জোহরান মামদানি: আমেরিকায় এক নতুন মানবিক রাজনীতির প্রতীক

হামিদ দাবাশি
হামিদ দাবাশি
জোহরান মামদানি: আমেরিকায় এক নতুন মানবিক রাজনীতির প্রতীক
মামদানির বিজয় কেবল মুসলমানদের নয়; বরং এটি ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দু, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো ও এশীয় ভোটারদের এক ঐক্যবদ্ধ জোটের সাফল্য। ছবি: রয়টার্স

নিউইয়র্ক শহরের ইতিহাসে প্রথম মুসলমান মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানির বিজয় আমেরিকায় এক অভূতপূর্ব নৈতিক জাগরণের ইঙ্গিত দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল প্রভাবশালী ধনাঢ্যরা, জায়নিস্ট রাব্বি, ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী, পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যম, এমনকি প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত। তবু তারা সবাই ব্যর্থ হয়েছে।

মামদানির জয় ঘোষণা করলেন, ঘৃণা, বিভাজন ও মিথ্যার রাজনীতি আর আমেরিকার পথপ্রদর্শক নয়।

ঘৃণার মুখে দৃঢ় অবস্থান

নির্বাচনের শেষ সপ্তাহে একদল ইসরায়েলপন্থী ইহুদি ধর্মযাজক বা রাব্বিরা ‘দ্য জিউইশ মেজরিটি’ নামে একটি বিবৃতি দেন। সেখানে তারা মামদানিকে লক্ষ্য করে প্রচারণা চালান। তাদের দাবি, মামদানি ইসরায়েল-বিরোধী। কিন্তু এই রাব্বিরা আসলে নিউইয়র্কের ইহুদি জনগোষ্ঠীর প্রকৃত প্রতিনিধি নন। বরং অসংখ্য ইহুদি নাগরিক মামদানির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং তার প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন।

রাব্বিদের মূল ক্ষোভ ছিল– মামদানি গাজার হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা’ বলেছেন। তিনি সাহস করে বলেছেন, “ইসরায়েলি আগ্রাসন আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।”

এই সত্য উচ্চারণই তাকে টার্গেট বানিয়েছে।

এক রঙধনু জোটের উত্থান

মামদানির বিজয় কেবল মুসলমানদের নয়; বরং এটি ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিন্দু, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো ও এশীয় ভোটারদের এক ঐক্যবদ্ধ জোটের সাফল্য। এই নির্বাচনে দেখা গেছে, সাধারণ নিউইয়র্কবাসী ধনিক গোষ্ঠীর নির্দেশ মানছে না। তারা এমন এক নেতৃত্ব চেয়েছে, যিনি বলেন, “আমাদের শহর তখনই মহান, যখন তা ধনী-গরিব, মুসলিম-ইহুদি, কালো-শ্বেতাঙ্গ– সবার জন্য সমান।”

অনেক ইহুদি নাগরিক প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, “আমাদের ভবিষ্যৎ এই শহরের সব সম্প্রদায়ের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িত।” এই বক্তব্যই প্রমাণ করে, নিউইয়র্কে এক পোস্ট-জায়নিস্ট ইহুদি চেতনা গড়ে উঠছে। যেখানে ধর্ম নয়, মানবতাই রাজনীতির কেন্দ্রে।

গণমাধ্যমের পরাজয়, জনমানুষের জয়

নিউইয়র্ক টাইমস, ফক্স নিউজ ও নিউইয়র্ক পোস্ট মামদানিকে ‘চরমপন্থী মুসলিম’ আখ্যা দিতে মরিয়া ছিল। তারা ভয় ও বিভ্রান্তির রাজনীতি চালাতে চেয়েছিল। কিন্তু নিউইয়র্কবাসী বুঝে গেছে, প্রকৃত চরমপন্থী তারা, যারা যুদ্ধ, দখল ও গণহত্যাকে ন্যায্য বলে। এই নির্বাচনে গণমাধ্যমের প্রভাব ভেঙে দিয়েছে জনমানুষের নৈতিক বোধ। মানুষ স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, ন্যায়বিচারের পক্ষে অবস্থান নেওয়াই আসল সাহস।

মামদানির দর্শন: মানবিকতার রাজনীতি

জোহরান মামদানি জন্মেছেন এক মুসলমান পিতা ও হিন্দু মাতার ঘরে। তার মধ্যে ধর্মীয় সহাবস্থান ও ন্যায়বোধের সংমিশ্রণ রয়েছে। তিনি বলেছেন, “যতক্ষণ না সবার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, ততক্ষণ কেউই সত্যিকার স্বাধীন নয়।”

তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যদি কোনো ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধী নেতা নিউইয়র্কে আসে, আন্তর্জাতিক আইনের বিধান অনুযায়ী তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। মানবতার পক্ষে নিজের অবস্থান অটুট রেখে তিনি ইসরায়েল সফরের রাজনৈতিক আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এই জয় এক ‘কাব্যিক ন্যায়বিচার’। যে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে একসময় জায়নিস্ট প্রভাবশালী গোষ্ঠী চুপ করাতে চেয়েছিল, আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সন্তানই নিউইয়র্কের মেয়র
এই জয় এক ‘কাব্যিক ন্যায়বিচার’। যে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে একসময় জায়নিস্ট প্রভাবশালী গোষ্ঠী চুপ করাতে চেয়েছিল, আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সন্তানই নিউইয়র্কের মেয়র

এক ঐক্যবদ্ধ শহর ও নতুন রাজনীতির সূচনা

মামদানির জয় হলো শ্রমজীবী নিউইয়র্কবাসীর জয়, যারা প্রতিদিন ভোরে ট্রেনে চেপে কাজে যায়, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করে, রেস্তোরাঁয় কাজ করে, স্কুলে পড়ায়। তাদের মুখে আজ একটাই কথা, “আমরা এই শহর চালাই, আমরা এর মালিক, আমরা ঘৃণার রাজনীতি মানি না।”

নিউইয়র্ক আবারও প্রমাণ করেছে– এটি এমন এক বিশ্বনাগরিক শহর, যেখানে ধর্ম বা বর্ণ নয়, মানবতা রাজনীতির মূল মূল্যবোধ।

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নৈতিক পতন

এই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আসল মুখও উন্মোচিত হয়েছে। চাক শুমার, হাকিম জেফ্রিস, জো বাইডেন, হিলারি ক্লিনটন বা বারাক ওবামা–সবাই ধনীদের স্বার্থ দেখতে ও প্রভাবে বজায় রাখতে নীরব থেকেছেন।

ওবামা শেষ মুহূর্তে মামদানিকে ফোন করে এক ফাঁপা সমর্থন দেন। আসলে মামদানির উচিত ওবামার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং প্রতিটি কথার উল্টো কাজটা করা।

এই ঘটনাই প্রমাণ করে– আমেরিকান রাজনীতিতে এখন মামদানি-পূর্ব ও মামদানি-পরবর্তী দুটি যুগ শুরু হয়েছে।

ইতিহাসের কাব্যিক ন্যায়বিচার

এই জয় এক ‘কাব্যিক ন্যায়বিচার’। যে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে একসময় জায়নিস্ট প্রভাবশালী গোষ্ঠী চুপ করাতে চেয়েছিল, আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সন্তানই নিউইয়র্কের মেয়র। এ যেন ইতিহাসেরই প্রতিশোধ– যেখানে সত্যকে চুপ করানো যায় না, শুধু বিলম্বিত করা যায়।

জোহরান মামদানির এই জয় শুধু নিউইয়র্কের নয়, এটি গাজার, এটি দক্ষিণ আফ্রিকার, এটি ঢাকার, এটি পৃথিবীর প্রতিটি শহরের, যেখানে মানুষ মর্যাদা, ন্যায় ও স্বাধীনতার জন্য লড়ে। তিনি কেবল একজন মেয়র নন; তিনি এক নতুন মানবিক আমেরিকার প্রতীক– যিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন, “ন্যায়বিচারই রাজনীতি, আর মানবতাই এর চূড়ান্ত লক্ষ্য।”

**হামিদ দাবাশি: হাগপ কেভরকিয়ান অধ্যাপক, ইরানীয় স্টাডিজ ও তুলনামূলক সাহিত্য, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউইয়র্ক।**

সম্পর্কিত