ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ক্রিকেট যতোটা আলোচনায়, তার চেয়ে অনেক বেশি আলোচনায় মিরপুর স্টেডিয়ামের ‘কালো মাটি’র উইকেট। গ্যালারি থেকে বা টেলিভিশন পর্দায় মিরপুরের উইকেটের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে সেটির ওপরে যেন কয়লা লেপে দেওয়া হয়েছে! বাংলাদেশের ক্রিকেট যাঁরা অনেক দিন ধরে অনুসরণ করেন, তাদের কাছে এমন ‘কালো’ পিচের রহস্য মোটামুটি পরিস্কার। উইকেটটা তৈরিই হয়েছে বাড়তি সুবিধা নিতে। কালো রঙের উইকেট থেকে অনিয়মিত বাউন্স কিংবা টার্ন তুলে নেওয়া। এমন উইকেট বানালে সফরকারী দলগুলোর ওপর যে আধিপত্য বিস্তার করা যায়, তা মোটামুটি পরীক্ষিতই। এমন উইকেট বানিয়েই অতীতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো দলগুলোকে নাকানি–চুবানি খাওয়ানো গেছে। গত কয়েক মাস ধরে ৫০ ওভারের ফরম্যাটে বাংলাদেশ দলের যে অবস্থা, তাতে ওই ধরনের কিছুই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দরকার। নয়তো সরাসরি ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলাটাই যে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে!
কিছু দিন আগে বিসিবির সঙ্গে দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটেছে শ্রীলঙ্কান কিউরেটর গামিনী সিলভার। লঙ্কান ভদ্রলোক ‘সুবিধা নেওয়ার’ উইকেট বানাতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অতীতের অনেক সাফল্যের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে লঙ্কান ভদ্রলোকের নাম। আবার বিদেশের মাটিতে ধারাবাহিক ব্যর্থতার জন্যও গামিনী সাহেবের তৈরি করা উইকেটকে দোষারোপ করা হয়। বলা হয় মিরপুরের উইকেটে খেলে খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অভ্যাস এতটাই খারাপ হয়ে যায়, যে একটু গতিময়, বাউন্স সমৃদ্ধ ভালো উইকেটে খেলতে গেলেই সমস্যায় পড়েন তারা। এই সমস্যা থেকে খেলোয়াড়দের বের করে আনতেই অস্ট্রেলিয়া থেকে টমি হেমিংকে আনা। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার এই হেমিং পার্থ টাইপের বাউন্সি উইকেট বানিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট বদলে দেবেন, কথাবার্তা এমনই ছিল। তবে কাল ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে হেমিংয়ের তৈরি কালো মাটির উইকেট দেখে সবাই বেশ অবাক।
বিশ্বকাপ খেলা যেখানে শঙ্কায়, তখন সেটি নিশ্চিত করতে বিসিবি যদি এমন উইকেট তৈরি করে, তাতে কারও কিছু বলার নেই। প্রেমে আর যুদ্ধে যেকোনো কৌশলই নেওয়া যায়। কিন্তু দেশের ক্রিকেটের সার্বিক উন্নতি যদি মাথায় থাকে, তাহলে এমন উইকেট, যেটি বিদেশি দলের কাছে মনে হবে, ‘বিরাট রহস্য’, যে উইকেটে বাংলাদেশি স্পিনারদের একেক জনকে মনে হবে শেন ওয়ার্ন, মুশতাক আহমেদ কিংবা সাকলায়ের মুশতাক, তাতে খেলে কী লাভ, সেই আলোচনা থেকেই যায়। মিরপুর স্টেডিয়ামে এমন উইকেটে অতীত দিনে বিদেশি দলগুলোর সঙ্গে বীরত্বগাথার স্মৃতিও ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে আলোচনা উসকে দেয়, এসব জয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কী লাভ হয়েছে!
ঘরের মাঠে দাপট দেখানোর ব্যবস্থা করে ম্যাচ জিতে আসলে আখেরে দেশের ক্রিকেটের কোনো লাভ হয়নি কখনোই। এই মিরপুরেই ২০২১ সালে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়াকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়ে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বিশ্বকাপে শিরোপা জিতেছিল সেই অস্ট্রেলিয়া আর দেশের মানুষের চোখে ভ্রান্তি তৈরি করা বাংলাদেশ খেলেছিল যাচ্ছেতাই ক্রিকেট। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষেও হারতে হয়েছিল দলকে। অস্ট্রেলিয়ার পরপরই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও একই ধরনের উইকেটে খেলে এসেছিল সিরিজ জয়। কিন্তু আসল জায়গায় লবডঙ্কা।
কাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ২০৭ রানে গুটিয়ে গিয়ে ৭৪ রানের বিশাল জয়, অতীতের সেই জয়গুলোকে খুব করে মনে করাচ্ছিল। যতোই বিশ্বকাপ নিয়ে শঙ্কা থাক আর প্রেম ও যুদ্ধের সেই উদাহরণ টানা হোক, যে জয় ‘আয়োজন করে’ পাওয়া, তাতে আনন্দের পরিমাণ কমই থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাল সকাল থেকেই কালো মাটির উইকেট নিয়ে সমালোচনা, সেটি অতীতের কথা মনে করেই। এতদিন কালো মাটির ওপরই শুকনো বা সবুজ ঘাস রেখে দিয়ে উইকেটে গতি আনার চেষ্টা হয়েছে, কাল সেই চেষ্টাটাও হয়নি।
শনিবার সারা দিন ঢিমে ক্রিকেট দেখল ক্রিকেটপ্রেমীরা। এমনিতেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে আরব আমিরাতে ওয়ানডে সিরিজে ৩–০ ব্যবধানে সিরিজ হেরে এসেছে বাংলাদেশ। খেলাটার প্রতি সাধারণের আগ্রহের গ্রাফ পড়তির দিকে। সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড বিরক্ত ক্রিকেটারদের মাঠের পারফরম্যান্সে। এরমধ্যে উইন্ডিজের বিপক্ষে এমন ‘ব্যবস্থা করে’ পাওয়া জয়টা মানুষের মধ্যে স্বস্তির বদলে তৈরি করছে বিরক্তি।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা জয়ের নয়—বাংলাদেশ ক্রিকেট কোন পদ্ধতিতে এগিয়ে যাবে, সেটাই আসল। প্রতিপক্ষকে হারানোর শর্টকাট পথ হয়তো সাময়িক স্বস্তি দেয়, কিন্তু দেশের ক্রিকেটকে টেকসই ভিত্তি দেয় না। আজকের ‘কালো মাটি’র উইকেটে জয়ের উল্লাস আগামী দিনের বাস্তবতায় মিশে যাবে হতাশায়, এমন ঘটনা মোটেও নতুন কিছু নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটে।