১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ফজলে রাব্বি

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এদিন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে নোয়াখালী শহর উদ্ধার করে চট্টগ্রামের দিকে এগোতে থাকে। যৌথ বাহিনীর অন্য দল খুলনার ১৬ মাইল দূরে পৌঁছালে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর শহরও পতনের মুখে ছিল।
ময়মনসিংহে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানি সেনারা দিনের বেলা কিছুটা প্রতিরোধ করলেও রাত থেকে টাঙ্গাইলের ভেতর দিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে।
জামালপুরে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টেকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। পাকিস্তানি অধিনায়ক একটি বুলেট কাগজে মুড়ে উত্তর দেয়। অর্থাৎ তারা যুদ্ধ চালাবে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো বোমাবর্ষণ করে তাদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। সন্ধ্যা থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে জামালপুর শহরে ঢুকতে থাকে। তবে পাকিস্তানি সেনারা ১০ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে যৌথ বাহিনীর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ভোরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহে ঢুকে তাদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি তাদের ফাঁদমুক্ত করার জন্য দুর্গাপুরের দিক থেকে আক্রমণ করে। সকাল প্রায় সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনারা ভৈরব সেতুর আশুগঞ্জসংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
ভারতীয় বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকও দুর্গাপুরের দিক থেকে এ আক্রমণে অংশ নেওয়ার সময় পাকিস্তানি ট্যাংক-বিধ্বংসী মাইনফিল্ডের ফাঁদে পড়ে যায়। যুদ্ধে দুই পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আশুগঞ্জে থাকা পাকিস্তানি সেনারা রাতে ভৈরব চলে যায়। ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়। আশুগঞ্জও মুক্ত হয়। মেঘনা নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সেনারা ভৈরব বাজারের কাছে ঘাঁটি করে।
ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো বারবার ঢাকার চারদিকে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটি এবং সাভার ও নয়ারহাটে রেডিওর ট্রান্সমিটারের ওপর হামলা চালায়। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর নৌ-ইউনিট ও ভারতীয় নৌবাহিনী এদিন যৌথভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চালনা মুক্ত করে। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটি পাকিস্তানি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে।
রণাঙ্গনের দুরাবস্থা বুঝতে পেরে অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের একটি আত্মসমর্পণ প্রস্তাব তার সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করে। প্রস্তাবের শর্তে বলা হয়-
১. পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে
২. বাংলাদেশের গেরিলাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে সরকারিভাবে যোগাযোগ করা হবে না
৩. প্রায় এক লাখ বেসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে
৪. পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং
৫. জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলভুক্ত সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে অধিকৃত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এদিন থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার করা হয়েছিলো বলে পরবর্তীতে জানা যায়।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত বুঝতে পেরে শেষ চেষ্টা হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরব হয়ে ওঠে দেশটির মিত্রশক্তিগুলো। ১০ ডিসেম্বর ভারতকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যুদ্ধবিরতির আবেদন মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেয় চীন, অন্যথায় ভারতকে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হতে পারে বলে বেইজিং বেতার থেকে প্রচার করা হয়। চীনের সরকারি মুখপত্র পিপলস ডেইলির এক সংবাদভাষ্যে বলা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট হয়ে বিশ্বের মতামত উপেক্ষা করে ভারত সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে থাকলে তার পরিণতি লজ্জাকর পরাজয়। পত্রিকাটি বলে, চীন পাকিস্তানের সংগ্রাম দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
রুশ বার্তা সংস্থা তাস-এর এদিনের এক রিপোর্টে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে একপেশে এবং ভারতবিরোধী বলে অভিহিত করা হয়। এতে হোয়াইট হাউস মুখপাত্রের গত ৭ ডিসেম্বরের উক্তি উদ্ধৃত করে বলা হয়, পূর্ব বাংলার ট্র্যাজেডির অবসান ঘটানোর জন্য বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে ওয়াশিংটন পাকিস্তানের জঙ্গি কর্তৃপক্ষের আচরণ সম্পর্কে চোখ বুজে বসে ছিল। দীর্ঘ কয়েক মাস পূর্ব বাংলায় অকথ্য নির্যাতন চলেছে। তত দিন পর্যন্ত ওয়াশিংটনের নিরপেক্ষতা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের অরাজকতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে সমর্থন যুগিয়েছে।
তথ্যসূত্র:
একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা
আনন্দবাজার পত্রিকা
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক

১০ ডিসেম্বর ১৯৭১, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এদিন পাকিস্তানিদের কাছ থেকে নোয়াখালী শহর উদ্ধার করে চট্টগ্রামের দিকে এগোতে থাকে। যৌথ বাহিনীর অন্য দল খুলনার ১৬ মাইল দূরে পৌঁছালে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। কুষ্টিয়া ও দিনাজপুর শহরও পতনের মুখে ছিল।
ময়মনসিংহে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আঘাত হানে। পাকিস্তানি সেনারা দিনের বেলা কিছুটা প্রতিরোধ করলেও রাত থেকে টাঙ্গাইলের ভেতর দিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে।
জামালপুরে যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টেকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়। পাকিস্তানি অধিনায়ক একটি বুলেট কাগজে মুড়ে উত্তর দেয়। অর্থাৎ তারা যুদ্ধ চালাবে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো বোমাবর্ষণ করে তাদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। সন্ধ্যা থেকেই মুক্তিবাহিনী চারদিক থেকে জামালপুর শহরে ঢুকতে থাকে। তবে পাকিস্তানি সেনারা ১০ ডিসেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে যৌথ বাহিনীর ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ভোরের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহে ঢুকে তাদের পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। ভারতের ১০ বিহার রেজিমেন্ট এবং মুক্তিবাহিনীর এস ফোর্সের ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি তাদের ফাঁদমুক্ত করার জন্য দুর্গাপুরের দিক থেকে আক্রমণ করে। সকাল প্রায় সাড়ে ১০টায় পাকিস্তানি সেনারা ভৈরব সেতুর আশুগঞ্জসংলগ্ন অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।
ভারতীয় বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকও দুর্গাপুরের দিক থেকে এ আক্রমণে অংশ নেওয়ার সময় পাকিস্তানি ট্যাংক-বিধ্বংসী মাইনফিল্ডের ফাঁদে পড়ে যায়। যুদ্ধে দুই পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আশুগঞ্জে থাকা পাকিস্তানি সেনারা রাতে ভৈরব চলে যায়। ১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়। আশুগঞ্জও মুক্ত হয়। মেঘনা নদী পেরিয়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সেনারা ভৈরব বাজারের কাছে ঘাঁটি করে।
ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো বারবার ঢাকার চারদিকে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটি এবং সাভার ও নয়ারহাটে রেডিওর ট্রান্সমিটারের ওপর হামলা চালায়। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
মুক্তিবাহিনীর নৌ-ইউনিট ও ভারতীয় নৌবাহিনী এদিন যৌথভাবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চালনা মুক্ত করে। এর আগে ভারতীয় বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটি পাকিস্তানি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে।
রণাঙ্গনের দুরাবস্থা বুঝতে পেরে অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের একটি আত্মসমর্পণ প্রস্তাব তার সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করে। প্রস্তাবের শর্তে বলা হয়-
১. পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে
২. বাংলাদেশের গেরিলাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে সরকারিভাবে যোগাযোগ করা হবে না
৩. প্রায় এক লাখ বেসামরিক পশ্চিম পাকিস্তানি নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে
৪. পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং
৫. জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ দলভুক্ত সদস্যদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে অধিকৃত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এদিন থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার করা হয়েছিলো বলে পরবর্তীতে জানা যায়।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত বুঝতে পেরে শেষ চেষ্টা হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরব হয়ে ওঠে দেশটির মিত্রশক্তিগুলো। ১০ ডিসেম্বর ভারতকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যুদ্ধবিরতির আবেদন মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেয় চীন, অন্যথায় ভারতকে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হতে পারে বলে বেইজিং বেতার থেকে প্রচার করা হয়। চীনের সরকারি মুখপত্র পিপলস ডেইলির এক সংবাদভাষ্যে বলা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট হয়ে বিশ্বের মতামত উপেক্ষা করে ভারত সামরিক অভিযান চালিয়ে যেতে থাকলে তার পরিণতি লজ্জাকর পরাজয়। পত্রিকাটি বলে, চীন পাকিস্তানের সংগ্রাম দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
রুশ বার্তা সংস্থা তাস-এর এদিনের এক রিপোর্টে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে একপেশে এবং ভারতবিরোধী বলে অভিহিত করা হয়। এতে হোয়াইট হাউস মুখপাত্রের গত ৭ ডিসেম্বরের উক্তি উদ্ধৃত করে বলা হয়, পূর্ব বাংলার ট্র্যাজেডির অবসান ঘটানোর জন্য বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে ওয়াশিংটন পাকিস্তানের জঙ্গি কর্তৃপক্ষের আচরণ সম্পর্কে চোখ বুজে বসে ছিল। দীর্ঘ কয়েক মাস পূর্ব বাংলায় অকথ্য নির্যাতন চলেছে। তত দিন পর্যন্ত ওয়াশিংটনের নিরপেক্ষতা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের অরাজকতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে সমর্থন যুগিয়েছে।
তথ্যসূত্র:
একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা
আনন্দবাজার পত্রিকা
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক