ওমর ফারুক মরল কীসে, নির্যাতন নাকি অন্য কিছু?

ওমর ফারুক মরল কীসে, নির্যাতন নাকি অন্য কিছু?
ওমর ফারুক। ছবি: চরচা

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় চুরির অভিযোগে ওমর ফারুক হোসেন (৩৯) নামের এক ভ্যানচালককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ তুলেছে তার পরিবার। তবে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই যুবক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অসুস্থতাজনিত কারণে মারা গেছেন।

মৃত ওমর ফারুক হোসেন উপজেলার চানপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এ ঘটনায় তিনজনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বাগমারা থানা পুলিশ। এ ঘটনায় একটি মামলা হলেও তাতে তোলা অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

পরিবার যা বলছে

ওমর ফারুকের বাবা মোসলেম সরদারের অভিযোগ–তার ছেলে ওমর ফারুক সিএনজি স্ট্যান্ডে প্রস্রাব করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ধরে নিয়ে হাতে-পায়ে পেরেক মেরে তাকে নির্যাতন করা হয়। স্বজনদের দাবি, সঠিক চিকিৎসার অভাবেই তার মৃত্যু হয়েছে।

পরিবারের দাবি, ওমর ফারুক পেশায় একজন ভ্যান চালক ছিলেন। ঘটনার দিন বেলা ২টার দিকে তিনি ভ্যান চালাতে বাড়ি থেকে বের হন। ফারুকের বাবা মোসলেম সরদার বেলা ৩টার দিকে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর সন্ধ্যায় ফারুক ভাড়া নিয়ে দুজন যাত্রীসহ ভবানীগঞ্জ সিএনজি স্ট্যান্ডের কাছে যান। স্ট্যান্ডের পাশে প্রস্রাব করতে গেলে ব্যাটারি চুরির অভিযোগ তুলে ওমর ফারুককে ধরা হয় এবং তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়।

ওমর ফারুকের বাবার অভিযোগ, টর্চলাইট দিয়ে ফারুকের মাথায় আঘাত করা হয়। গাছের সাথে ঝুলিয়ে দুই হাতে পেরেক মারা হয় এবং পায়ুপথে মরিচের গুঁড়া ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি খেতে চাইলে তাকে বারবার পানিতে চুবানো হয়। এমনকি ফারুকের এক চাচার কাছে পানি খেতে চাইলে তাকেও বাধা দেওয়া হয় এবং মারধর করা হয়। ওমর ফারুককে উলঙ্গ অবস্থায় সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল।

পরে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে নিয়ে গেলে তাকে ১০০ টাকা জরিমানা ও সাত দিনের জেল দেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে ‘চালান’ করে দেওয়া হয় এবং গত ২০ ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওমর ফারুকের মৃত্যু হয়।

ওমর ফারুকের মৃত্যুর পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পরিবারের তোলা অভিযোগকে ভিত্তি ধরেই খবর প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে মব তৈরি করে চুরির অভিযোগে পিটিয়ে ওমর ফারুককে ২ ঘণ্টা নির্যাতন করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে ওমর ফারুকের হাতে-পায়ে পেরেক মারার পাশাপাশি মলদ্বারে মরিচের গুঁড়া দেওয়া হয় বলে পরিবারের বরাতে উল্লেখ করা হয়। যদিও ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তার ভাষ্য অন্যরকম।

প্রত্যক্ষদর্শীরা কী বলছে?

এ বিষয়ে প্রশাসনের বক্তব্য শোনার আগে প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের বক্তব্য আগে জেনে নেওয়া যাক।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় উপজেলার ভবানীগঞ্জ সিএনজি স্ট্যান্ডের পাশে এক ব্যক্তির অটোরিকশা থেকে ব্যাটারি চুরির চেষ্টা করেন ওমর ফারুক।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পালানোর চেষ্টা করলে স্থানীয়রা তাকে ধাওয়া দিয়ে ধরে কিল-ঘুষি মারে এবং পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম ভুঞার দপ্তরে সোপর্দ করে।

এদিকে ওমর ফারুকের গ্রাম চানপাড়ার স্থানীরা বলছেন, ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ছোটখাটো চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ ছিল আগে থেকেই। বিশেষত অটোরিকশা ও ভ্যানের ব্যাটারি, সিএনজিচালিত যানবাহনের লুকিং গ্লাস চুরির অভিযোগ ছিল। এ ধরনের ঘটনায় এর আগেও তিনি মারধরের শিকার হয়েছেন।

পিটুনির পর এভাবেই রাস্তায় পড়ে ছিলেন ওমর ফারুক। ছবি: চরচা
পিটুনির পর এভাবেই রাস্তায় পড়ে ছিলেন ওমর ফারুক। ছবি: চরচা

প্রশাসন যা বলছে

ঘটনা সম্পর্কে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম ভুঞা জানান, ওই দিন ওমর ফারুককে তার কাছে নিয়ে এলে তার কাছে ১০ গ্রাম গাঁজা পাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাকে ১০০ টাকা জরিমানা ও ৭ দিনের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

সাইফুল ইসলাম ভুঞা বলেন, “পরদিন (১৮ ডিসেম্বর) কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে ওমর ফারুককে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শনিবার তার মৃত্যু হয়।”

বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইদুল আলম চরচাকে বলেন, “গত ১৭ ডিসেম্বর ওমর ফারুককে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দেওয়ার পর পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছিল। পুলিশ তাকে কিছুটা অসুস্থ অবস্থায় পেয়েছিল এবং বাগমারা হাসপাতালে (উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র) প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর সেই দিন রাতে তাকে জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”

নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে সাইদুল আলম বলেন, বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করে দেখছে।

জেল সুপার তাকে কী অবস্থায় পেয়েছে

রাজশাহী জেলা কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শাহ আলম খান বলেন, “গত ১৭ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে ওমর ফারুককে রাজশাহী কারাগারে আনা হয়। জেলখানায় তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর ১৮ ডিসেম্বর তাকে চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০ ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।”

দুই হাসপাতালে চিকিৎসা, অতঃপর মৃত্যু

বাগমারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর ওমর ফারুককে হাসপাতালে নিয়ে আসে পুলিশ। হাসপাতালটির চিকিৎসক সাকলাইন হোসেন বলেন, “ওমর ফারুকের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোলা ও জখম ছিল।”

পুলিশ ও জেলা কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়ার পর ওমর ফারুককে কারাগারে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি আবার অসুস্থ হলে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়। রামেক হাসপাতালে ওমর ফারুক ছিলেন ৪৩ ঘণ্টা ২৫ মিনিট। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র ডা. শংকর কে বিশ্বাস জানান, নিহত ওমর ফারুক গত ১৮ ডিসেম্বর রাত ৪টা ৪০ মিনিটে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ২০ ডিসেম্বর রাত ১২টা ৫ মিনিটে তিনি মারা যান। হাসপাতালে তাকে হৃদেরোগ ও ডায়াবেটিসজনিত সমস্যার জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয়।

ময়নাতদন্তে কী পাওয়া গেল

যদিও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. শারমিন সোবহান কাবেরি জানান, প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে নিহতের শরীরে পেরেক মারার মতো কোনো গভীর ক্ষত বা মলদ্বারে মরিচের গুঁড়া দেওয়ার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

ডা. শারমিন বলেন, “ওমর ফারুকের কিডনি জটিলতা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ ছিল। শরীরে কিছু হালকা ছিলে যাওয়ার দাগ থাকলেও সেগুলো পুরোনো। ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট এলে মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।”

মামলা নিয়ে প্রশ্ন

শুরুতে ওমর ফারুকের মৃত্যুতে মব করে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ করা হলেও কোনো মামলা করা হয়নি। পরে গত ২৫ ডিসেম্বর ওমর ফারুকের বাবা মোসলেম সরদার বাদি হয়ে বাগমারা থানায় মামলা দায়ের করেন। শোকাতুর অবস্থায় শুরুতে অনেকের নাম বলতে না পারলেও পরে অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়।

এর আগে তদন্তের প্রয়োজনে প্রথমে গত ২৩ ডিসেম্বর তিনজনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা হলেন—রহিদুল ইসলাম (৪৫), জুয়েল রানা (৩৫) ও মুকুল হোসেন (৪৪)। এর মধ্যে দুজনকে মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে রাখা হয় এবং মুকুল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু বাদী মোসলেম সরদারের করা মামলায় পরে যে ১২ জনের নাম উল্লেখ করা হয়, সেখানে মুকুল হোসেনের নাম উল্লেখ করা হয়।

এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন–দেউলা গ্রামের রেজাউল করিম, বিপ্লব ওরফে ভুট্টো ড্রাইভার, রহিদুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, মাঝিগ্রামের আবদুল মতিন, দানগাছি গ্রামের মুকুল হোসেন (মুরগি মুকুল), জুয়েল রানা (ভাংড়ি জুয়েল), দরগামাড়িয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম, ভবানীগঞ্জের আসাদুল ইসলাম, আবদুস সালাম, মোজাম্মেল হক ও আবদুল হান্নান।

ওমর ফারুক মোসলেম সরদারের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার তিনি চান। প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নিজের করা মামলায় উল্লিখিত ১২ আসামির মধ্যে তিনি দেউলা গ্রামের রেজাউল করিম ছাড়া বাকি ১১ জনের কারও নাম বলতে পারেননি। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “মাথা ঠিক নাই। আমি এই মুহূর্তে কারও নাম বলতে পারব না। পরে বলব।”

প্রশাসনের সহযোগিতা সম্পর্কে মোসলেম বলেন, শুরুতে স্থানীয় চেয়ারম্যান বা মেম্বাররা পাশে না দাঁড়ালেও ঘটনার পাঁচ দিন পর প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের বাড়িতে আসেন।

ওমর ফারুক মরলেন কীভাবে

শেষ পর্যন্ত এ প্রশ্নই প্রধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে–ওমর ফারুক আসলে ঠিক কী কারণে মারা গেলেন? পরিবারের অভিযোগকে সত্য মানলে তিনি পিটুনিসহ ভয়াবহ নির্যাতন এবং সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার কারণেই মারা গেছেন। যদিও ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তার বয়ান বলছে, ওমর ফারুকের হাতে পায়ে পেরেক ঠোকার যে বর্ণনা তার পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, তা সত্য নয়। এমন কোনো আলামত তার শরীরে ছিল না।

ওমর ফারুকের মৃত্যুর কারণ তাই এখনো ধোঁয়াশাপূর্ণ। এর একমাত্র উত্তর দিতে পারে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদন হাতে পেলেই কেবল ওমর ফারুকের মৃত্যুর সঠিক কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

সম্পর্কিত