চরচা প্রতিবেদক

৫৫ বছর পেরিয়ে গেছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের সেই অবিস্মরণীয় বিকেলটি কেমন ছিল? ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পন বাঁধভাঙা আনন্দের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল ঢাকার মানুষের মধ্যে। কিন্তু অনির্বচনীয় আনন্দের মধ্যেও লুকিয়ে ছিল শোকের করুণাধারা। কত মানুষের রক্ত, কত স্বজনের চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া; স্বাধীনতার আনন্দে তখন মানুষ হাসছে। আবার আপনজন হারানোর বেদনায় সেই হাসিও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের মধ্যেও বর্ণনাতীত এক শোকের অনুভূতিও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল ঢাকাবাসীকে। আনন্দ আর দুঃখবোধ মিলিয়ে সে এক বর্ণনাতীত মুহূর্ত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সাক্ষী যারা, তাদের কাছে সেটি যুগপৎ হাসি আর কান্নার এক স্মৃতিগাথা।
সে এক ঘোরলাগা দিন। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার লেখায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের অনুভূতির কথা লিখেছেন এভাবে, “ঘোরলাগা দিনের স্মৃতি কখনও স্পষ্ট থাকে না। জলরঙে আঁকা ছবি পানিতে ভিজিয়ে রাখলে সব ঝাপসা হয়ে যায়। একটা রঙের সঙ্গে অন্যটা মিশে কুয়াশা কুয়াশা ভাব হয়। সেদিন কিন্তু কুয়াশাও ছিল। কুয়াশার ভেতর থেকে হুট করে একটা জিপগাড়ি উদয় হলো। গাড়িভর্তি মুক্তিযোদ্ধা। আশেপাশের বাড়ি থেকে ছুটে আসছে মহিলারা, শিশুরা। সবার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। তাদের গলায় বিস্ময় ধ্বনি_ মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযোদ্ধা। গোপন যোদ্ধারা আজ প্রকাশিত। আহা কী আনন্দ!”
শুধুই কী আনন্দ! দিনটা ছিল অনিশ্চয়তারও। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, কিন্তু যুদ্ধের হিংস্রতা তখনও পর্যন্ত পুরোপুরি থামেনি। পাকিস্তানি সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে এদিক–সেদিক গুলি ছুঁড়ছে, সে গুলিতে বিজয়ের আনন্দে মেতে থাকা সাধারণ মানুষেরও প্রাণ গেছে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছিল ঢাকায় সেই দেশভাগের সময় থেকে বাস করা মোহাজেররা, চলতি বয়ানে যাদের বিহারী বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের গোটা নয় মাস এই বিহারীরা নিজেদের মাটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে দখলদারদের সমর্থন দিয়ে গিয়েছিল। বাঙালি নিধনে শামিল ছিল তারাও। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তির মুহূর্তে সেই অপরাধী বিহারীরাও ছিল আতঙ্কিত। গুলি ছুঁড়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করছিল তারাও।

স্বজাতির বাড়াবাড়িতে বিপদে পড়া সাধারণ বিহারী মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা দৃশ্যপটও এসেছে হুমায়ূন আহমেদের লেখায়। তিনি ১৬ ডিসেম্বর বিকেল তার বন্ধু আনিস সাবেতকে নিয়ে ঢাকা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে একটি অসহায় বিহারী পরিবারের কয়েকটি মৃতদেহ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন তারা, “সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে দু’জন থমকে দাঁড়ালাম। রাস্তা এবং ফুটপাতে একটি পুরো পরিবারের মৃতদেহ। এরা বিহারি। ছোট শিশু আছে। একটি কিশোরীও আছে। কিশোরীর মুখশ্রী কত না সুন্দর! আমার বুকের ভেতর প্রচণ্ড হাহাকার তৈরি হলো। সেই হাহাকারের কিছুটা আমি এখনও বহন করি।”
আনন্দের দিনেও সদ্য মুক্ত দেশের রাজধানীতে পরাজিত পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিশোধস্পৃহার বলি হতে হয়েছে সাধারণ মানুষের। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তখনো দেশে এসে পৌঁছেনি। প্রশাসন বলতে কিছু নেই। সেই চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মঈনুল হোসেন চৌধুরী, বীরবিক্রমের লেখা ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইয়ে। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৮০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মঈনুল ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন। তারা ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছি। স্টেডিয়ামের পথে পথে রাস্তাঘাট ছিল জনশূন্য। যদিও পাকিস্তান আর্মি আত্মসমর্পণ করেছিল তথাপি লৈাকজনের মধ্যে ভয়–ভীতি, আতঙ্ক ও সন্দেহ ছিল। তাই রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল ছিল না। ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছার পূর্বে সন্ধ্যায় জানতে পারি, ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের আশপাশে পাকিস্তান আর্মি উৎসুক জনসাধারণের ওপর গুলি চালিয়েছে। ফলে কিছু লোক হতাহত হয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছিল ‘নো ওয়ার জোন’। সেখানেই বিভিন্ন দেশের সংবাদ সংস্থা ও গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা কাজ করছিলেন। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিলেন। ইন্টারকন্টিনেন্টালে দাঁড়িয়েই লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী নিজের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত পাকিস্তানকে রক্ষার কথা বলেছিলেন। সেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল সংলগ্ন রাস্তার পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন মঈনুল হোসেন চৌধুরী। সন্ধ্যায় এক সহযোদ্ধাকে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন, “হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনের রাস্তায় তখনও রক্তের দাগ ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে কী হয়েছিল তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেনি। ধারণা করা হয়, বিজয়ের পর উৎসুক জনতা হোটেলের সামনে ভিড় জমায়। পলায়নরত পাকিস্তানিরা তখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গুলি ছোড়ে।”

মঈনুল হোসেন চৌধুরী ১৬ ডিসেম্বরের পরদিন সকালে ঢাকার রাস্তার কিছু কৌতুককর মুহূর্তও তুলে ধরেছেন তার লেখায়, “সকালেই স্টেডিয়াম থেকে দেখতে পাই শহরে প্রচুর লোক সমাগম। তাদের অনেকেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং গাড়ি করে ও পায়ে হেঁটে শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের দেখে মনে হয়নি গত ৯ মাসে কখনও তারা বৃষ্টিতে ভিজেছে বা রোদে ঘেমেছে। তাদের বেশভূষা, চালচলন ও আচরণে যুদ্ধের কোনো ছাপ ছিল না।”
১৬ ডিসেম্বর ও এর পরবর্তী কয়েকদিন ঢাকা শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল ভারতীয় বাহিনীর ওপর। ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানে ব্যাপক লুটতরাজ হয়। জেনারেল মঈন ও তার সৈন্যরা ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়াম থেকেই অদূরের জিন্না অ্যাভিনিউয়ের (এখন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) বিভিন্ন বিপনী বিতানে লুটপাট হতে দেখেন। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, এসব লুটপাটের সময় দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছুই করার ছিল না। কারণ, ভারতীয় বাহিনী তখন দায়িত্বে। তিনি উল্লেখ করেছেন, এসব লুটতরাজে অন্যান্যদের সঙ্গে ভুক্তভোগীরা ভারতীয় বাহিনীকেও দোষারোপ করছিলেন।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মুহূর্ত নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় কয়েকজন বিশিষ্টজনের লেখায়। ‘বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১’ বইয়ে কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘যুদ্ধ শেষ—খবরটা যখন শুনলাম মনে মনে আল্লাহর শোকরানা আদায় করেছি। যতটা উচ্ছ্বসিত হওয়া উচিত ছিল, যতটা আনন্দ করা যেত, ততটা করতে পারিনি।”

কবির লেখাতে ১৬ ডিসেম্বর পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের এলোপাতারি গুলির ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা বিজয় লাভ করেছি—খবরটা ছড়িয়ে পড়ার পরপরই রাস্তা থেকে যেমন আনন্দ উল্লাস শোনা যাচ্ছিল, তেমন গুলির আওয়াজও। হেরে গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা দুমদাম করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। আবার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙচুর। এ বাড়ির জানালা, ও বাড়ির দরজা, এটা সেটা ভাঙতে ভাঙতে আর এলোপাতারি গুলি ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার হাতেম আলী সাহেবের বাসা আমাদের বাসার কাছেই। খুব ভালো ছিলেন ভদ্রলোক। পাক সেনাদের গোলার আঘাত লেগেছিল ওদের রান্নাঘরের দেয়ালে। সেই গোলায় মারা গেছে হাতেম আলী সাহেবের শ্যালিকা ডোরা।’
বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ বইয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একটা লেখাও আছে। তিনি ১৬ ডিসেম্বর নিয়ে নিজের অনুভূতি জানিয়েছিলেন এভাবে, ‘একাত্তরের সেই বিজয় দিবসে আমার অনুভূতি–উপলব্ধির কথা আমি কখনোই অন্যদের মতো গুছিয়ে, জুতসই শব্দাবলি সাজিয়ে লিখতে পারব না। মনে হয়, মনটা সেদিন পাথর হয়ে গিয়েছিল এবং যান্ত্রিকও।’ ১৯৭১ সালে জাহানারা ইমামের বড় ছেলে সাইফ ইমাম রুমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি দুর্ধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম গেরিলা ছিলেন। ঢাকায় বেশ কিছু অপারেশনও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রুমির। আগস্টে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি সেনারা। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
টুকরো টুকরো অনুভূতির সম্মিলিত রূপই ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের দিন। দিনটা ঘোরলাগা। আনন্দ,শোক আর গৌরবের এক মিশ্র অনুভব।

৫৫ বছর পেরিয়ে গেছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের সেই অবিস্মরণীয় বিকেলটি কেমন ছিল? ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পন বাঁধভাঙা আনন্দের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল ঢাকার মানুষের মধ্যে। কিন্তু অনির্বচনীয় আনন্দের মধ্যেও লুকিয়ে ছিল শোকের করুণাধারা। কত মানুষের রক্ত, কত স্বজনের চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া; স্বাধীনতার আনন্দে তখন মানুষ হাসছে। আবার আপনজন হারানোর বেদনায় সেই হাসিও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের মধ্যেও বর্ণনাতীত এক শোকের অনুভূতিও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল ঢাকাবাসীকে। আনন্দ আর দুঃখবোধ মিলিয়ে সে এক বর্ণনাতীত মুহূর্ত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সাক্ষী যারা, তাদের কাছে সেটি যুগপৎ হাসি আর কান্নার এক স্মৃতিগাথা।
সে এক ঘোরলাগা দিন। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার লেখায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের অনুভূতির কথা লিখেছেন এভাবে, “ঘোরলাগা দিনের স্মৃতি কখনও স্পষ্ট থাকে না। জলরঙে আঁকা ছবি পানিতে ভিজিয়ে রাখলে সব ঝাপসা হয়ে যায়। একটা রঙের সঙ্গে অন্যটা মিশে কুয়াশা কুয়াশা ভাব হয়। সেদিন কিন্তু কুয়াশাও ছিল। কুয়াশার ভেতর থেকে হুট করে একটা জিপগাড়ি উদয় হলো। গাড়িভর্তি মুক্তিযোদ্ধা। আশেপাশের বাড়ি থেকে ছুটে আসছে মহিলারা, শিশুরা। সবার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। তাদের গলায় বিস্ময় ধ্বনি_ মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযোদ্ধা। গোপন যোদ্ধারা আজ প্রকাশিত। আহা কী আনন্দ!”
শুধুই কী আনন্দ! দিনটা ছিল অনিশ্চয়তারও। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, কিন্তু যুদ্ধের হিংস্রতা তখনও পর্যন্ত পুরোপুরি থামেনি। পাকিস্তানি সৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে এদিক–সেদিক গুলি ছুঁড়ছে, সে গুলিতে বিজয়ের আনন্দে মেতে থাকা সাধারণ মানুষেরও প্রাণ গেছে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ছিল ঢাকায় সেই দেশভাগের সময় থেকে বাস করা মোহাজেররা, চলতি বয়ানে যাদের বিহারী বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের গোটা নয় মাস এই বিহারীরা নিজেদের মাটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে দখলদারদের সমর্থন দিয়ে গিয়েছিল। বাঙালি নিধনে শামিল ছিল তারাও। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তির মুহূর্তে সেই অপরাধী বিহারীরাও ছিল আতঙ্কিত। গুলি ছুঁড়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করছিল তারাও।

স্বজাতির বাড়াবাড়িতে বিপদে পড়া সাধারণ বিহারী মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা দৃশ্যপটও এসেছে হুমায়ূন আহমেদের লেখায়। তিনি ১৬ ডিসেম্বর বিকেল তার বন্ধু আনিস সাবেতকে নিয়ে ঢাকা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে একটি অসহায় বিহারী পরিবারের কয়েকটি মৃতদেহ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন তারা, “সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এসে দু’জন থমকে দাঁড়ালাম। রাস্তা এবং ফুটপাতে একটি পুরো পরিবারের মৃতদেহ। এরা বিহারি। ছোট শিশু আছে। একটি কিশোরীও আছে। কিশোরীর মুখশ্রী কত না সুন্দর! আমার বুকের ভেতর প্রচণ্ড হাহাকার তৈরি হলো। সেই হাহাকারের কিছুটা আমি এখনও বহন করি।”
আনন্দের দিনেও সদ্য মুক্ত দেশের রাজধানীতে পরাজিত পাকিস্তান বাহিনীর প্রতিশোধস্পৃহার বলি হতে হয়েছে সাধারণ মানুষের। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তখনো দেশে এসে পৌঁছেনি। প্রশাসন বলতে কিছু নেই। সেই চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মঈনুল হোসেন চৌধুরী, বীরবিক্রমের লেখা ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইয়ে। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৮০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মঈনুল ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন। তারা ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছি। স্টেডিয়ামের পথে পথে রাস্তাঘাট ছিল জনশূন্য। যদিও পাকিস্তান আর্মি আত্মসমর্পণ করেছিল তথাপি লৈাকজনের মধ্যে ভয়–ভীতি, আতঙ্ক ও সন্দেহ ছিল। তাই রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল ছিল না। ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছার পূর্বে সন্ধ্যায় জানতে পারি, ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের আশপাশে পাকিস্তান আর্মি উৎসুক জনসাধারণের ওপর গুলি চালিয়েছে। ফলে কিছু লোক হতাহত হয়েছে।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছিল ‘নো ওয়ার জোন’। সেখানেই বিভিন্ন দেশের সংবাদ সংস্থা ও গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা কাজ করছিলেন। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিলেন। ইন্টারকন্টিনেন্টালে দাঁড়িয়েই লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী নিজের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত পাকিস্তানকে রক্ষার কথা বলেছিলেন। সেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল সংলগ্ন রাস্তার পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন মঈনুল হোসেন চৌধুরী। সন্ধ্যায় এক সহযোদ্ধাকে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন, “হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনের রাস্তায় তখনও রক্তের দাগ ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে কী হয়েছিল তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেনি। ধারণা করা হয়, বিজয়ের পর উৎসুক জনতা হোটেলের সামনে ভিড় জমায়। পলায়নরত পাকিস্তানিরা তখন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গুলি ছোড়ে।”

মঈনুল হোসেন চৌধুরী ১৬ ডিসেম্বরের পরদিন সকালে ঢাকার রাস্তার কিছু কৌতুককর মুহূর্তও তুলে ধরেছেন তার লেখায়, “সকালেই স্টেডিয়াম থেকে দেখতে পাই শহরে প্রচুর লোক সমাগম। তাদের অনেকেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং গাড়ি করে ও পায়ে হেঁটে শহরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের দেখে মনে হয়নি গত ৯ মাসে কখনও তারা বৃষ্টিতে ভিজেছে বা রোদে ঘেমেছে। তাদের বেশভূষা, চালচলন ও আচরণে যুদ্ধের কোনো ছাপ ছিল না।”
১৬ ডিসেম্বর ও এর পরবর্তী কয়েকদিন ঢাকা শহরের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল ভারতীয় বাহিনীর ওপর। ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানে ব্যাপক লুটতরাজ হয়। জেনারেল মঈন ও তার সৈন্যরা ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়াম থেকেই অদূরের জিন্না অ্যাভিনিউয়ের (এখন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) বিভিন্ন বিপনী বিতানে লুটপাট হতে দেখেন। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, এসব লুটপাটের সময় দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছুই করার ছিল না। কারণ, ভারতীয় বাহিনী তখন দায়িত্বে। তিনি উল্লেখ করেছেন, এসব লুটতরাজে অন্যান্যদের সঙ্গে ভুক্তভোগীরা ভারতীয় বাহিনীকেও দোষারোপ করছিলেন।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মুহূর্ত নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায় কয়েকজন বিশিষ্টজনের লেখায়। ‘বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১’ বইয়ে কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘যুদ্ধ শেষ—খবরটা যখন শুনলাম মনে মনে আল্লাহর শোকরানা আদায় করেছি। যতটা উচ্ছ্বসিত হওয়া উচিত ছিল, যতটা আনন্দ করা যেত, ততটা করতে পারিনি।”

কবির লেখাতে ১৬ ডিসেম্বর পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের এলোপাতারি গুলির ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা বিজয় লাভ করেছি—খবরটা ছড়িয়ে পড়ার পরপরই রাস্তা থেকে যেমন আনন্দ উল্লাস শোনা যাচ্ছিল, তেমন গুলির আওয়াজও। হেরে গিয়ে পাকিস্তানি সেনারা দুমদাম করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। আবার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙচুর। এ বাড়ির জানালা, ও বাড়ির দরজা, এটা সেটা ভাঙতে ভাঙতে আর এলোপাতারি গুলি ছুড়তে ছুড়তে যাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার হাতেম আলী সাহেবের বাসা আমাদের বাসার কাছেই। খুব ভালো ছিলেন ভদ্রলোক। পাক সেনাদের গোলার আঘাত লেগেছিল ওদের রান্নাঘরের দেয়ালে। সেই গোলায় মারা গেছে হাতেম আলী সাহেবের শ্যালিকা ডোরা।’
বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ বইয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একটা লেখাও আছে। তিনি ১৬ ডিসেম্বর নিয়ে নিজের অনুভূতি জানিয়েছিলেন এভাবে, ‘একাত্তরের সেই বিজয় দিবসে আমার অনুভূতি–উপলব্ধির কথা আমি কখনোই অন্যদের মতো গুছিয়ে, জুতসই শব্দাবলি সাজিয়ে লিখতে পারব না। মনে হয়, মনটা সেদিন পাথর হয়ে গিয়েছিল এবং যান্ত্রিকও।’ ১৯৭১ সালে জাহানারা ইমামের বড় ছেলে সাইফ ইমাম রুমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি দুর্ধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম গেরিলা ছিলেন। ঢাকায় বেশ কিছু অপারেশনও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রুমির। আগস্টে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি সেনারা। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
টুকরো টুকরো অনুভূতির সম্মিলিত রূপই ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের দিন। দিনটা ঘোরলাগা। আনন্দ,শোক আর গৌরবের এক মিশ্র অনুভব।

‘ব্যাটল অব শিরোমণি’র শুরুটা হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারতীয় বাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মুক্তিবাহিনীর মেজর ওসমান গনির নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর একটা বড় কনভয় খুলনা শহর মুক্ত করতে রওনা দেয়। কিন্তু এই কনভয়ের শিরোমণি এলাকায় পৌঁছলে পাকিস্তান বাহিনী চতুর্দিক থেকে অ্যামবুশ করে। এতে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর