১১ ডিসেম্বর ১৯৭১
ফজলে রাব্বি

জামালপুর ও ময়মনসিংহের পতনের পর ঢাকার দিকে এগোতে থাকে যৌথ বাহিনী। উত্তর-পূর্বে যৌথ বাহিনী মেঘনা অতিক্রম করে ঢাকার দিকে এগোচ্ছে আরেকটি দল।
যৌথ বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের মুখে রাতে তুমুল যুদ্ধের পর কুষ্টিয়া শহর মুক্ত হয়। আগের দিন যৌথ বাহিনী ঝিনাইদহ থেকে ট্যাংক নিয়ে কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর ফাঁদে পড়েছিল। তখন শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। এরপর ভারতীয় বিমানের হামলায় পাকিস্তানি সেনারা হতাহতদের ফেলে সকালে পালিয়ে যায়। ঈশ্বরদী থেকে পালানোর সময় পাকিস্তানি সেনারা হার্ডিঞ্জ রেলসেতুর একাংশের গার্ডার ধ্বংস করে। যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ২০০ জন শহীদ হন। যশোর থেকে ঢাকা অভিমুখী যৌথ বাহিনী মাগুরা শহর পেরিয়ে মধুমতী নদীর তীরে পৌঁছে যায়। নদীর ওপারে পাকিস্তানি সেনারা ঘাঁটি গেড়ে তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। খুলনা অঞ্চলে যৌথ বাহিনী এদিন খুলনা জেলা শহরের ১০ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়।
যৌথ বাহিনীর আরেক অংশ ভৈরব বাজারের দক্ষিণে সড়কপথ ধরে এগিয়ে যায় ঢাকার দিকে। চাঁদপুর ও কুমিল্লার মধ্যবর্তী লাকসামে ২৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও একটি বালুচ রেজিমেন্টের প্রায় ৪০০ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর সেনারা বেশির ভাগ স্থানেই যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারেনি। বাধা দেওয়ার চেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত তারা হয় পালিয়ে যায়, নয় আত্মসমর্পণ করে। ২৪ ঘণ্টায় আত্মসমর্পণ করে প্রায় দুই হাজার পাকিস্তানি সেনা।
ঢাকা থেকে এদিন বিদেশি নাগরিকদের অপসারণের কথা থাকলেও পাকিস্তানিদের বাধার মুখে সেটি স্থগিত হয়ে যায়। আগে থেকে কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ দুটি ব্রিটিশ ও একটি কানাডীয় বিমানকে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামতে দেয়নি। এ সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ বন্ধ রেখেছিল।
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ এক বেতার ঘোষণায় বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পালানোর পথ বন্ধ করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একদল জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সরিয়ে নিতে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্য চেয়েছে। তারা বাংলাদেশে জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রমের ফরাসি প্রধান পল মার্ক অঁরির মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্য চায়। তবে জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা শাহি মহাসচিবকে এ বার্তা আমলে না নেয়ার অনুরোধ করেন।
ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা ঢাকা থেকে জানান, পূর্ববঙ্গের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নির্ধারণের উদ্দেশ্য জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আলোচনার জন্য যে প্রস্তাব পেশ করেন, তা নিয়ে ইয়াহিয়া খান আপত্তি জানিয়েছেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের আবেদনে সারা দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু অনুরোধে কান না দিতে ইয়াহিয়া খানের বার্তা এলে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
বেইজিংয়ের কূটনীতিক সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, চীন শুধু জাতিসংঘের ভেতরেই পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাবে। সেনা পাঠিয়ে ভারতে আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না।
নিউইয়র্কের পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতির মূল সমস্যা না মেটা পর্যন্ত এবং এ আলোচনায় বাংলাদেশকে না ডাকা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অবাস্তব।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ডেমোক্র্যাট-দলীয় সিনেটর ফ্র্যাঙ্ক চার্চ ওয়াশিংটনে বলেন, পর্যাপ্ত সামরিক সাহায্য দিতে পাকিস্তানের অনুরোধ রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিশেষ বিবেচনা করছেন।
তথ্যসূত্র: একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ, রাশেদুর রহমান, আনন্দবাজার পত্রিকা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক

জামালপুর ও ময়মনসিংহের পতনের পর ঢাকার দিকে এগোতে থাকে যৌথ বাহিনী। উত্তর-পূর্বে যৌথ বাহিনী মেঘনা অতিক্রম করে ঢাকার দিকে এগোচ্ছে আরেকটি দল।
যৌথ বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের মুখে রাতে তুমুল যুদ্ধের পর কুষ্টিয়া শহর মুক্ত হয়। আগের দিন যৌথ বাহিনী ঝিনাইদহ থেকে ট্যাংক নিয়ে কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশের মুখে পাকিস্তানি বাহিনীর ফাঁদে পড়েছিল। তখন শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। এরপর ভারতীয় বিমানের হামলায় পাকিস্তানি সেনারা হতাহতদের ফেলে সকালে পালিয়ে যায়। ঈশ্বরদী থেকে পালানোর সময় পাকিস্তানি সেনারা হার্ডিঞ্জ রেলসেতুর একাংশের গার্ডার ধ্বংস করে। যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর প্রায় ২০০ জন শহীদ হন। যশোর থেকে ঢাকা অভিমুখী যৌথ বাহিনী মাগুরা শহর পেরিয়ে মধুমতী নদীর তীরে পৌঁছে যায়। নদীর ওপারে পাকিস্তানি সেনারা ঘাঁটি গেড়ে তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। খুলনা অঞ্চলে যৌথ বাহিনী এদিন খুলনা জেলা শহরের ১০ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়।
যৌথ বাহিনীর আরেক অংশ ভৈরব বাজারের দক্ষিণে সড়কপথ ধরে এগিয়ে যায় ঢাকার দিকে। চাঁদপুর ও কুমিল্লার মধ্যবর্তী লাকসামে ২৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও একটি বালুচ রেজিমেন্টের প্রায় ৪০০ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
পাকিস্তানি বাহিনীর সেনারা বেশির ভাগ স্থানেই যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই পারেনি। বাধা দেওয়ার চেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত তারা হয় পালিয়ে যায়, নয় আত্মসমর্পণ করে। ২৪ ঘণ্টায় আত্মসমর্পণ করে প্রায় দুই হাজার পাকিস্তানি সেনা।
ঢাকা থেকে এদিন বিদেশি নাগরিকদের অপসারণের কথা থাকলেও পাকিস্তানিদের বাধার মুখে সেটি স্থগিত হয়ে যায়। আগে থেকে কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ দুটি ব্রিটিশ ও একটি কানাডীয় বিমানকে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামতে দেয়নি। এ সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ বন্ধ রেখেছিল।
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ এক বেতার ঘোষণায় বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পালানোর পথ বন্ধ করার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একদল জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সরিয়ে নিতে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্য চেয়েছে। তারা বাংলাদেশে জাতিসংঘের ত্রাণ কার্যক্রমের ফরাসি প্রধান পল মার্ক অঁরির মাধ্যমে জাতিসংঘের সাহায্য চায়। তবে জাতিসংঘে পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা শাহি মহাসচিবকে এ বার্তা আমলে না নেয়ার অনুরোধ করেন।
ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা ঢাকা থেকে জানান, পূর্ববঙ্গের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নির্ধারণের উদ্দেশ্য জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আলোচনার জন্য যে প্রস্তাব পেশ করেন, তা নিয়ে ইয়াহিয়া খান আপত্তি জানিয়েছেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের আবেদনে সারা দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু অনুরোধে কান না দিতে ইয়াহিয়া খানের বার্তা এলে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
বেইজিংয়ের কূটনীতিক সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, চীন শুধু জাতিসংঘের ভেতরেই পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাবে। সেনা পাঠিয়ে ভারতে আক্রমণ করবে বলে মনে হয় না।
নিউইয়র্কের পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতিকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতির মূল সমস্যা না মেটা পর্যন্ত এবং এ আলোচনায় বাংলাদেশকে না ডাকা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অবাস্তব।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের ডেমোক্র্যাট-দলীয় সিনেটর ফ্র্যাঙ্ক চার্চ ওয়াশিংটনে বলেন, পর্যাপ্ত সামরিক সাহায্য দিতে পাকিস্তানের অনুরোধ রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিশেষ বিবেচনা করছেন।
তথ্যসূত্র: একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ, রাশেদুর রহমান, আনন্দবাজার পত্রিকা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক