আরমান ভূঁইয়া

ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ কাজের তাগিদে বের হয়; কিন্তু ফেরে না সবাই। কারও কারও ফেরা থেমে যায় হঠাৎ, নিষ্ঠুরভাবে। ককটেলের এক বিস্ফোরণে থেমে গেছে কিশোর সিয়ামের জীবন, আর সেই সঙ্গে ভেঙে পড়েছে একটি দরিদ্র পরিবারের শেষ আশ্রয়, শেষ ভরসা।
গত বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারে ককটেল বিস্ফোরণে নিহত হন সিয়াম। সেখানে ‘জাহিদ কার ডেকোরেশন’ নামের এক দোকানে কাজ করতেন সিয়াম। সেদিন সন্ধ্যায় দোকানমালিক সিয়ামকে নাস্তা আনতে পাঠিয়েছিলেন। চা-পরোটা আনতে গিয়ে ফ্লাইওভারের ওপর থেকে ছোড়া একটি ককটেল সরাসরি গিয়ে পড়ে তার মাথায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সিয়ামের।
সিয়াম ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। তার একমাত্র ছোট ভাই সিজান মজুমদারও একটি কার ডেকোরেশনের দোকানে কাজ শিখছে।
তাদের গ্রামের বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া থানার দেবনগরে। প্রায় চার বছর আগে সংসারের চাপ আর প্রায় ২০ লাখ টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে মা সিজা বেগম ও তার স্বামী আলী আকবর মজুমদার দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। জীবিকার তাগিদে এসে বড় ছেলে সিয়ামকে একটি মোটর পার্টসের দোকানে কাজে দেন। টানা চার বছর ওই দোকানেই কাজ করছিলেন তিনি।
গত বুধবার তাদের বড় ছেলে সিয়াম মারা যাওয়ার পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের ছেলের ময়নাতদন্ত হয়। সেদিন তারা ছেলেকে নিয়ে খুলনার গ্রামের বাড়ি যান। সেখানেই সিয়ামের দাফন সম্পন্ন হয়। এরপর আবার কাজের তাগিদে শনিবার ঢাকায় আসেন।
বর্তমানে তারা ঢাকার নিউ ইস্কাটনে ১০০ নম্বর বাড়িতে নিচতলায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন। মা সিজা বেগম বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। আর বাবা আলী আকবর রিকশা চালান। রোববার দুপুরে নিউ ইস্কাটনে সিজা বেগম ও আলী আকবরের ছোট ঘরে বসেই তাদের সঙ্গে কথা হয়। সঙ্গে ছিল তাদের ছোট ছেলে সিজানও। এ সময় তারা প্রত্যেকেই কান্না করছিলেন।
“আমার ছেলের মাথার খুলি রাস্তায় ছিটকে পড়ে”–কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন সিজা বেগম। বলেন, “রক্তে পুরো রাস্তা ভিজে গিয়েছিল।”
ঘটনার সময় কাজে ছিলেন বলে জানান মা সিজা বেগম। হঠাৎ বোন ফোন করে তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেন। সিজা বেগমের ভাষায়, “বলে–তাড়াতাড়ি আসো, মনে হয় বাবা আর নেই।” কথাগুলো বলতে গিয়ে থেমে যান তিনি। “আমি গিয়ে দেখি আমার বাবার দুইটা পা পড়ে আছে। পুরো শরীর আমি দেখতে পারিনি। প্রশাসনের লোকজন আমার বাবাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়”, বলেন সিজা বেগম।
সিয়ামের মা জানান, ছেলেটা যখন ছোট ছিল, তখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সংসারে তখন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। টাকা ছিল না। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করার কোনো পথও খোলা ছিল না। তখন তার কাছে একটা নতুন কাপড় ছিল। সেই নতুন কাপড় বিক্রি করে ছেলেকে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল।
সেই কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন সিজা বেগম। বলেন, “তখন যদি আমার ছেলে মারা যাইত, আমি মনকে বুঝাইতে পারতাম। কিন্তু এত কষ্ট করে বড় করলাম, এখন সে সংসারের হাল ধরতে শুরু করছে, ঠিক সেই সময় আমার কাছ থেইকা কাইড়া নিল। এই কষ্ট আমি কীভাবে মানি নিব? সন্তান ছাড়া একটা মা কীভাবে বাঁচে?”
সিয়াম ছিল পরিবারের স্বপ্ন। বিদেশে যাওয়ার কথা চলছিল। তাদের কিছু আত্মীয়স্বজন সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় থাকেন। তারাও চেয়েছিলেন সিয়ামকে বিদেশে নিতে, ঋণ শোধ করতে। এসব কথা জানিয়ে মা বলেন, “সে বলত, আম্মু, আইডি কার্ড বানামু, তারপর বাইরে যামু। তোমার কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকব না।”
সংসারের বাস্তবতা ছিল কঠিন। সিয়ামের বাবা আলী আকবর মজুমদার রিকশা চালাতেন। কোনো দিন ২০০-৩০০ টাকা, কোনো দিন আবার ১ হাজার টাকা আয় করতেন। ১০ হাজার টাকা ঘরভাড়া, সংসারের খরচ, ঋণের কিস্তি, চিকিৎসা-সব মিলিয়ে জীবন ছিল যুদ্ধের মতো। “অনেক দিন আলু ভর্তা আর শাক দিয়া ভাত খাইছি। ছেলেদের মাছ-মাংস খাওয়াইতে পারি নাই”—বলেন সিয়ামের মা।
সিয়ামের বাবা আলী আকবর মজুমদার বলেন, “আমার বড় ছেলেই ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। সে বেতন পাইলে আগে বাড়িভাড়া দিত। নিজের জন্য কিছু চাইত না।”
আলী আকবর জানান, শুরুতে সিয়ামের বেতন ছিল ৮ হাজার টাকা, পরে মালিক বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করেন। মালিকও তার মৃত্যুর পর কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, সিয়াম ছিল শান্ত ও ধার্মিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, কোরআন খতম দিয়েছিল। কাজ ছাড়া কোথাও আড্ডা দিত না। রাত ১০টার মধ্যে বাসায় ফিরত। কখনো বলত, যদি একটু টাকা জোগাড় করে ছোট একটা দোকান দিতে পারত, তাহলে হয়তো বিদেশেও যেতে হতো না। ছোট ভাইটার জন্য কিছু করতে পারত।
দুই ভাইয়ের মধ্যে সিয়ামই এসএসসির গণ্ডী পেরিয়েছিলেন। আলী আকবর বলেন, বড় ছেলে সিয়াম এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কিন্তু টাকার জন্য আর পড়াশোনা করতে পারেনি। তার ছোট ছেলেও ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এরপর থেকে একটি গাড়ির দোকানে কাজ শিখছে।
গত ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার ঘটনা বলতে গিয়ে বাবা আলী আকবর বলেন, রিকশা চালানোর সময় হঠাৎ একটি বিকট শব্দ শুনে তার বুক কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণ পর জানতে পারেন, সিয়ামের সঙ্গে ‘ঝামেলা’ হয়েছে। ফোন করতে গিয়ে দেখেন সিয়ামের ফোন বন্ধ। পরে আত্মীয়দের কাছ থেকে নিশ্চিত হন–তার ছেলে আর নেই। তিনি বলেন, “ঘটনাস্থলে গিয়ে চারদিকে শুধু রক্ত দেখছি। আমার ছেলের পাশে ছিটিয়ে আছে মাথার মগজ। তারপর আর কিছু মনে নাই।”
সিয়ামের মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। আলী আকবর বলেন, “আমি সরকারের কাছে, পুলিশের কাছে বিচার চাই। যেন আর কারও বুক আমার মতো খালি না হয়।”
সিয়ামের মৃত্যুতে জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়ে যাওয়া এ পরিবার ভীষণ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সিয়ামের বাবা জানান, লাশ দাফন পর্যন্ত পুলিশ সহযোগিতা করলেও এরপর আর কোনো সরকারি সংস্থা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
নিহত কিশোর সিয়ামের বাবা আলী আকবর মজুমদার বলেন, “২৪ তারিখ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আমি প্রথম খবরটা পাই। খবর শোনার পরপরই ছুটে যাই, কিন্তু তখনো ছেলের লাশ পাই নাই। রাত আটটার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়েও লাশ পাই নাই। ততক্ষণে পুলিশ লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “যেদিন আমার ছেলে মারা যায়, সেদিন আমি চারজন বন্ধুকে নিয়ে থানায় ছিলাম। পুলিশ মামলা-সংক্রান্ত কাজকর্ম করেছে। পরদিন সকালে প্রায় ১০টার দিকে আমরা ঢাকা মেডিকেলে যাই। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বুঝে পেতে অনেক সময় লাগছে। আসরের নামাজের সময় আমরা হাসপাতাল থেকে বের হই।”
আলী আকবর জানান, “ঢাকা থেকে লাশ এনে স্কার্টন গার্ডেন এলাকার গলি মসজিদে জানাজা পড়ানো হয়। এরপর সন্ধ্যার দিকে লাশ খুলনায় নিয়ে যাই। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে সেখানে দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজার সময় অনেক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন, দিঘলিয়া থানার পুলিশও ছিল। তারা আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।”
‘আমার বাকি ছেলেটার দিকে তাকান’
ছেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সহিংসতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিয়ামের মা সিজা বেগম বলেন, “আমি কারও নাম ধরে দোষ দেই না। তারেক জিয়া যেদিন ঢাকায় আসছে, সেদিনই (আসলে তার আগের রাতে) আমার ছেলে শহীদ হইছে। তার আসাকে কেন্দ্র করে ওই দিন যে সন্ত্রাস হইছে, সেই জন্যই আমার ছেলেটা মরছে।”
তিনি বলেন, “কপালের কী দোষ–ককটেলটা গিয়ে পড়ল আমার ছেলের মাথায়। এখন আমার ছেলেটা আর নাই।”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমি কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধ চাই না। আমি শুধু অনুরোধ করি যাদের কারণে, যে উপলক্ষেই এই ঘটনা ঘটুক–তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমার আরেকটা ছেলে এখনো বেঁচে আছে। ওর ভবিষ্যতের জন্য যদি কেউ কিছু করে, তাহলে হয়তো আমি আমার বড় ছেলের শোকটা কিছুটা হলেও সইতে পারব।”
তিনি আরও বলেন, “আমি একজন মা। আমার ছেলেকে আমি আর ফেরত পাব না। কিন্তু আমার বাকি সন্তানটা যেন পথে বসে না যায়–এটুকুই আমার শেষ আকুতি।”

ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ কাজের তাগিদে বের হয়; কিন্তু ফেরে না সবাই। কারও কারও ফেরা থেমে যায় হঠাৎ, নিষ্ঠুরভাবে। ককটেলের এক বিস্ফোরণে থেমে গেছে কিশোর সিয়ামের জীবন, আর সেই সঙ্গে ভেঙে পড়েছে একটি দরিদ্র পরিবারের শেষ আশ্রয়, শেষ ভরসা।
গত বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারে ককটেল বিস্ফোরণে নিহত হন সিয়াম। সেখানে ‘জাহিদ কার ডেকোরেশন’ নামের এক দোকানে কাজ করতেন সিয়াম। সেদিন সন্ধ্যায় দোকানমালিক সিয়ামকে নাস্তা আনতে পাঠিয়েছিলেন। চা-পরোটা আনতে গিয়ে ফ্লাইওভারের ওপর থেকে ছোড়া একটি ককটেল সরাসরি গিয়ে পড়ে তার মাথায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সিয়ামের।
সিয়াম ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। তার একমাত্র ছোট ভাই সিজান মজুমদারও একটি কার ডেকোরেশনের দোকানে কাজ শিখছে।
তাদের গ্রামের বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া থানার দেবনগরে। প্রায় চার বছর আগে সংসারের চাপ আর প্রায় ২০ লাখ টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে মা সিজা বেগম ও তার স্বামী আলী আকবর মজুমদার দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। জীবিকার তাগিদে এসে বড় ছেলে সিয়ামকে একটি মোটর পার্টসের দোকানে কাজে দেন। টানা চার বছর ওই দোকানেই কাজ করছিলেন তিনি।
গত বুধবার তাদের বড় ছেলে সিয়াম মারা যাওয়ার পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের ছেলের ময়নাতদন্ত হয়। সেদিন তারা ছেলেকে নিয়ে খুলনার গ্রামের বাড়ি যান। সেখানেই সিয়ামের দাফন সম্পন্ন হয়। এরপর আবার কাজের তাগিদে শনিবার ঢাকায় আসেন।
বর্তমানে তারা ঢাকার নিউ ইস্কাটনে ১০০ নম্বর বাড়িতে নিচতলায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন। মা সিজা বেগম বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। আর বাবা আলী আকবর রিকশা চালান। রোববার দুপুরে নিউ ইস্কাটনে সিজা বেগম ও আলী আকবরের ছোট ঘরে বসেই তাদের সঙ্গে কথা হয়। সঙ্গে ছিল তাদের ছোট ছেলে সিজানও। এ সময় তারা প্রত্যেকেই কান্না করছিলেন।
“আমার ছেলের মাথার খুলি রাস্তায় ছিটকে পড়ে”–কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন সিজা বেগম। বলেন, “রক্তে পুরো রাস্তা ভিজে গিয়েছিল।”
ঘটনার সময় কাজে ছিলেন বলে জানান মা সিজা বেগম। হঠাৎ বোন ফোন করে তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেন। সিজা বেগমের ভাষায়, “বলে–তাড়াতাড়ি আসো, মনে হয় বাবা আর নেই।” কথাগুলো বলতে গিয়ে থেমে যান তিনি। “আমি গিয়ে দেখি আমার বাবার দুইটা পা পড়ে আছে। পুরো শরীর আমি দেখতে পারিনি। প্রশাসনের লোকজন আমার বাবাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়”, বলেন সিজা বেগম।
সিয়ামের মা জানান, ছেলেটা যখন ছোট ছিল, তখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সংসারে তখন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। টাকা ছিল না। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করার কোনো পথও খোলা ছিল না। তখন তার কাছে একটা নতুন কাপড় ছিল। সেই নতুন কাপড় বিক্রি করে ছেলেকে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল।
সেই কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন সিজা বেগম। বলেন, “তখন যদি আমার ছেলে মারা যাইত, আমি মনকে বুঝাইতে পারতাম। কিন্তু এত কষ্ট করে বড় করলাম, এখন সে সংসারের হাল ধরতে শুরু করছে, ঠিক সেই সময় আমার কাছ থেইকা কাইড়া নিল। এই কষ্ট আমি কীভাবে মানি নিব? সন্তান ছাড়া একটা মা কীভাবে বাঁচে?”
সিয়াম ছিল পরিবারের স্বপ্ন। বিদেশে যাওয়ার কথা চলছিল। তাদের কিছু আত্মীয়স্বজন সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় থাকেন। তারাও চেয়েছিলেন সিয়ামকে বিদেশে নিতে, ঋণ শোধ করতে। এসব কথা জানিয়ে মা বলেন, “সে বলত, আম্মু, আইডি কার্ড বানামু, তারপর বাইরে যামু। তোমার কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকব না।”
সংসারের বাস্তবতা ছিল কঠিন। সিয়ামের বাবা আলী আকবর মজুমদার রিকশা চালাতেন। কোনো দিন ২০০-৩০০ টাকা, কোনো দিন আবার ১ হাজার টাকা আয় করতেন। ১০ হাজার টাকা ঘরভাড়া, সংসারের খরচ, ঋণের কিস্তি, চিকিৎসা-সব মিলিয়ে জীবন ছিল যুদ্ধের মতো। “অনেক দিন আলু ভর্তা আর শাক দিয়া ভাত খাইছি। ছেলেদের মাছ-মাংস খাওয়াইতে পারি নাই”—বলেন সিয়ামের মা।
সিয়ামের বাবা আলী আকবর মজুমদার বলেন, “আমার বড় ছেলেই ছিল পরিবারের একমাত্র ভরসা। সে বেতন পাইলে আগে বাড়িভাড়া দিত। নিজের জন্য কিছু চাইত না।”
আলী আকবর জানান, শুরুতে সিয়ামের বেতন ছিল ৮ হাজার টাকা, পরে মালিক বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করেন। মালিকও তার মৃত্যুর পর কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, সিয়াম ছিল শান্ত ও ধার্মিক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, কোরআন খতম দিয়েছিল। কাজ ছাড়া কোথাও আড্ডা দিত না। রাত ১০টার মধ্যে বাসায় ফিরত। কখনো বলত, যদি একটু টাকা জোগাড় করে ছোট একটা দোকান দিতে পারত, তাহলে হয়তো বিদেশেও যেতে হতো না। ছোট ভাইটার জন্য কিছু করতে পারত।
দুই ভাইয়ের মধ্যে সিয়ামই এসএসসির গণ্ডী পেরিয়েছিলেন। আলী আকবর বলেন, বড় ছেলে সিয়াম এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কিন্তু টাকার জন্য আর পড়াশোনা করতে পারেনি। তার ছোট ছেলেও ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এরপর থেকে একটি গাড়ির দোকানে কাজ শিখছে।
গত ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার ঘটনা বলতে গিয়ে বাবা আলী আকবর বলেন, রিকশা চালানোর সময় হঠাৎ একটি বিকট শব্দ শুনে তার বুক কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণ পর জানতে পারেন, সিয়ামের সঙ্গে ‘ঝামেলা’ হয়েছে। ফোন করতে গিয়ে দেখেন সিয়ামের ফোন বন্ধ। পরে আত্মীয়দের কাছ থেকে নিশ্চিত হন–তার ছেলে আর নেই। তিনি বলেন, “ঘটনাস্থলে গিয়ে চারদিকে শুধু রক্ত দেখছি। আমার ছেলের পাশে ছিটিয়ে আছে মাথার মগজ। তারপর আর কিছু মনে নাই।”
সিয়ামের মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে একটি মামলা হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। আলী আকবর বলেন, “আমি সরকারের কাছে, পুলিশের কাছে বিচার চাই। যেন আর কারও বুক আমার মতো খালি না হয়।”
সিয়ামের মৃত্যুতে জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়ে যাওয়া এ পরিবার ভীষণ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সিয়ামের বাবা জানান, লাশ দাফন পর্যন্ত পুলিশ সহযোগিতা করলেও এরপর আর কোনো সরকারি সংস্থা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
নিহত কিশোর সিয়ামের বাবা আলী আকবর মজুমদার বলেন, “২৪ তারিখ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আমি প্রথম খবরটা পাই। খবর শোনার পরপরই ছুটে যাই, কিন্তু তখনো ছেলের লাশ পাই নাই। রাত আটটার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়েও লাশ পাই নাই। ততক্ষণে পুলিশ লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “যেদিন আমার ছেলে মারা যায়, সেদিন আমি চারজন বন্ধুকে নিয়ে থানায় ছিলাম। পুলিশ মামলা-সংক্রান্ত কাজকর্ম করেছে। পরদিন সকালে প্রায় ১০টার দিকে আমরা ঢাকা মেডিকেলে যাই। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বুঝে পেতে অনেক সময় লাগছে। আসরের নামাজের সময় আমরা হাসপাতাল থেকে বের হই।”
আলী আকবর জানান, “ঢাকা থেকে লাশ এনে স্কার্টন গার্ডেন এলাকার গলি মসজিদে জানাজা পড়ানো হয়। এরপর সন্ধ্যার দিকে লাশ খুলনায় নিয়ে যাই। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে সেখানে দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজার সময় অনেক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন, দিঘলিয়া থানার পুলিশও ছিল। তারা আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।”
‘আমার বাকি ছেলেটার দিকে তাকান’
ছেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সহিংসতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সিয়ামের মা সিজা বেগম বলেন, “আমি কারও নাম ধরে দোষ দেই না। তারেক জিয়া যেদিন ঢাকায় আসছে, সেদিনই (আসলে তার আগের রাতে) আমার ছেলে শহীদ হইছে। তার আসাকে কেন্দ্র করে ওই দিন যে সন্ত্রাস হইছে, সেই জন্যই আমার ছেলেটা মরছে।”
তিনি বলেন, “কপালের কী দোষ–ককটেলটা গিয়ে পড়ল আমার ছেলের মাথায়। এখন আমার ছেলেটা আর নাই।”
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমি কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধ চাই না। আমি শুধু অনুরোধ করি যাদের কারণে, যে উপলক্ষেই এই ঘটনা ঘটুক–তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমার আরেকটা ছেলে এখনো বেঁচে আছে। ওর ভবিষ্যতের জন্য যদি কেউ কিছু করে, তাহলে হয়তো আমি আমার বড় ছেলের শোকটা কিছুটা হলেও সইতে পারব।”
তিনি আরও বলেন, “আমি একজন মা। আমার ছেলেকে আমি আর ফেরত পাব না। কিন্তু আমার বাকি সন্তানটা যেন পথে বসে না যায়–এটুকুই আমার শেষ আকুতি।”