আবু নওফেল সাজিদ

সব নতুন স্মার্টফোনে একটি রাষ্ট্র-পরিচালিত সাইবার নিরাপত্তা অ্যাপ প্রি-লোড করা বাধ্যতামূলক করে একটি আদেশ সম্প্রতি জারি করেছে ভারত সরকার। এ আদেশের ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নজরদারি নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে বিতর্কের একপর্যায়ে এটি বাতিল হলেও দেশটির সরকারের তরফ থেকে নেওয়া এ উদ্যোগ জনমনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
গত ১ ডিসেম্বর নতুন এ আদেশ প্রকাশ্যে আসে। আদেশে বলা হয়, স্মার্টফোন প্রস্তুতকারকদের ৯০ দিনের মধ্যে সব নতুন ডিভাইসে সরকারের ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপটি আগে থেকেই লোড করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
আদেশের সবচেয়ে উদ্বেগজনক অংশ ছিল–অ্যাপটির কার্যকারিতা বন্ধ বা সীমাবদ্ধ করা যাবে না। সরকার বিষয়টি নিয়ে জানায়, এটি নাগরিকদের হ্যান্ডসেটের যাচাই এবং হ্যান্ডসেটের সন্দেহজনক অপব্যবহার রোধ বা এ সম্পর্কিত রিপোর্ট করার জন্য প্রয়োজন।
বিশ্বের বৃহত্তম এই ফোন বাজারে সরকারের এমন পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এটি নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করছে।
অ্যাপের মূল ধারণাকে সহজ বলছে ভারত সরকার। তাদের দাবি, ব্যবহারকারীদের হ্যান্ডসেট যাচাই, হারানো বা চুরি যাওয়া ফোন ব্লক এবং সন্দেহজনক কল চিহ্নিত করার জন্য অ্যাপটি সাহায্য করবে। যদিও তীব্র সমালোচনার মুখে পরে আদেশটি বাতিল করা হয়।

‘সঞ্চার সাথী’ কী?
‘সঞ্চার সাথী’ একটি মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েব পোর্টাল, যা ২০২৩ সালে চালু হয়। ভারতের টেলিযোগাযোগ বিভাগ ব্যবহারকারীদের ফোন, সিমের পরিচয় এবং এর মাধ্যমে হওয়া যোগাযোগকে জালিয়াতি ও অপব্যবহার থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করে অ্যাপটি।
অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের জন্য একটি একক ইন্টারফেসে বেশ কয়েকটি সরকারি ব্যাকএন্ড সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (সিইআইআর)। এই ব্যবস্থা সমস্ত মোবাইল ডিভাইসের বৈধ আইএমইআই নম্বরগুলো রেকর্ড করে।
অন্যদিকে আরেকটি প্রযুক্তি টেলিকম অ্যানালিটিক্স ফর ফ্রড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কনজিউমার প্রোটেকশন (টিএএফসিওপি) সমস্ত সিমকার্ড সংযোগ এবং তাদের নিবন্ধিত ব্যবহারকারীদের একটি রেজিস্ট্রি তৈরি করে।
অ্যাপটি কীভাবে কাজ করে?
‘সঞ্চার সাথী’ মূলত ব্যবহারকারীদের টেলিকম সম্পর্কিত সুরক্ষা দিতে তৈরি বলে দাবি ভারত সরকারের। অ্যাপ ও পোর্টালটি ব্যবহারকারীদের যেসব সুবিধা দেয়–
হারানো বা চুরি যাওয়া হ্যান্ডসেট ব্লক করার সুবিধা দেয় অ্যাপটি। IMEI-ভিত্তিক ট্রেস-এন্ড-ব্লক সুবিধার মাধ্যমে সমস্ত অপারেটরের হারানো বা চুরি যাওয়া হ্যান্ডসেট ব্লক করতে পারে এ ব্যবস্থা।
অ্যাপটির মাধ্যমে আইএমইআই নম্বরের ভিত্তিতে হ্যান্ডসেট যাচাই করা যায়। পাশাপাশি ব্যবহারকারীর নামে কতগুলো মোবাইল সংযোগ আছে, তা দেখা এবং অজানা নম্বরগুলোও চিহ্নিত করা যায়। একটি পদ্ধতির মাধ্যমে সন্দেহজনক জালিয়াতিমূলক কল, এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপ রিপোর্ট করার সুযোগ দেয় অ্যাপটি। পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ডেটা অ্যাক্সেসের সুযোগও আছে এতে।

গোপনীয়তা নিয়ে হইচই
বিরোধী দলীয় নেতা, আক্টিভিস্ট ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বাধ্যতামূলক প্রি-ইনস্টলেশনকে গণনজরদারি বা ব্যক্তিগত ডিভাইসে রাষ্ট্রের একটি অপ্রয়োজনীয় উপস্থিতি হিসেবে দেখেছিলেন। তাদের মতে, ডিভাইসগুলোর মধ্যে অ্যাপের এক্সেস কমানো কিংবা আনইনস্টল করার সুযোগ ছিল না।
অ্যাপলসহ অন্যান্য টেক কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা ও প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা নীতির কথা উল্লেখ করে অ্যাপটি প্রি-ইনস্টলের আপত্তি তুলেছিল।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো আপডেটের জটিলতা নিয়ে এবং প্রি-ইনস্টল করা অ্যাপগুলো প্ল্যাটফর্মের নিয়ম বা তৃতীয় পক্ষের তথ্য গোপনীয় রাখার প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকর হবে, সেই ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিল।
উদ্বেগগুলো কি সত্যি
‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপের ডিজাইনে এমন কোনো বিষয় নেই, যেখানে কেউ ব্যক্তিগত কল কিংবা তথ্য গোপন করতে পারবে। অন্যদিকে সরকারের কাছে সম্পূর্ণ এক্সেস থাকার কারণে গোপনে কল বা বার্তা রেকর্ড করার সুযোগ রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর।
কিন্তু রাজনীতিবিদ কিংবা আক্টিভিস্টদের চিন্তা শুধু এই জায়গায় ছিল না। এই চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে দেশের ক্ষমতা ছিল। বর্তমান সরকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিল, প্রতিটি নতুন স্মার্টফোনে ডিফল্ট হিসেবে একটি রাষ্ট্রীয় অ্যাপ যেন থাকে। এটি কার্যকর করা সম্ভব হলে, সম্ভবত রাজনৈতিক তথ্যসহ তৃণমূল পর্যায়ে নজর রাখা সহজ হতো ক্ষমতাসীন দলের জন্য।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাপের সক্ষমতার মতোই এর উদ্দেশ্যও জানা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের যুক্তি অস্পষ্ট হলেও আইনত প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রের কাছে ব্যক্তিগত তথ্য অ্যাক্সেস করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই রয়েছে।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞর মতে, এ সম্পর্কিত নির্দেশটি প্রতিটি ফোনে একটি স্থায়ী অনুপ্রবেশের পথ তৈরি করেছিল। যেখানে নাগরিকদের বিশ্বাস করতে বলা হয়েছিল যে, এই প্রবেশাধিকারের অপব্যবহার কখনো হবে না। বিতর্কটি নিছক প্রযুক্তিগত নয়; বরং, এর নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও আস্থা নিয়ে।
উদ্বেগগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ
প্রি-ইনস্টল করা অ্যাপগুলো প্রায়শই ব্যবহারকারীদের কাছে অনেক ধরনের অনুমতি চায়। স্বাধীনভাবে অডিট কিংবা স্বচ্ছ ডেটা-ফ্লো প্রকাশ ছাড়া ব্যবহারকারীর কোনো মেটাডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে কি না, তা বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন। যদি মেটাডেটা সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে–সেটি কী কাজে ব্যবহৃত হবে?
ভারতীয় টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর প্রথমে প্রি-ইনস্টলেশন বাধ্যতামূলক করে। পরে বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট করে জানায়, ব্যবহারকারীরা এটি আনইনস্টল করতে পারবে। সবশেষে আদেশটি প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। এই সিদ্ধান্ত অ্যাপটি নিয়ে অবিশ্বাসকে আরও গভীর করে তোলে।
উদ্বেগ কি এখনো আছে
ঘটনাটি সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, সরকার কীভাবে সাইবার নিরাপত্তা ও জালিয়াতি প্রতিরোধের সঙ্গে গোপনীয়তার মতো মৌলিক অধিকার এবং ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত জায়গার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।
সফটওয়্যার প্রকৌশলীরা মনে করেন ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ নিজে এই গল্পের ভিলেন ছিল না। সমস্যাটি ছিল এই ধারণায়, যেখানে রাষ্ট্র নিজেদের অপারেটিং সিস্টেমে সংযুক্ত করে নিতে পারে।
ডিজিটাল অধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগগুলোর সমাধান করার জন্য সরকারকে এমন সাইবার নিরাপত্তা সমাধান তৈরি করতে বলেছে, যেখানে ব্যবহারকারীর স্বাধীনতা বিপন্ন হবে না।
তবে দ্য সেলুলার অপেরেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (সিওএআই) থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে, সরকার চাইলে স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো যেন এস-জিপিএস প্রযুক্তি সক্রিয় করে দেয়। এই প্রযুক্তি স্যাটেলাইট সিগন্যাল ও সেলুলার ডেটা ব্যবহার করে।

এর মানে হলো–অ্যাপটি কার্যকর হলে ব্যবহারকারীদের ফোনে লোকেশন সার্ভিস সবসময় চালু থাকবে। বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এতে ফোনগুলো মূলত ‘নজরদারির যন্ত্র’ হিসেবে কাজ করবে।
অ্যাপল ও গুগলের লবিং গ্রুপ ইন্ডিয়া সেলুলার অ্যান্ড ইলেকট্রোনিক্স অ্যাসোসিয়েশন (আইসিইএ) বিষয়টি নিয়ে সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল। চিঠিতে বলা হয়, এটি গোপনীয়তা, আইনি ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় উদ্বেগের কারণ।
বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করে বলা হয়, ফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্য, বিচারক, করপোরেট কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরাও রয়েছেন। যেহেতু এই মানুষগুলোর কাছে সংবেদনশীল তথ্য থাকে, তাই প্রস্তাবিত এই লোকেশন ট্র্যাকিং ব্যবস্থা তাদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
টেলিকম সংস্থাগুলোর মতে, লোকেশন ট্র্যাকিং শুরু হলে ব্যবহারকারীরা একটি পপ-আপ বার্তা দেখে বুঝতে পারে, তাদের অবস্থান ট্র্যাক করা হচ্ছে। ফলে সন্দেহভাজন ব্যক্তি সতর্ক হয়ে যাবে। কোম্পানিগুলো এ পপ-অ্যাপ দেখানোর বৈশিষ্ট্যটিও বন্ধের দাবি জানিয়েছিল।

সব নতুন স্মার্টফোনে একটি রাষ্ট্র-পরিচালিত সাইবার নিরাপত্তা অ্যাপ প্রি-লোড করা বাধ্যতামূলক করে একটি আদেশ সম্প্রতি জারি করেছে ভারত সরকার। এ আদেশের ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নজরদারি নিয়ে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে বিতর্কের একপর্যায়ে এটি বাতিল হলেও দেশটির সরকারের তরফ থেকে নেওয়া এ উদ্যোগ জনমনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে।
গত ১ ডিসেম্বর নতুন এ আদেশ প্রকাশ্যে আসে। আদেশে বলা হয়, স্মার্টফোন প্রস্তুতকারকদের ৯০ দিনের মধ্যে সব নতুন ডিভাইসে সরকারের ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপটি আগে থেকেই লোড করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
আদেশের সবচেয়ে উদ্বেগজনক অংশ ছিল–অ্যাপটির কার্যকারিতা বন্ধ বা সীমাবদ্ধ করা যাবে না। সরকার বিষয়টি নিয়ে জানায়, এটি নাগরিকদের হ্যান্ডসেটের যাচাই এবং হ্যান্ডসেটের সন্দেহজনক অপব্যবহার রোধ বা এ সম্পর্কিত রিপোর্ট করার জন্য প্রয়োজন।
বিশ্বের বৃহত্তম এই ফোন বাজারে সরকারের এমন পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এটি নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করছে।
অ্যাপের মূল ধারণাকে সহজ বলছে ভারত সরকার। তাদের দাবি, ব্যবহারকারীদের হ্যান্ডসেট যাচাই, হারানো বা চুরি যাওয়া ফোন ব্লক এবং সন্দেহজনক কল চিহ্নিত করার জন্য অ্যাপটি সাহায্য করবে। যদিও তীব্র সমালোচনার মুখে পরে আদেশটি বাতিল করা হয়।

‘সঞ্চার সাথী’ কী?
‘সঞ্চার সাথী’ একটি মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েব পোর্টাল, যা ২০২৩ সালে চালু হয়। ভারতের টেলিযোগাযোগ বিভাগ ব্যবহারকারীদের ফোন, সিমের পরিচয় এবং এর মাধ্যমে হওয়া যোগাযোগকে জালিয়াতি ও অপব্যবহার থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করে অ্যাপটি।
অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের জন্য একটি একক ইন্টারফেসে বেশ কয়েকটি সরকারি ব্যাকএন্ড সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (সিইআইআর)। এই ব্যবস্থা সমস্ত মোবাইল ডিভাইসের বৈধ আইএমইআই নম্বরগুলো রেকর্ড করে।
অন্যদিকে আরেকটি প্রযুক্তি টেলিকম অ্যানালিটিক্স ফর ফ্রড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কনজিউমার প্রোটেকশন (টিএএফসিওপি) সমস্ত সিমকার্ড সংযোগ এবং তাদের নিবন্ধিত ব্যবহারকারীদের একটি রেজিস্ট্রি তৈরি করে।
অ্যাপটি কীভাবে কাজ করে?
‘সঞ্চার সাথী’ মূলত ব্যবহারকারীদের টেলিকম সম্পর্কিত সুরক্ষা দিতে তৈরি বলে দাবি ভারত সরকারের। অ্যাপ ও পোর্টালটি ব্যবহারকারীদের যেসব সুবিধা দেয়–
হারানো বা চুরি যাওয়া হ্যান্ডসেট ব্লক করার সুবিধা দেয় অ্যাপটি। IMEI-ভিত্তিক ট্রেস-এন্ড-ব্লক সুবিধার মাধ্যমে সমস্ত অপারেটরের হারানো বা চুরি যাওয়া হ্যান্ডসেট ব্লক করতে পারে এ ব্যবস্থা।
অ্যাপটির মাধ্যমে আইএমইআই নম্বরের ভিত্তিতে হ্যান্ডসেট যাচাই করা যায়। পাশাপাশি ব্যবহারকারীর নামে কতগুলো মোবাইল সংযোগ আছে, তা দেখা এবং অজানা নম্বরগুলোও চিহ্নিত করা যায়। একটি পদ্ধতির মাধ্যমে সন্দেহজনক জালিয়াতিমূলক কল, এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপ রিপোর্ট করার সুযোগ দেয় অ্যাপটি। পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ডেটা অ্যাক্সেসের সুযোগও আছে এতে।

গোপনীয়তা নিয়ে হইচই
বিরোধী দলীয় নেতা, আক্টিভিস্ট ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বাধ্যতামূলক প্রি-ইনস্টলেশনকে গণনজরদারি বা ব্যক্তিগত ডিভাইসে রাষ্ট্রের একটি অপ্রয়োজনীয় উপস্থিতি হিসেবে দেখেছিলেন। তাদের মতে, ডিভাইসগুলোর মধ্যে অ্যাপের এক্সেস কমানো কিংবা আনইনস্টল করার সুযোগ ছিল না।
অ্যাপলসহ অন্যান্য টেক কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা ও প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা নীতির কথা উল্লেখ করে অ্যাপটি প্রি-ইনস্টলের আপত্তি তুলেছিল।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো আপডেটের জটিলতা নিয়ে এবং প্রি-ইনস্টল করা অ্যাপগুলো প্ল্যাটফর্মের নিয়ম বা তৃতীয় পক্ষের তথ্য গোপনীয় রাখার প্রতিশ্রুতি কতটা কার্যকর হবে, সেই ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিল।
উদ্বেগগুলো কি সত্যি
‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপের ডিজাইনে এমন কোনো বিষয় নেই, যেখানে কেউ ব্যক্তিগত কল কিংবা তথ্য গোপন করতে পারবে। অন্যদিকে সরকারের কাছে সম্পূর্ণ এক্সেস থাকার কারণে গোপনে কল বা বার্তা রেকর্ড করার সুযোগ রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর।
কিন্তু রাজনীতিবিদ কিংবা আক্টিভিস্টদের চিন্তা শুধু এই জায়গায় ছিল না। এই চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে দেশের ক্ষমতা ছিল। বর্তমান সরকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিল, প্রতিটি নতুন স্মার্টফোনে ডিফল্ট হিসেবে একটি রাষ্ট্রীয় অ্যাপ যেন থাকে। এটি কার্যকর করা সম্ভব হলে, সম্ভবত রাজনৈতিক তথ্যসহ তৃণমূল পর্যায়ে নজর রাখা সহজ হতো ক্ষমতাসীন দলের জন্য।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যাপের সক্ষমতার মতোই এর উদ্দেশ্যও জানা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের যুক্তি অস্পষ্ট হলেও আইনত প্রয়োজন হলে রাষ্ট্রের কাছে ব্যক্তিগত তথ্য অ্যাক্সেস করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই রয়েছে।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞর মতে, এ সম্পর্কিত নির্দেশটি প্রতিটি ফোনে একটি স্থায়ী অনুপ্রবেশের পথ তৈরি করেছিল। যেখানে নাগরিকদের বিশ্বাস করতে বলা হয়েছিল যে, এই প্রবেশাধিকারের অপব্যবহার কখনো হবে না। বিতর্কটি নিছক প্রযুক্তিগত নয়; বরং, এর নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও আস্থা নিয়ে।
উদ্বেগগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ
প্রি-ইনস্টল করা অ্যাপগুলো প্রায়শই ব্যবহারকারীদের কাছে অনেক ধরনের অনুমতি চায়। স্বাধীনভাবে অডিট কিংবা স্বচ্ছ ডেটা-ফ্লো প্রকাশ ছাড়া ব্যবহারকারীর কোনো মেটাডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে কি না, তা বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন। যদি মেটাডেটা সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে–সেটি কী কাজে ব্যবহৃত হবে?
ভারতীয় টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর প্রথমে প্রি-ইনস্টলেশন বাধ্যতামূলক করে। পরে বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট করে জানায়, ব্যবহারকারীরা এটি আনইনস্টল করতে পারবে। সবশেষে আদেশটি প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। এই সিদ্ধান্ত অ্যাপটি নিয়ে অবিশ্বাসকে আরও গভীর করে তোলে।
উদ্বেগ কি এখনো আছে
ঘটনাটি সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, সরকার কীভাবে সাইবার নিরাপত্তা ও জালিয়াতি প্রতিরোধের সঙ্গে গোপনীয়তার মতো মৌলিক অধিকার এবং ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত জায়গার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।
সফটওয়্যার প্রকৌশলীরা মনে করেন ‘সঞ্চার সাথী’ অ্যাপ নিজে এই গল্পের ভিলেন ছিল না। সমস্যাটি ছিল এই ধারণায়, যেখানে রাষ্ট্র নিজেদের অপারেটিং সিস্টেমে সংযুক্ত করে নিতে পারে।
ডিজিটাল অধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগগুলোর সমাধান করার জন্য সরকারকে এমন সাইবার নিরাপত্তা সমাধান তৈরি করতে বলেছে, যেখানে ব্যবহারকারীর স্বাধীনতা বিপন্ন হবে না।
তবে দ্য সেলুলার অপেরেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (সিওএআই) থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে, সরকার চাইলে স্মার্টফোন কোম্পানিগুলো যেন এস-জিপিএস প্রযুক্তি সক্রিয় করে দেয়। এই প্রযুক্তি স্যাটেলাইট সিগন্যাল ও সেলুলার ডেটা ব্যবহার করে।

এর মানে হলো–অ্যাপটি কার্যকর হলে ব্যবহারকারীদের ফোনে লোকেশন সার্ভিস সবসময় চালু থাকবে। বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এতে ফোনগুলো মূলত ‘নজরদারির যন্ত্র’ হিসেবে কাজ করবে।
অ্যাপল ও গুগলের লবিং গ্রুপ ইন্ডিয়া সেলুলার অ্যান্ড ইলেকট্রোনিক্স অ্যাসোসিয়েশন (আইসিইএ) বিষয়টি নিয়ে সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল। চিঠিতে বলা হয়, এটি গোপনীয়তা, আইনি ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় উদ্বেগের কারণ।
বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করে বলা হয়, ফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে সামরিক বাহিনীর সদস্য, বিচারক, করপোরেট কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরাও রয়েছেন। যেহেতু এই মানুষগুলোর কাছে সংবেদনশীল তথ্য থাকে, তাই প্রস্তাবিত এই লোকেশন ট্র্যাকিং ব্যবস্থা তাদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
টেলিকম সংস্থাগুলোর মতে, লোকেশন ট্র্যাকিং শুরু হলে ব্যবহারকারীরা একটি পপ-আপ বার্তা দেখে বুঝতে পারে, তাদের অবস্থান ট্র্যাক করা হচ্ছে। ফলে সন্দেহভাজন ব্যক্তি সতর্ক হয়ে যাবে। কোম্পানিগুলো এ পপ-অ্যাপ দেখানোর বৈশিষ্ট্যটিও বন্ধের দাবি জানিয়েছিল।