‘পুলিশ–র‍্যাব পকেটে, আমিই এখন জেনেভা ক্যাম্পের সুলতান’

‘পুলিশ–র‍্যাব পকেটে, আমিই এখন জেনেভা ক্যাম্পের সুলতান’
জেনেভা ক্যাম্পের ‘সুলতান’ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করা পিচ্চি রাজা। ছবি: চরচা

“এখন পুলিশ–র‍্যাব–সেনাবাহিনী সব আমার পকেটে। আমার ইশারায় অভিযান হয়, আমিই জেনেভা ক্যাম্পের সুলতান।” কথাটা রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের অঘোষিত ‘সুলতান’ পিচ্চি রাজার। কে এই পিচ্চি রাজা, যিনি আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স থেকে নিজেকে ‘সুলতান’ ঘোষণার মতো সদম্ভ ভাষ্য দিতে পারেন?

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, দেশের অন্যতম মাদকস্পট ও অপরাধপ্রবণ এলাকা। বহু বছর ধরে ক্যাম্পজুড়ে গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ মাদক সিন্ডিকেট, যারা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনের নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযানের মাঝেও ক্যাম্পের অভ্যন্তরে মাদকের বাজার কখনো থেমে থাকেনি। এক সম্রাটের পতনের মধ্যেই আরেক সম্রাটের উত্থান–জেনেভা ক্যাম্পে এ যেন এক অব্যাহত চক্র।

কিছুদিন আগে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ভূঁইয়া সোহেল ওরফে বুনিয়া সোহেলকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে মুমুর্ষ অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। এ হামলা জেনেভা ক্যাম্পের মাদক সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বের পালাবদলের একটি বড় সংকেত। এ ঘটনার পর থেকেই আলোচনায় আসে ‘পিচ্চি রাজা’, যার কথা শুরুতেই বলা হয়েছে। এই পিচ্চি রাজা ক্যাম্পের সন্ত্রাসীরা এখন ‘অঘোষিত সুলতান’ বলেই ডাকছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের বিভিন্ন মাদক স্পট। ছবি: সুদীপ্ত সালাম
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের বিভিন্ন মাদক স্পট। ছবি: সুদীপ্ত সালাম

পিচ্চি রাজা: এক সোর্সের ‘মাদক সম্রাট’ হয়ে ওঠা
জেনেভা ক্যাম্পের স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজার মাদক কারবারে জড়িত থাকার ইতিহাস অনেক পুরোনো। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অল্প বয়সেই রাজা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারি ইশতিয়াকের হয়ে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি সেই সময় থেকে বিভিন্ন আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স হিসেবেও কাজ করেন। আর এর মধ্য দিয়েই তিনি প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

এরপর ২০২০ সালে করোনাকালে ইশতিয়াক মারা গেলে ক্যাম্পে তার মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ আসে রাজার হাতে। অল্প বয়সেই এ উত্থানের কারণে স্থানীয়দের মুখে মুখে তার নাম হয়ে যায় ‘পিচ্চি রাজা’। সোর্স পরিচয় ও প্রশাসনের কয়েকজন অসাধু সদস্যের সহায়তায় তিনি দ্রুতই ক্যাম্পের বড় সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে নেন। টেকনাফ থেকে সরাসরি চালান এনে জেনেভা ক্যাম্পে বড় নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।

ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগ

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বদল আসে। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে অস্থিরতা শুরু হয়। আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষত পুলিশ বাহিনীতে ঘটে ব্যাপক রদবদল। একই সময়ে জেনেভা ক্যাম্পের কোটি কোটি টাকার মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর হয়ে ওঠে বিবদমান গোষ্ঠীগুলো। অপরাধপ্রবণ এ এলাকায় অভিযান শুরু করে পুলিশ, র‍্যাব ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী।

শুরুতে ক্যাম্পের বিভিন্ন গ্রুপের আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। গ্রেপ্তার করা হয় বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যদের। গত তিন মাসে হওয়া এসব অভিযানের অধিকাংশই পরিচালিত হয়েছে শুধু বুনিয়া সোহেলের আস্তানায়। সে আস্তানায় চালানো একাধিক অভিযানে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ককটেল বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম, মাদকদ্রব্যসহ মাদক বিক্রির কয়েক কোটি টাকা জব্দ করা হয়।

বুনিয়া সোহেলের আস্তানায় চালানো অভিযান প্রসঙ্গে ক্যাম্পের একাধিক মাদককারবারি ও আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর দুই সোর্স চরচাকে বলেন, পিচ্চি রাজা দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স হিসেবে কাজ করায়, তার সঙ্গে বাহিনীর অনেক সদস্যের ভালো সখ্য রয়েছে। পিচ্চি রাজা প্রধান সহকারী আদিও সোর্স হিসাবে কাজ করে। গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যেকোনো সোর্সের ওপর নির্ভশীল হয়ে পড়ে।

ওই দুই সূত্র জানায়, পিচ্চি রাজার মূল টার্গেট ছিল বুনিয়াকে ক্যাম্প থেকে বিতাড়িত করা। ফলে গত তিন মাস ধরে যৌথবাহিনীর সকল অভিযান বুনিয়াকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়েছে, যেখানে প্রভাবকের ভূমিকা রাখেন রাজা।

হামলার আগে সর্বশেষ ২৬ নভেম্বর রাতে বুনিয়া সোহেলের আস্তানায় অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। সেসময় তাকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও অভিযানে মাদক, অস্ত্র, ককটেল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, নগদ টাকাসহ দেশীয় নানা অস্ত্র জব্দ করা হয়। ওইদিন মধ্যরাতেই বুনিয়া সোহেলের আস্তানা লুট করে পিচ্চি রাজাসহ বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যরা। সেদিন বুনিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় ১২-১৫টি ঘরে লুটপাট চালানো হয়।

ক্যাম্পে নতুন জোট ও ‘সুলতানের’ আবির্ভাব
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে বুনিয়া সোহেল বনাম পিচ্চি রাজা–চুয়া সেলিম–পার মনু গ্রুপের বিরোধ তীব্র হতে থাকে। মাদকের স্পট দখল, এলাকার লাইনম্যান নিয়ন্ত্রণ, টাকা-পয়সার ভাগবাটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে দফায় দফায় চলে সংঘর্ষ। ওই বছরই দুই শিশুসহ মারা যায় বিভিন্ন গ্রুপের আটজন।

স্থানীয়দের দাবি, পিচ্চি রাজা তার সোর্স পরিচয় ও প্রশাসনের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করে নিয়েছে। কয়েকদিন আগে বুনিয়া সোহেলকে হামলার পর তার আস্তানা আবার লুট করেন পিচ্চি রাজার লোকেরা। এ সময় পিচ্চি রাজাকে বলতে শোনা যায়–“এখন পুলিশ–র‍্যাব–সেনাবাহিনী সব আমার পকেটে। আমার ইশারায় অভিযান হয়, আমিই জেনেভা ক্যাম্পের সুলতান।”

তবে পিচ্চি রাজার সোর্স পরিচয় অস্বীকার করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি মো. কাজী রফিকুল ইসলাম চরচাকে বলেন, “পিচ্চি রাজাও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও ক্যাম্পের শীর্ষ মাদককারবারি। তিনি আমাদের সোর্স ছিলেন না। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজাসহ আরও বেশ কিছু সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। জামিনে বেরিয়ে আবারও মাদক কারবারে জড়িয়েছে তারা। পিচ্চি রাজাসহ ক্যাম্পের সব অপরাধীকে গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”

কালো টাকা সাদা করার ‘পারিবারিক নেটওয়ার্ক’
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, পিচ্চি রাজা মাদক কারবারি থেকে অর্জিত বিপুল টাকা সাদা করতে দীর্ঘদিন ধরে একটি সুসংগঠিত পারিবারিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের নিয়ে গঠিত এই গ্রুপই মূলত রাজার টাকার লেনদেন, বিনিয়োগ ও সম্পদ ক্রয়ের পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

এই নেটওয়ার্কের শীর্ষে রয়েছেন পিচ্চি রাজার শ্বশুর খোরশেদ। তিনি টাকা-পয়সার লেনদেনের মূল নিয়ন্ত্রক। এর সঙ্গে রয়েছেন সিএনজি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত নয়ন, যিনি সম্পর্কে রাজার শ্যালক। তিনি দেখেন দৈনন্দিন আয়–ব্যয়ের হিসাব। আর ফুফাতো ভাই রনি পরিচালনা করেন ব্যবসার অন্যান্য খাত। বিভিন্ন খাতে করা বিনিয়োগ গোপন রাখার বিষয়টি দেখেন রাজার ঘনিষ্ঠ সহযোগী রনি।

সূত্র বলছে, এই নেটওয়ার্কের সহায়তায় পিচ্চি রাজা অল্প সময়ের মধ্যেই ২৫ থেকে ৩০টি সিএনজির মালিক হয়েছেন এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০টি ফ্ল্যাট ও সম্পত্তি কিনেছেন। তাদের দাবি, এসব সম্পদের সিংহভাগই মাদকের কারবার থেকে আসা কালো টাকা ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে সাদা করার প্রয়াস।

পিচ্চি রাজার গ্রুপে প্রধান সহযোগী আদি আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যতম সোর্স। রাজার গ্রুপের সক্রিয় সদস্যের মধ্যে রয়েছেন–নবাব, শাহজাদা, ফাইজান, বেলুন, রুবেল, রনি (ম্যানেজার), নাটা সুমন, সুজন, ব্যাটারি কামরান, হীরা ও মঈন পিচ্চি। এরা মাদক বিতরণ, টাকা আদায়, দখল ও মারামারি, প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধকাজে যুক্ত।

জেনেভা ক্যাম্পের ভবিষ্যৎ কী?
জেনেভা ক্যাম্পে মাদক–অস্ত্রসহ অপরাধ দমনে প্রশাসনের ওপর জনগণের আস্থা কমে গেছে বহু আগেই। বাহিনীর কিছু সদস্যের ‘সোর্স রাজনীতি’ ও অসাধু চক্রের কারণে মাদক নেটওয়ার্ক বন্ধ না হয়ে বরং নতুনভাবে রূপ নিচ্ছে। এক সম্রাটের পতন মানে আরেক সম্রাটের উত্থান—এই বাস্তবতা বদলাতে হলে সোর্সনির্ভরতা কমিয়ে ক্যাম্পে সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বচ্ছ অভিযান পরিচালনা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সোর্সনির্ভরতা কমিয়ে যথাযথ অভিযান পরিচালনার প্রত্যয় শোনা গেল ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইবনে মিজানের কাছ থেকে। চরচাকে তিনি বলেন, “কে আমাদের সোর্স, আর কে আমাদের সোর্স না–এটা আমাদের কাছে মূখ্য বিষয় না। তিনি অপরাধী কিনা, সেটা আমাদের কাছে প্রধান বিষয়। ক্যাম্পের সকল অপরাধীকে গ্রেপ্তারে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে।”

সম্পর্কিত