন্ধিত শরিকেরা বড় ও জনপ্রিয় শরিকের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে। বাংলাদেশ আগামী আরও অনেক বছর জোট রাজনীতির চক্র থেকে বেরোতে পারবে, এমন আশা কম। ফলে জোটের অংশ হয়ে নির্বাচনে জিতে আসার সুযোগ তৈরি করার জন্য ছোট দলগুলো নিবন্ধনে উৎসাহী নাও হতে পারে। অন্যদিকে বড় শরিকও চাইবে না, তাদের প্রতীক ছাড়াই কেউ জিতে আসুক বা তার নিজস্ব পরিচয় তৈরি হোক। ফলে এ বিতর্ক আরও অনেক দিন চলতে থাকবে। এবং গণতন্ত্রে সেটাই কাম্য।

সেলিম খান: ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, চরচা।

সম্পর্কিত