তরুণ চক্রবর্তী

ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, কেরালা ও পদুচেরি–এই পাঁচ রাজ্যের ভোট ২০২৬ সালের প্রথমার্ধেই। এই পাঁচ রাজ্যের মধ্যে একমাত্র আসামেই বিজেপি নিজের ক্ষমতায় সরকার চালাচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনেও আসামেই শুধু জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বিজেপির। সেই জয় নিশ্চিত করতে বিজেপির ভরসা বিভাজনের রাজনীতি। শুধু হিন্দু বা মুসলিম বিভাজন নয়, মুসলিমদের মধ্যেও বিভাজন ঘটাতে মরিয়া বিজেপি। তাই তারা চার দশকেরও আগের ঘটনাকে সামনে তুলে এনে আসামে খিলঞ্জিয়া ও চালানি মুসলিমদের মধ্যে বিরোধ ঘটাতে চায়।
খিলঞ্জিয়া হচ্ছে অসমিয়া ভাষায় ভূমিপুত্র। আর চালানি বলতে বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গেও ঠিক একইভাবে বাঙালি ও হিন্দিভাষী মুসলিমদের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা চলছে।
বিজেপি আসামের মুসলিম ভোটারদের ভয় দেখাতে চাইছে। ভয় থেকেই তো আসে ভক্তি। তাই আসামে ভোটের আগে দুটি মুসলিম নিধনযজ্ঞের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন বিজেপির নেতামন্ত্রীরা। নেলি গণহত্যার কথা অনেকেই ভুলে যেতে চাইলেও আসাম বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে রীতিমতো তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে এনে সকলকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় নেলির সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা।
কী হয়েছিল নেলিতে? দিনটি ছিল ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সরস্বতী পুজোর দিন। সকাল থেকে নেলি-সহ আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ জড়ো করে সরকারি হিসাবেই ২ হাজার ১৯১ জনকে খুন করা হয়। নিহতদের সকলেই বাঙালি। ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনায় নিলে নিহতদের মধ্যে দুজন হিন্দু ছাড়া বাকি সবাই ছিল মুসলিম। অপরাধ? ভোট বয়কটের ডাক উপেক্ষা করে তারা ভোট দিয়েছিলেন। সেই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের কথা বিধানসভা ভোটের আগে সকলকে মনে করিয়ে দিতেই বিজেপি নেলি নিয়ে গঠিত তিওয়ারি কমিশনের প্রতিবেদন এতদিন পর প্রকাশ্যে এনে বাজার গরম করছে।
নেলি গণহত্যার পর অনেক কাল পার হয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে পেশাগত কারণেই সেখানে গিয়েছিলাম। স্থানীয় কপিলি নদী দিয়ে বহু রক্তস্রোত বয়ে গেছে। পাগলা মেহের আলির মতো ‘প্রলাপ বকতে বকতে’ ক্লান্ত স্থানীয় ২০ গ্রামের মানুষ। তবু গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারা মেরেছিল? স্থানীয় শব্দর আলি ও তার সঙ্গে জড়ো হওয়া গ্রামের আরও বহু মানুষ একসুরে বলেছিলেন, ‘আরএসএস’। তারা নিশ্চিত। একইসঙ্গে তারা বলেছিলেন, সিআরপি ক্যাম্পে সেদিন পালিয়ে না গেলে তাদেরও মৃত্যু অবধারিত ছিল। সেই মৃত্যুভয় আজও তাদের চোখেমুখে। তাদের মুখ থেকেই শুনেছিলাম ফিরোজা বেগমের করুণ কাহিনি। নিজের কোনো বাচ্চাকাচ্চা ছিল না ফিরোজার। তাই বোনের মেয়ে আসিয়া খাতুনকে (৬) নিয়ে এসেছিলেন নিজের বাসায়। কিন্তু সেই সন্তানও টেকেনি।
কারণ? আসল কারণ বুঝলেও এখনো সরকারিভাবে জানেন না আসামের গুয়াহাটি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে, জাগি রোডের ধারে নেলির বধ্যভূমিতে মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যে খুন হওয়া সরকারি হিসাবেই ২ হাজার ১৯১ জনের পরিবারের কেউই। শুধু জানেন, ভোট বয়কটের ডাক উপেক্ষা করে তাদের কেউ কেউ ভোট দিয়েছিলেন। এটাই ছিল অপরাধ। শৈশবেই সব হারানো বছর পঞ্চাশের আব্দুল রশিদের পাশে দাঁড়িয়ে সত্তর বছরের বৃদ্ধ সুবার আলি শুনিয়েছিলেন তার বাবা, দুই ভাই হত্যার কাহিনি। রশিদ আর সুবার আলি সেদিন দৌড়ে বেঁচেছিলেন। সেই নেলির ঘটনা আবার সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
শুধু নেলি কেন, বিহারের ভোটের পর আসামের বিজেপি মন্ত্রী অশোক সিংঘল তার এক্স হ্যান্ডেলে ফুলকপি চাষের একটা ছবি দিয়ে লিখেছেন ‘বিহার অ্যাপ্রুভস গোবি ফার্মিং’। অর্থাৎ বিহার কপি চাষকেই অনুমোদন দিয়েছে। কারণ? ভাগলপুরের ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে চাইছেন তিনি। কী হয়েছিল ভাগলপুরে?
২৭ অক্টোবর, ১৯৮৯ সাল। তার দিন তিনেক আগে থেকেই ভাগলপুর শহর আর গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই সংঘর্ষে সরকারি হিসাবেই ১৯৮১ জনের মৃত্যু হয়। পরে আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, পুলিশ নিজেই মুসলিম নিধনে সাহায্য করেছিল ঘাতকদের। সেই সংঘর্ষের আবহেই বর্বরতার নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছিল ভাগলপুরের উপকণ্ঠে।
ভাগলপুর থেকে প্রায় ৩০-৩২ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট গ্রাম লোগাঁও। ৩৫ ঘর মুসলমান বাস করতেন সেই গ্রামে। অভিশপ্ত সেই রাতে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে ঘাতকের দল। গ্রামের ৫৫ জন পুরুষ আর ৬১ জন নারীকে কুপিয়ে হত্যা করে তারা। রাতের অন্ধকারেই সব মরদেহ পুকুরে ফেলে দিয়ে ঘাতকেরা গা ঢাকা দেয়। স্থানীয় জগদীশপুর থানার ওসি রামচন্দ্র সিং নিজেই হত্যাকারীদের দেখভালে ব্যস্ত ছিলেন।
কিন্তু প্রমাণ হাপিস করতে ২৯ অক্টোবর মরদেহগুলোকে তোলা হয় পুকুর থেকে। পুলিশের তত্ত্বাবধানে পুঁতে দেওয়া হয় চাষের জমিতে। রাতারাতি মাটিতে মরদেহ পুঁতে সেই জমিতে ফুলকপি আর সর্ষের বীজ বোনা হয়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। মাসখানেক পর ফুলকপির জমির মাটি খুঁড়ে বার হয় ১১৬টি লাশ।
২০১৮ সালে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনায় জড়িতদের ভাগলপুরের আদালত সাজা শোনান। সেই তালিকায় ছিল জগদীশপুর থানার সেই কুখ্যাত ওসি রামচন্দ্র সিং। ২০১৭ সালে বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে আসে সেই সময়ে ১৪ বছর বয়সী মলকা বেগমের কথা। তার ডান পায়ের গোড়ালি থেকে কাটা পড়ে। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, দিনটা ছিল শুক্রবার। গ্রামে একটি নতুন মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের সঙ্গে স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যে আগে থেকেই বিরোধ ছিল। সেই মসজিদেই জুম্মার নামাজ পড়তে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই দুপক্ষের মধ্যে শুরু হয় পাথর আর পটকা-বোমা ছোড়া। তারপর সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকার নেমে আসে লোগাঁও গ্রামে। সেই অন্ধকারের ভয়ঙ্কর চেহারা ফের মানুষকে মনে করাতে চাইছেন বিজেপি নেতারা।
তাই আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি গৌরব গগৈ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ কপিচাষ সম্পর্কে লিখেছেন, “বিহার নির্বাচনের ফলাফলের পর আসামের একজন বর্তমান মন্ত্রীর ‘কপি চাষ’ ছবির ব্যবহার রাজনৈতিক আলোচনায় এক বিস্ময়কর নতুন নিম্নমানের চিত্র তুলে ধরে। এটি অশ্লীল এবং লজ্জাজনক–দুই-ই।”
ভয় থেকেই নাকি আসে ভক্তি!
তাই ভয় দেখানোর হরেক কিসিমের চেষ্টা শুরু হয়েছে আসামে। গর্ভবতী নারীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জী), সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন), ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল, সীমান্ত পুলিশ, ডিটেনশন ক্যাম্প, পুশব্যাক প্রভৃতি শব্দ তো রয়েছেই। ভোটের মুখে তাদের নেলি ও ফুলকপি চাষের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। এখন দেখার বিষয়–সেই ভয়ের প্রভাব কতটা পড়ে আসামের বিধানসভা ভোটে!
তরুণ চক্রবর্তী: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলকাতা (ভারত)

ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, কেরালা ও পদুচেরি–এই পাঁচ রাজ্যের ভোট ২০২৬ সালের প্রথমার্ধেই। এই পাঁচ রাজ্যের মধ্যে একমাত্র আসামেই বিজেপি নিজের ক্ষমতায় সরকার চালাচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনেও আসামেই শুধু জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বিজেপির। সেই জয় নিশ্চিত করতে বিজেপির ভরসা বিভাজনের রাজনীতি। শুধু হিন্দু বা মুসলিম বিভাজন নয়, মুসলিমদের মধ্যেও বিভাজন ঘটাতে মরিয়া বিজেপি। তাই তারা চার দশকেরও আগের ঘটনাকে সামনে তুলে এনে আসামে খিলঞ্জিয়া ও চালানি মুসলিমদের মধ্যে বিরোধ ঘটাতে চায়।
খিলঞ্জিয়া হচ্ছে অসমিয়া ভাষায় ভূমিপুত্র। আর চালানি বলতে বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। পশ্চিমবঙ্গেও ঠিক একইভাবে বাঙালি ও হিন্দিভাষী মুসলিমদের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা চলছে।
বিজেপি আসামের মুসলিম ভোটারদের ভয় দেখাতে চাইছে। ভয় থেকেই তো আসে ভক্তি। তাই আসামে ভোটের আগে দুটি মুসলিম নিধনযজ্ঞের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন বিজেপির নেতামন্ত্রীরা। নেলি গণহত্যার কথা অনেকেই ভুলে যেতে চাইলেও আসাম বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে রীতিমতো তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে এনে সকলকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় নেলির সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা।
কী হয়েছিল নেলিতে? দিনটি ছিল ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সরস্বতী পুজোর দিন। সকাল থেকে নেলি-সহ আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ জড়ো করে সরকারি হিসাবেই ২ হাজার ১৯১ জনকে খুন করা হয়। নিহতদের সকলেই বাঙালি। ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনায় নিলে নিহতদের মধ্যে দুজন হিন্দু ছাড়া বাকি সবাই ছিল মুসলিম। অপরাধ? ভোট বয়কটের ডাক উপেক্ষা করে তারা ভোট দিয়েছিলেন। সেই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের কথা বিধানসভা ভোটের আগে সকলকে মনে করিয়ে দিতেই বিজেপি নেলি নিয়ে গঠিত তিওয়ারি কমিশনের প্রতিবেদন এতদিন পর প্রকাশ্যে এনে বাজার গরম করছে।
নেলি গণহত্যার পর অনেক কাল পার হয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে পেশাগত কারণেই সেখানে গিয়েছিলাম। স্থানীয় কপিলি নদী দিয়ে বহু রক্তস্রোত বয়ে গেছে। পাগলা মেহের আলির মতো ‘প্রলাপ বকতে বকতে’ ক্লান্ত স্থানীয় ২০ গ্রামের মানুষ। তবু গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কারা মেরেছিল? স্থানীয় শব্দর আলি ও তার সঙ্গে জড়ো হওয়া গ্রামের আরও বহু মানুষ একসুরে বলেছিলেন, ‘আরএসএস’। তারা নিশ্চিত। একইসঙ্গে তারা বলেছিলেন, সিআরপি ক্যাম্পে সেদিন পালিয়ে না গেলে তাদেরও মৃত্যু অবধারিত ছিল। সেই মৃত্যুভয় আজও তাদের চোখেমুখে। তাদের মুখ থেকেই শুনেছিলাম ফিরোজা বেগমের করুণ কাহিনি। নিজের কোনো বাচ্চাকাচ্চা ছিল না ফিরোজার। তাই বোনের মেয়ে আসিয়া খাতুনকে (৬) নিয়ে এসেছিলেন নিজের বাসায়। কিন্তু সেই সন্তানও টেকেনি।
কারণ? আসল কারণ বুঝলেও এখনো সরকারিভাবে জানেন না আসামের গুয়াহাটি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে, জাগি রোডের ধারে নেলির বধ্যভূমিতে মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যে খুন হওয়া সরকারি হিসাবেই ২ হাজার ১৯১ জনের পরিবারের কেউই। শুধু জানেন, ভোট বয়কটের ডাক উপেক্ষা করে তাদের কেউ কেউ ভোট দিয়েছিলেন। এটাই ছিল অপরাধ। শৈশবেই সব হারানো বছর পঞ্চাশের আব্দুল রশিদের পাশে দাঁড়িয়ে সত্তর বছরের বৃদ্ধ সুবার আলি শুনিয়েছিলেন তার বাবা, দুই ভাই হত্যার কাহিনি। রশিদ আর সুবার আলি সেদিন দৌড়ে বেঁচেছিলেন। সেই নেলির ঘটনা আবার সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
শুধু নেলি কেন, বিহারের ভোটের পর আসামের বিজেপি মন্ত্রী অশোক সিংঘল তার এক্স হ্যান্ডেলে ফুলকপি চাষের একটা ছবি দিয়ে লিখেছেন ‘বিহার অ্যাপ্রুভস গোবি ফার্মিং’। অর্থাৎ বিহার কপি চাষকেই অনুমোদন দিয়েছে। কারণ? ভাগলপুরের ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে চাইছেন তিনি। কী হয়েছিল ভাগলপুরে?
২৭ অক্টোবর, ১৯৮৯ সাল। তার দিন তিনেক আগে থেকেই ভাগলপুর শহর আর গ্রামাঞ্চলে শুরু হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই সংঘর্ষে সরকারি হিসাবেই ১৯৮১ জনের মৃত্যু হয়। পরে আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, পুলিশ নিজেই মুসলিম নিধনে সাহায্য করেছিল ঘাতকদের। সেই সংঘর্ষের আবহেই বর্বরতার নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছিল ভাগলপুরের উপকণ্ঠে।
ভাগলপুর থেকে প্রায় ৩০-৩২ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট গ্রাম লোগাঁও। ৩৫ ঘর মুসলমান বাস করতেন সেই গ্রামে। অভিশপ্ত সেই রাতে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে ঘাতকের দল। গ্রামের ৫৫ জন পুরুষ আর ৬১ জন নারীকে কুপিয়ে হত্যা করে তারা। রাতের অন্ধকারেই সব মরদেহ পুকুরে ফেলে দিয়ে ঘাতকেরা গা ঢাকা দেয়। স্থানীয় জগদীশপুর থানার ওসি রামচন্দ্র সিং নিজেই হত্যাকারীদের দেখভালে ব্যস্ত ছিলেন।
কিন্তু প্রমাণ হাপিস করতে ২৯ অক্টোবর মরদেহগুলোকে তোলা হয় পুকুর থেকে। পুলিশের তত্ত্বাবধানে পুঁতে দেওয়া হয় চাষের জমিতে। রাতারাতি মাটিতে মরদেহ পুঁতে সেই জমিতে ফুলকপি আর সর্ষের বীজ বোনা হয়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। মাসখানেক পর ফুলকপির জমির মাটি খুঁড়ে বার হয় ১১৬টি লাশ।
২০১৮ সালে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনায় জড়িতদের ভাগলপুরের আদালত সাজা শোনান। সেই তালিকায় ছিল জগদীশপুর থানার সেই কুখ্যাত ওসি রামচন্দ্র সিং। ২০১৭ সালে বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে আসে সেই সময়ে ১৪ বছর বয়সী মলকা বেগমের কথা। তার ডান পায়ের গোড়ালি থেকে কাটা পড়ে। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, দিনটা ছিল শুক্রবার। গ্রামে একটি নতুন মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের সঙ্গে স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যে আগে থেকেই বিরোধ ছিল। সেই মসজিদেই জুম্মার নামাজ পড়তে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই দুপক্ষের মধ্যে শুরু হয় পাথর আর পটকা-বোমা ছোড়া। তারপর সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকার নেমে আসে লোগাঁও গ্রামে। সেই অন্ধকারের ভয়ঙ্কর চেহারা ফের মানুষকে মনে করাতে চাইছেন বিজেপি নেতারা।
তাই আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি গৌরব গগৈ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ কপিচাষ সম্পর্কে লিখেছেন, “বিহার নির্বাচনের ফলাফলের পর আসামের একজন বর্তমান মন্ত্রীর ‘কপি চাষ’ ছবির ব্যবহার রাজনৈতিক আলোচনায় এক বিস্ময়কর নতুন নিম্নমানের চিত্র তুলে ধরে। এটি অশ্লীল এবং লজ্জাজনক–দুই-ই।”
ভয় থেকেই নাকি আসে ভক্তি!
তাই ভয় দেখানোর হরেক কিসিমের চেষ্টা শুরু হয়েছে আসামে। গর্ভবতী নারীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জী), সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন), ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল, সীমান্ত পুলিশ, ডিটেনশন ক্যাম্প, পুশব্যাক প্রভৃতি শব্দ তো রয়েছেই। ভোটের মুখে তাদের নেলি ও ফুলকপি চাষের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। এখন দেখার বিষয়–সেই ভয়ের প্রভাব কতটা পড়ে আসামের বিধানসভা ভোটে!
তরুণ চক্রবর্তী: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলকাতা (ভারত)