পাকিস্তানের জঙ্গি বাহিনীতে বাংলাদেশিরা, বাড়ছে উদ্বেগ

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
পাকিস্তানের জঙ্গি বাহিনীতে বাংলাদেশিরা, বাড়ছে উদ্বেগ
টিটিপির কয়েকজন যোদ্ধা। ছবি: রয়টার্স

দুবাইয়ে কাজের কথা বলে সম্প্রতি পাকিস্তানভিত্তিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানে (টিটিপি) যোগ দেন এক বাংলাদেশি। তিনি ছাড়া আরও কয়েকজন এভাবে বিভিন্ন কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যোগ দেন পাকিস্তানের এমন আরও কিছু জঙ্গি সংগঠনে। তাদের মধ্যে কয়েকজন পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশি তরুণদের নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

করাচিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদারীপুরের ২২ বছর বয়সী ফয়সাল হোসেন পরিবারকে দুবাই যাওয়ার কথা বললেও, তিনি আসলে টিটিপির হয়ে লড়াই করছিলেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কারাক জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন তিনি।

গণমাধ্যমে প্রচারিত লাশের ছবি দেখে তার ভাই আরমান তাকে শনাক্ত করেন।

২০২৪ সালের মার্চে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন ফয়সাল। সেখান থেকে অবৈধভাবে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তানে গিয়ে টিটিপিতে যোগ দেন বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।

জুবায়ের আহমেদ নামের ২২ বছর বয়সী আরেক বাংলাদেশি গত এপ্রিলে পাকিস্তানে নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার মা আলেয়া আক্তার জানান, এপ্রিলের শেষে একটি অজ্ঞাত নম্বর থেকে তার মৃত্যুর খবর পান। জুবায়ের ২০২৪ সালের নভেম্বরে ওমরাহ করতে সৌদি আরবে যান। সেখান থেকে বৈধ পথে পাকিস্তানে প্রবেশ করেন তিনি।

ডনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফয়সালসহ এ পর্যন্ত টিটিপির হয়ে লড়াই করতে গিয়ে অন্তত চারজন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা গেছে। সরকারের পক্ষ থেকেই এই তথ্য জানানো হয়।

এর বাইরে এখনো পাকিস্তানে অবস্থান করে জঙ্গি গোষ্ঠীর হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন আরও ২৫-৩০ জন। এসব গোষ্ঠী চাইছে, পাকিস্তানে শরীয়াহভিত্তিক আইন প্রতিষ্ঠা করতে। আর ২০২৩ সাল থেকেই তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশিরা।

এসব ঘটনা ক্রমেই সংকট বাড়িয়ে তুলছে। কেবল বাংলাদেশ নয়, এই উপমহাদেশের নিরাপত্তা প্রশাসনও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে। এর অন্যতম কারণ, এসব যোদ্ধা কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে আছে। এমনকি তারা এরই মধ্যে প্রশিক্ষণও শেষ করেছে। কয়েকজন বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে অন্য দেশে যান, যা দেশটির জন্য উদ্বেগের।

সিটিটিসি ইউনিট প্রাথমিকভাবে জানায়, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের রতন ঢালীও (২৯) ২৬ সেপ্টেম্বরের অভিযানে নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কেননা গত ১ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রতন ঢালী বলে দাবি করা এক ব্যক্তির একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়।

সিটিটিসির এসপি রওশন সাদিয়া আফরোজ ভিডিওটিকে ভুয়া বলে উল্লেখ করেছেন। এর ফরেনসিক বিশ্লেষণ করা হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।

তবে টিটিপির মুখপাত্র ইমরান হায়দার প্রথমে রতন ঢালী নিহত হয়েছেন জানালেও পরে বিবৃতি প্রত্যাহার করে জানান, নিখোঁজ হওয়ায় তাকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।

রতনের বাবা আনোয়ার ঢালী ও মা সেলিনা বেগম অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। সরকারের কাছে তাদের ছেলের প্রকৃত অবস্থান জানতে চেয়েছেন তারা। রতন সবশেষ পরিবারের সাথে কথা বলেছিলেন ২০২৪ সালের ১১ এপ্রিল (ঈদের দিন) এবং তখন তিনি বলেছিলেন যে, তিনি ভারতে আছেন ও দুবাই যাবেন।

কীভাবে নিয়োগ পান বাংলাদেশিরা

২০০৪ সালের মার্চে ফয়সাল হোসেন তার বাবাকে বলেছিলেন, তিনি দুবাই যেতে চান। কিন্তু পরিবার রাজি হয়নি। কারণ, তাদের সামর্থ্য ছিল না। কয়েকদিন পর হোসেন তাদের জানান, সেখানে যাওয়ার একটা উপায় খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এক বড় ভাই আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে এবং সব খরচ বহন করবে। আমার বেতন হবে ৩৫ হাজার টাকা। দুবাই পৌঁছানোর পর আমাকে তার বেতন থেকে টাকা শোধ করতে হবে।”

হোসেন যখন দুবাই যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন, তখন তার বড় ভাই আরমান তাকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি ভিসা পেয়েছেন কি না। জবাবে ফয়সাল বলেছিলেন, তার ভিসা ভারত থেকে হবে। আরমান বলেন, “এটা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম।”

আরমান বলেন, “সে মাসে একবার বা দুবার আমাদের ফোন করত এবং বলত সে দুবাইয়ে কাজ করছে। গত জুনে আমাদের শেষবার তার সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। তারপর থেকে বারবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।”

এ ছাড়া গত মার্চে আনোয়ার ঢালী তার বাবাকে বলেন, তিনি দুবাই যাচ্ছেন। তার বাবা বলেন, “সে আমাকে বলেছিল যে, তার বসের দুবাইয়ে একটি ক্লিনিক আছে এবং তিনি রতনকে সেখানে কাজে নিতে চান। প্রায় ২০ দিন পর ঢালী তার মাকে ফোন করে জানায়, সে ভারতে আছে এবং দুবাই যাবে।’’

টিটিপির কয়েকজন যোদ্ধা। ছবি: রয়টার্স
টিটিপির কয়েকজন যোদ্ধা। ছবি: রয়টার্স

সত্যটা হলো, দুজনেই বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যায়। এরপর তারা কলকাতা ও দিল্লিতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করে। এসপি আফরোজ বলেন, “আমাদের তদন্তে দেখা গেছে যে, রতন ও ফয়সাল ২০২৪ সালের ২৭ মার্চ বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। সেখান থেকে তারা আফগানিস্তানের মাধ্যমে অবৈধভাবে পাকিস্তানে প্রবেশ করে, যেখানে তারা টিটিপিতে যোগ দেয়।”

ঢালী এবং হোসেন ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় অবস্থিত ‘রফ রফ হিজামা সেন্টার’ নামে একটি ক্লিনিকে কাজ করতেন। এখন আর সেখানে এই অফিস নেই।। একজন বাসিন্দা জানান, তারা কয়েক মাস আগে স্থান পরিবর্তন করেছে।

জোবায়ের ভিন্ন পথ বেছে নেন। তিনি প্রথমে উমরাহ করার জন্য ২০২৪ সালের নভেম্বরে সৌদি আরব গিয়েছিল। উমরাহ সম্পন্ন করার পর তিনি আর বাড়ি ফেরেননি। সিটিটিসি জানায়, তিনি সৌদি আরব থেকে বৈধ চ্যানেলে পাকিস্তানে প্রবেশ করে। তার মা আলেয়া আক্তার বলেন, “উমরাহ করার পর জোবায়ের বলেছিল যে, আপাতত সে বাড়ি আসছে না, কারণ সে আল্লাহর বাণী প্রচারে ব্যস্ত।”

টার্গেট কারা?

বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গি নিয়োগকারীরা সাধারণত গ্রামাঞ্চলের বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণদের টার্গেট করে, যারা বিদেশে চাকরি খুঁজছেন বা আর্থিকভাবে দুর্বল। তাদের অর্থের প্রলোভনে সহজে রাজি করানো যায়।

বিশেষজ্ঞরা এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মনে করেন, বেশির ভাগ নিয়োগ প্রক্রিয়া অনলাইনে হয় এবং এতে ধর্মীয় বিধি-বিধানের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগীদের পরিবার অভিযোগ করছে, তাদের ছেলেদের ভুল পথে চালিত করা হয়েছে এবং ফাঁদে ফেলা হয়েছে। তারা বিচার দাবি করছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।

রতনের বাবা বলেন, “আমার একটাই দাবি। যারা আমার ছেলেকে এই পথে নিয়ে গেছে, তাদের শাস্তি চাই।”

ফয়সালের ভাই আরমানও একই দাবি জানান। তিনি বলেন, “আমি বাংলাদেশ সরকারকে এই চক্রের মূল তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার অনুরোধ করছি, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এই ধরনের প্রতারণার শিকার না হয় এবং তাদের সন্তান না হারায়।’’

বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গি নিয়োগকারীরা প্রায়শই গ্রামীণ জেলার যুবক-যুবতীদের টার্গেট করে, যারা বিদেশে চাকরি খুঁজছে বা আর্থিকভাবে সংকটে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট এবং অ্যাডজাঙ্কট গবেষক মোবাশ্বার হাসান বলেন, “নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, যে কারণে তাদের সহজেই টাকার প্রলোভন দেখিয়ে রাজি করানো যায়।”

টিটিপির মুখপাত্র ইমরান হায়দার দাবি করেন, এই যুবকরা জানত তারা কীসের মধ্যে জড়াচ্ছে। এই ইমরান নিজেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘‘কাউকে জোর করে বা প্রতারণা করে এখানে আনা হয়নি।”

সিটিটিসির তথ্য অনুসারে, তিনি ২০২৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন।

সিটিটিসির এসপি আফরোজ জানান, বর্তমানে টিটিপি, টিএলপি (তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান) এবং আইএমপিসহ (ইত্তিহাদ-উল-মুজাহিদিন পাকিস্তান) পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন বাংলাদেশি লড়ছেন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ফয়সালের ভাই আরমানও একই দাবি করেন। তিনি বলেন, “আমি বাংলাদেশ সরকারকে এই চক্রের মূল তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার অনুরোধ করছি, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এই ধরনের প্রতারণার শিকার না হয় এবং তাদের সন্তান না হারায় ”

কী করছে বাংলাদেশ সরকার?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ সরকার অভ্যন্তরীণ জঙ্গিবাদী কার্যক্রমকে অনেকটাই দমন করতে সফল হলেও দেশের নাগরিকদের বিদেশে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে, চরমপন্থী নেটওয়ার্কগুলো তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। তারা এখন অনলাইনে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে এবং জঙ্গিদের বিদেশি সংঘাতপূর্ণ এলাকায় পাঠাচ্ছে।

চলতি বছরের ৫ জুলাই অ্যান্টি-টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের একজন কর্মকর্তা ঢাকার সাভার থানায় ছয় ব্যক্তি এবং তাদের অজ্ঞাত সহযোগীদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জুয়েল মিয়া এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ‘‘অ্যান্টি-টেররিজম আইনে দায়ের করা এই মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে টিটিপির পক্ষে অন্য একটি দেশের জননিরাপত্তা বিঘ্নিত ও অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র এবং চরমপন্থী বিষয়বস্তু ফাঁস করার অভিযোগ আনা হয়েছে।’’

আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সম্প্রতি টিটিপির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আরও দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। মামলার নথিতে বলা হয়েছে, টিটিপির মতাদর্শে অনুপ্রাণিত কিছু বাংলাদেশি যুবক আফগানিস্তানে ভ্রমণ করে পাকিস্তানে শরিয়াভিত্তিক ইসলামিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।

হলি আর্টিজানে হামলার পর বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার নয়টি জঙ্গিবাদী সংগঠনকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, এই গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না।

তবুও, কিছু নিষিদ্ধ গোষ্ঠী পুনরায় মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে, যার মধ্যে ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ হওয়া হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশ অন্যতম। গত বছরের মার্চে এই গোষ্ঠীর শত শত সদস্য ঢাকার একটি জনাকীর্ণ স্থানে জুমার নামাজের পর মিছিল বের করে, যেখানে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের পরিবর্তে একটি ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা টিয়ার গ্যাস এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এর জবাব দেয় এবং বেশ কয়েকজন অংশগ্রহণকারীকে গ্রেপ্তার করে।

এদিকে, রতন ঢালীকে জীবিত দেখানোর দাবি করা ভিডিওটি ফরেনসিকভাবে বিশ্লেষণ করা না হলেও, তার পরিবার আশা এবং শোকের মাঝে আটকা পড়ে আছে। তারা নিশ্চিত নয় যে, তাদের ছেলে ফিরে আসবে, নাকি সে এমন একটি সংঘাতের শিকার হয়েছে, যা বেশির ভাগ বাংলাদেশিই ভালোভাবে বোঝেন না।

সম্পর্কিত