চরচা প্রতিবেদক

১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে অল্প কিছু দিন। দিনাজপুরের এস্কান্দার পরিবারে জন্ম নিল ফুটফুটে এক মেয়ে শিশু। পারিবারিক চিকিৎসক ডা. অবনী গোস্বামী এস্কান্দার মজুমদারের কোলে শিশুটিকে তুলে দিয়ে বললেন, ‘নিন, আপনার মেয়ে। কেন যেন মনে হচ্ছে ও খুব ভাগ্যবতী!’
শিশুটি ভাগ্যবতীই ছিল। তার জীবনের পরবর্তী ৮০ বছরের গল্প যে রূপকথাকেও হার মানিয়ে দেয়। তার জীবন এতটাই ঘটনাবহুল আর রোমাঞ্চকর যে রূপকথার গল্প লিখিয়েরাও এত কিছু ভাবার সাহস পাবেন না। দিনাজপুরের এস্কান্দার বাড়ির সেই ছোট্ট শিশুটি যে একসময় দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবে, দেশের মানুষের আশা–আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে উঠবে, ওই ধরনের কিছু ভাবার সাহস কী কেউ পেয়েছিলেন?
দিনাজপুরের এস্কান্দার পরিবারের সেই ছোট্ট, ফুটফুটে শিশুটি ছিল পুতুলের মতোই দেখতে। বাবা এস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার তাদের তৃতীয় কন্যার নাম পুতুলই রাখলেন। ভালো নাম খালেদা খানম। সেই খালেদা খানমেরই ১৯৬১ সালে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর খালেদা জিয়া হয়ে ওঠা।
খালেদা জিয়ার জীবনী লিখতে গেলে একজন লেখকের কাজটা কঠিন অনেকটাই। একটা মানুষের জীবনে এত মোড়, এত ঘটনাপ্রবাহ! জীবনের গতিপথই তাকে নিয়ে গেছে বিভিন্ন পর্যায়ে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে খালেদা যখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছেন, তখন প্রায় হঠাৎ করেই জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে। জীবনটা সেখান থেকেই তার বদলে যাওয়ার শুরু। দিনাজপুর শহরের আটপৌরে এক পারিবারিক জীবন থেকে সেনাকর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে এক ক্যান্টনমেন্ট থেকে অন্য ক্যান্টনমেন্টে ঘোরা। শান্ত–স্নিগ্ধ জীবনযাপনের মধ্যেই হঠাৎ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে অনিশ্চিত জীবন, বন্দিত্ব। স্বামী তখন চরে গেছেন দেশ মাতৃকার ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে। তিনি বেঁচে ফিরবেন কিনা, কোনো নিশ্চয়তা নেই। দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে নানা আশ্রয় খুঁজে বেরানো। মুক্তিযুদ্ধে এই দেশের সাধারণ মানুষের যে দুর্ভোগ, দুর্গতি, যে ত্যাগ—সেই ত্যাগের সঙ্গে খালেদা জিয়া মিলেমিশে একাকার।
স্বাধীন বাংলাদেশে স্বামী ফিরলেন বিজয়ীর বেশে। খালেদার জীবনেও এল পরিবর্তন। এক মেজরের স্ত্রী থেকে একেবারে সেনাবাহিনীর উপপ্রধানের স্ত্রী। কিন্তু খালেদার ব্যক্তিগত জীবন আগের মতোই রইল, স্বামী, সন্তানের কল্যাণই তার একমাত্র চিন্তা। স্বামীর সঙ্গে সর্বোচ্চ সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, ব্যস! এই পর্যন্তই।
তবে খালেদার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মোড় বোধহয় ১৯৭৫ সালটা। এক সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হলেন দেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। জিয়াউর রহমান হয়ে গেলেন দেশের সেনাবাহিনী প্রধান। কিন্তু সেনাবাহিনীতে পাল্টা অভ্যুত্থানে সে বছরেরই নভেম্বরে খালেদা দেখলেন তার স্বামীর জীবন আবারও বিপন্ন হতে। স্বামীর বন্দিত্ব। চোখের সামনে ঘটতে দেখলেন সেনাবাহিনীতে রক্তক্ষয়ী আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটতে। সিপাহী, জনতার অভ্যুত্থানে স্বামী জিয়াউর রহমানের মুক্তি আর তার রাষ্ট্রের কর্নধার হয়ে ওঠা। একজন মেজরের স্ত্রী থেকে সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর সহধর্মিনী হয়ে ওঠা—সময়ের ব্যবধান মাত্র ৪ বছর। এতটা বোধহয় মানুষ কল্পনাতেও ভাবতে পারে না, চাইতে পারে না।

এরপর খালেদা জীবন এগিয়েছে নিজস্ব এক দুর্বার গতিতে। সেই গতির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিয়তিই তাকে নিয়ে গেছে বিভিন্ন গন্তব্যে। জিয়াউ রহমান দেশের উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি। খালেদা ফার্স্টলেডি! এতটুকু অর্জনেই মানুষ বর্তে যায়, খালেদাও হয়তো বর্তে গিয়েছিলেন। তার জীবনে আর কিছু চাওয়া–পাওয়ার ছিল না। কিন্তু তিনি জানতেন না, তাকে আরও লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। তার জীবনে অর্জনের বাকি তখনও অনেক কিছুই।
১৯৮১ সালের ৩০ মে। বৃষ্টিস্নাত এক রাত! চট্টগ্রামে এক রাজনৈতিক সফরে গিয়ে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী কর্মকর্তার হাতে নৃশংসভাবে খুন হলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। খালেদার জীবনে নেমে এল ভয়াবহ এক সময়। বৈধব্যের কাল। দুই পুত্র তারেক আর আরাফাত তখনও নাবালক। কিন্তু খালেদার তখন আর শুধু দুই পুত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই। তার সামনে তখন অনেক বড় দায়িত্ব।
জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নিতে হলো তাকে। জিয়ার স্মৃতি ধরে রাখা, তার পরম্পরাকে সামনে নিয়ে যাওয়া—এসব দায়িত্বের পাশাপাশি খালেদাকে নেমে পড়তে হলো সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে। রাজনীতির কী বোঝেন তিনি? জীবনে তো ঘরকন্না ছাড়া আর কিছুই করেননি, কিছু করতেও চাননি। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ছিলেন, কিন্তু নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করতেন, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। সেই মানুষটিকেই কাঁধে তুলে নিতে হলো স্বামীর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব! সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষার কালও শুরু করতে হলো তাকে। পুলিশী নির্যাতন, নিপীড়ন সইতে হলো। রাজনীতির পরীক্ষায় নিজেকে উত্তীর্ণ করলেন ভালো নম্বর পেয়েই। নিজের মানসিক দৃঢ়তা আর ব্যক্তিত্বের জোরে বাঘা বাঘা রাজনীতিকদের সঙ্গে টক্কর দিতে থাকলেন। একসময় তিনি হয়ে উঠলেন দেশের রাজনীতির অন্যতম মুখ। তকমা পেলেন আপোষহীন এক নেত্রীর।
সেই আপোষহীন নেত্রীই দলকে নির্বাচনে বিজয়ী বানিয়ে হলেন দেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান। মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। এমন উত্থান–পতনের কাহিনি তো শুধু সিনেমার চিত্রনাট্যেই তৈরি করা সম্ভব। বিধি খালেদাকে এমনই এক রোমাঞ্চকর চিত্রনাট্যে সাজানো জীবন উপহার দিয়েছিল। ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ খালেদা যখন বঙ্গভবনে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন, তখন বাবা এস্কান্দার মজুমদার বেঁচে নেই। মা তৈয়বা মজুমদারের কী তখন পারিবারিক চিকিৎসক অবনী গোস্বামীর কথা মনে হচ্ছিল? তিনি জন্মমুহূর্তেই বলে দিয়েছিলেন, ‘আপনাদের মেয়েটি খুব ভাগ্যবতী।’

খালেদা জিয়া একজন সেনা কর্মকর্তার ঘরের গৃহিনী থেকে হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান চরিত্রগুলোর একজন। কোনো রাজনৈতিক পরিবারে তার জন্ম হয়নি। জীবনে কোনোদিন রাজনীতি করার কোনো ইচ্ছেও তার ছিল না। কিন্তু রাজনীতি যখন করতে বাধ্য হলেন, সেটি করলেন নিজের ব্যক্তিত্বকে ব্যবহার করে। কেউ তাকে রাজনীতি শেখায়নি। তিনি ঠেকে ঠেকে শিখেছেন। এই ক্ষমতা কিন্তু বিশেষই, এমনটা সবার থাকে না। সবাই পারে না।
খালেদা পেরেছেন। আরও দুই বার তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন। হত্যাকাণ্ডের শিকার স্বামীর পরম্পরাটা দারুণভাবে ধরে রেখেছেন। তবে সেই পথচলা মসৃণ ছিল না। রাজনীতির নোংরা খেলার ঝড়–ঝাপটা সামলাতে হয়েছে তাকে বারবারই। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রিত্বের পর তাকে আর তার পরিবারকেই রাজনীতির ময়দান থেকে বিলীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলেছে। তাকে স্বস্তি দেওয়া হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। রাজনীতির কারণে তাকে বাধ্য হয়েই একাকীত্বের জীবন কাটাতে হয়েছে। তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি বড় ছেলে তারেক রহমানকে কারাগারে যেতে হয়েছে, সইতে হয়েছে নির্যাতন। বেছে নিতে হয়েছে নির্বাসিত জীবন। নির্বাসিত জীবনেই মৃত্যুবরণ করেছেন তার আরেক উত্তরসূরি ছোটছেলে আরাফাত রহমান। এখানে শেষ হলেও হতো। কিন্তু তাকে যেতে হলো বন্দী জীবনে। একাকী কারাজীবন সঙ্গী হলো তার। পরিত্যক্ত কারাগারেই চলল তার কারাজীবন। একটা মানুষ নিজের জীবনে আর কতটা উত্থান–পতন দেখবেন, আর কতকিছু সহ্য করবেন।
সেই মানুষটিই জীবনের শেষ বেলায় এসে দেখলেন যারা তাকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল, তাদেরই করুণ পরিণতি। অনুকূল পরিবেশেও তার শত্রুদের নিয়ে একটা কটূকথাও তিনি মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেননি। নীরবে সর্বংসহা হয়েই এগিয়ে গেলেন তিনি অসীমের দিকে। পুরো দেশের মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে।
রূপকথার গল্প অবশ্যই নয়। এটি খালেদা জিয়ার জীবনের গল্প।
তথ্যসূত্র: খালেদা জিয়ার জীবনীগ্রন্থ ‘খালেদা’ লেখক:: মহিউদ্দিন আহমদ

১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে অল্প কিছু দিন। দিনাজপুরের এস্কান্দার পরিবারে জন্ম নিল ফুটফুটে এক মেয়ে শিশু। পারিবারিক চিকিৎসক ডা. অবনী গোস্বামী এস্কান্দার মজুমদারের কোলে শিশুটিকে তুলে দিয়ে বললেন, ‘নিন, আপনার মেয়ে। কেন যেন মনে হচ্ছে ও খুব ভাগ্যবতী!’
শিশুটি ভাগ্যবতীই ছিল। তার জীবনের পরবর্তী ৮০ বছরের গল্প যে রূপকথাকেও হার মানিয়ে দেয়। তার জীবন এতটাই ঘটনাবহুল আর রোমাঞ্চকর যে রূপকথার গল্প লিখিয়েরাও এত কিছু ভাবার সাহস পাবেন না। দিনাজপুরের এস্কান্দার বাড়ির সেই ছোট্ট শিশুটি যে একসময় দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাবে, দেশের মানুষের আশা–আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে উঠবে, ওই ধরনের কিছু ভাবার সাহস কী কেউ পেয়েছিলেন?
দিনাজপুরের এস্কান্দার পরিবারের সেই ছোট্ট, ফুটফুটে শিশুটি ছিল পুতুলের মতোই দেখতে। বাবা এস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার তাদের তৃতীয় কন্যার নাম পুতুলই রাখলেন। ভালো নাম খালেদা খানম। সেই খালেদা খানমেরই ১৯৬১ সালে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর খালেদা জিয়া হয়ে ওঠা।
খালেদা জিয়ার জীবনী লিখতে গেলে একজন লেখকের কাজটা কঠিন অনেকটাই। একটা মানুষের জীবনে এত মোড়, এত ঘটনাপ্রবাহ! জীবনের গতিপথই তাকে নিয়ে গেছে বিভিন্ন পর্যায়ে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে খালেদা যখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছেন, তখন প্রায় হঠাৎ করেই জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে। জীবনটা সেখান থেকেই তার বদলে যাওয়ার শুরু। দিনাজপুর শহরের আটপৌরে এক পারিবারিক জীবন থেকে সেনাকর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে এক ক্যান্টনমেন্ট থেকে অন্য ক্যান্টনমেন্টে ঘোরা। শান্ত–স্নিগ্ধ জীবনযাপনের মধ্যেই হঠাৎ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে অনিশ্চিত জীবন, বন্দিত্ব। স্বামী তখন চরে গেছেন দেশ মাতৃকার ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে। তিনি বেঁচে ফিরবেন কিনা, কোনো নিশ্চয়তা নেই। দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে নানা আশ্রয় খুঁজে বেরানো। মুক্তিযুদ্ধে এই দেশের সাধারণ মানুষের যে দুর্ভোগ, দুর্গতি, যে ত্যাগ—সেই ত্যাগের সঙ্গে খালেদা জিয়া মিলেমিশে একাকার।
স্বাধীন বাংলাদেশে স্বামী ফিরলেন বিজয়ীর বেশে। খালেদার জীবনেও এল পরিবর্তন। এক মেজরের স্ত্রী থেকে একেবারে সেনাবাহিনীর উপপ্রধানের স্ত্রী। কিন্তু খালেদার ব্যক্তিগত জীবন আগের মতোই রইল, স্বামী, সন্তানের কল্যাণই তার একমাত্র চিন্তা। স্বামীর সঙ্গে সর্বোচ্চ সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, ব্যস! এই পর্যন্তই।
তবে খালেদার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মোড় বোধহয় ১৯৭৫ সালটা। এক সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হলেন দেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। জিয়াউর রহমান হয়ে গেলেন দেশের সেনাবাহিনী প্রধান। কিন্তু সেনাবাহিনীতে পাল্টা অভ্যুত্থানে সে বছরেরই নভেম্বরে খালেদা দেখলেন তার স্বামীর জীবন আবারও বিপন্ন হতে। স্বামীর বন্দিত্ব। চোখের সামনে ঘটতে দেখলেন সেনাবাহিনীতে রক্তক্ষয়ী আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটতে। সিপাহী, জনতার অভ্যুত্থানে স্বামী জিয়াউর রহমানের মুক্তি আর তার রাষ্ট্রের কর্নধার হয়ে ওঠা। একজন মেজরের স্ত্রী থেকে সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীর সহধর্মিনী হয়ে ওঠা—সময়ের ব্যবধান মাত্র ৪ বছর। এতটা বোধহয় মানুষ কল্পনাতেও ভাবতে পারে না, চাইতে পারে না।

এরপর খালেদা জীবন এগিয়েছে নিজস্ব এক দুর্বার গতিতে। সেই গতির ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিয়তিই তাকে নিয়ে গেছে বিভিন্ন গন্তব্যে। জিয়াউ রহমান দেশের উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি। খালেদা ফার্স্টলেডি! এতটুকু অর্জনেই মানুষ বর্তে যায়, খালেদাও হয়তো বর্তে গিয়েছিলেন। তার জীবনে আর কিছু চাওয়া–পাওয়ার ছিল না। কিন্তু তিনি জানতেন না, তাকে আরও লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। তার জীবনে অর্জনের বাকি তখনও অনেক কিছুই।
১৯৮১ সালের ৩০ মে। বৃষ্টিস্নাত এক রাত! চট্টগ্রামে এক রাজনৈতিক সফরে গিয়ে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী কর্মকর্তার হাতে নৃশংসভাবে খুন হলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। খালেদার জীবনে নেমে এল ভয়াবহ এক সময়। বৈধব্যের কাল। দুই পুত্র তারেক আর আরাফাত তখনও নাবালক। কিন্তু খালেদার তখন আর শুধু দুই পুত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সুযোগ নেই। তার সামনে তখন অনেক বড় দায়িত্ব।
জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নিতে হলো তাকে। জিয়ার স্মৃতি ধরে রাখা, তার পরম্পরাকে সামনে নিয়ে যাওয়া—এসব দায়িত্বের পাশাপাশি খালেদাকে নেমে পড়তে হলো সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে। রাজনীতির কী বোঝেন তিনি? জীবনে তো ঘরকন্না ছাড়া আর কিছুই করেননি, কিছু করতেও চাননি। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ছিলেন, কিন্তু নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করতেন, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। সেই মানুষটিকেই কাঁধে তুলে নিতে হলো স্বামীর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব! সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষার কালও শুরু করতে হলো তাকে। পুলিশী নির্যাতন, নিপীড়ন সইতে হলো। রাজনীতির পরীক্ষায় নিজেকে উত্তীর্ণ করলেন ভালো নম্বর পেয়েই। নিজের মানসিক দৃঢ়তা আর ব্যক্তিত্বের জোরে বাঘা বাঘা রাজনীতিকদের সঙ্গে টক্কর দিতে থাকলেন। একসময় তিনি হয়ে উঠলেন দেশের রাজনীতির অন্যতম মুখ। তকমা পেলেন আপোষহীন এক নেত্রীর।
সেই আপোষহীন নেত্রীই দলকে নির্বাচনে বিজয়ী বানিয়ে হলেন দেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান। মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। এমন উত্থান–পতনের কাহিনি তো শুধু সিনেমার চিত্রনাট্যেই তৈরি করা সম্ভব। বিধি খালেদাকে এমনই এক রোমাঞ্চকর চিত্রনাট্যে সাজানো জীবন উপহার দিয়েছিল। ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ খালেদা যখন বঙ্গভবনে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন, তখন বাবা এস্কান্দার মজুমদার বেঁচে নেই। মা তৈয়বা মজুমদারের কী তখন পারিবারিক চিকিৎসক অবনী গোস্বামীর কথা মনে হচ্ছিল? তিনি জন্মমুহূর্তেই বলে দিয়েছিলেন, ‘আপনাদের মেয়েটি খুব ভাগ্যবতী।’

খালেদা জিয়া একজন সেনা কর্মকর্তার ঘরের গৃহিনী থেকে হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান চরিত্রগুলোর একজন। কোনো রাজনৈতিক পরিবারে তার জন্ম হয়নি। জীবনে কোনোদিন রাজনীতি করার কোনো ইচ্ছেও তার ছিল না। কিন্তু রাজনীতি যখন করতে বাধ্য হলেন, সেটি করলেন নিজের ব্যক্তিত্বকে ব্যবহার করে। কেউ তাকে রাজনীতি শেখায়নি। তিনি ঠেকে ঠেকে শিখেছেন। এই ক্ষমতা কিন্তু বিশেষই, এমনটা সবার থাকে না। সবাই পারে না।
খালেদা পেরেছেন। আরও দুই বার তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন। হত্যাকাণ্ডের শিকার স্বামীর পরম্পরাটা দারুণভাবে ধরে রেখেছেন। তবে সেই পথচলা মসৃণ ছিল না। রাজনীতির নোংরা খেলার ঝড়–ঝাপটা সামলাতে হয়েছে তাকে বারবারই। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রিত্বের পর তাকে আর তার পরিবারকেই রাজনীতির ময়দান থেকে বিলীন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলেছে। তাকে স্বস্তি দেওয়া হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। রাজনীতির কারণে তাকে বাধ্য হয়েই একাকীত্বের জীবন কাটাতে হয়েছে। তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি বড় ছেলে তারেক রহমানকে কারাগারে যেতে হয়েছে, সইতে হয়েছে নির্যাতন। বেছে নিতে হয়েছে নির্বাসিত জীবন। নির্বাসিত জীবনেই মৃত্যুবরণ করেছেন তার আরেক উত্তরসূরি ছোটছেলে আরাফাত রহমান। এখানে শেষ হলেও হতো। কিন্তু তাকে যেতে হলো বন্দী জীবনে। একাকী কারাজীবন সঙ্গী হলো তার। পরিত্যক্ত কারাগারেই চলল তার কারাজীবন। একটা মানুষ নিজের জীবনে আর কতটা উত্থান–পতন দেখবেন, আর কতকিছু সহ্য করবেন।
সেই মানুষটিই জীবনের শেষ বেলায় এসে দেখলেন যারা তাকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল, তাদেরই করুণ পরিণতি। অনুকূল পরিবেশেও তার শত্রুদের নিয়ে একটা কটূকথাও তিনি মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেননি। নীরবে সর্বংসহা হয়েই এগিয়ে গেলেন তিনি অসীমের দিকে। পুরো দেশের মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে।
রূপকথার গল্প অবশ্যই নয়। এটি খালেদা জিয়ার জীবনের গল্প।
তথ্যসূত্র: খালেদা জিয়ার জীবনীগ্রন্থ ‘খালেদা’ লেখক:: মহিউদ্দিন আহমদ