মাঠের মানুষ চলে গেলেন সবুজ জমিনেই

চরচা প্রতিবেদক
চরচা প্রতিবেদক
মাঠের মানুষ চলে গেলেন সবুজ জমিনেই

জীবন অনিশ্চয়তার!

কথাটা কারোরই অজানা নয়। কিন্তু কিছু মুহূর্ত আসে, যখন জীবনের অনিশ্চয়তাও সবাইকে স্তব্ধ করে দেয়, হতভম্ব করে দেয়। শনিবার বিপিএলে ঢাকা ক্যাপিটালসের সহকারী কোচ মাহবুব আলী জাকির মৃত্যু তেমনই এক ঘটনা। দুপুর বারোটার সময়ও যে মানুষটা মাঠে ছিলেন দলের সঙ্গে। সন্ধ্যার আগেই তাঁর মৃতদেহ এল মাঠে। জীবন শুধু অনিশ্চয়তারই নয়, জীবন বড় ঠুনকো। এসব মুহূর্তগুলোই হয়ত সবাইকে মনে করিয়ে দেয়, এই যে জীবন নিয়ে এত আয়োজন, এত পরিকল্পনা—পরের মুহূর্তে কী ঘটবে, সেটিই তো আমরা কেউই জানি না।

শনিবার ছিল বিপিএলের দ্বিতীয় দিন। সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ঢাকা ক্যাপিটালস মুখোমুখি হয়েছিল রাজশাহী ওয়ারিয়র্সের বিপক্ষে। দিনের প্রথম ম্যাচ। দল নিয়ে মাঠেই ছিলেন মাহবুব আলী জাকি। দলের খেলোয়াড়দের ওয়ার্মআপ তদারকি করছিলেন। দাঁড়িয়ে সেই ওয়ার্মআপ দেখতে দেখতেই হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন ঢাকার সহকারী কোচ। বলতে পেরেছিলেন মাত্র একটি বাক্য—‘আমাকে ধর’। শিষ্যরা দৌড়ে গিয়েছিলেন তার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। কিছুক্ষণ মাঠেই সিপিআর দেওয়া হয়, দ্রুততার সঙ্গে সিলেট শহরের একটি হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দেখা যায়, তিনি নেই।

আগের দিনও মাঠে বসেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন মাহবুব আলী। ছবি: বিসিবি
আগের দিনও মাঠে বসেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন মাহবুব আলী। ছবি: বিসিবি

ঢাকা ক্যাপিটালসের খেলোয়াড়দের জন্য এমন কঠিন ম্যাচ হয়ত জীবনে আসেনি। কী ভয়ংকর মানসিক অবস্থা নিয়ে তাঁরা ম্যাচটা খেলেছেন, চিন্তাই করা যায় না। ম্যাচটা ঢাকা জিতেছে, কিন্তু সেই জয়ে আনন্দ ছিল না, ছিল শুধুই কান্না আর শোক। ম্যাচে বা ম্যাচের পর খেলোয়াড়দের চোখে–মুখে যে অবিশ্বাস, যে ঘোর দেখা গেছে, সেটি কোনো বিশেষণ দিয়েই বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

আপাদমস্তক মাঠের মানুষ মাহবুব আলী। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে খেলেছেন। কুমিল্লার মানুষটি এক সময় জাতীয় ক্রিকেট খেলেছেন কুমিল্লা জেলার হয়ে। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন পেস বোলার। ২০০৮ সালে বিসিবিতে যোগ দেন স্পেশালিস্ট পেস বোলিং কোচ হিসেবে। ছিলেন হাই পারফরম্যান্স কোচও। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করা বহু পেস বোলারের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন তিনি। ছিলেন বায়োমেকানিক্স বিশেষজ্ঞও। বোলিং অ্যাকশন নিয়ে যেসব বোলার সমস্যায় পড়েছেন, আইসিসি যাদেরকেই আপত্তি দিয়েছে, তারা প্রায় সবাই মাহবুব আলীর অধীনে নিজেদের শুধরেছেন। তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অধ্যায় ২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার যুব বিশ্বকাপ। বিশ্বজয়ী যুবাদের বোলিং কোচ ছিলেন তিনি।

দেশের পেসারদের নিয়ে নীরবেই কাজ করে গেছেন মাহবুব আলী। ছবি: বিসিবি
দেশের পেসারদের নিয়ে নীরবেই কাজ করে গেছেন মাহবুব আলী। ছবি: বিসিবি

নীরবে–নিভৃতেই দেশের ক্রিকেটে কাজ করে গেছেন মাহবুব আলী। ২০১৬ সালে তাসকিন আহমেদের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে যখন আইসিসি আপত্তি তুলল, তখন মাহবুব আলীর অধীনেই ক্যারিয়ার বাঁচিয়েছিলেন তাসকিন। এই খবর কয়জন জানেন? শুধু কী তাসকিন? বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেস বোলার তৈরি থেকে শুরু করে, যে বোলার যখনই নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব খুঁজে পেয়েছেন, তখনই মাহবুব আলীর আশ্রয় খুঁজেছেন। আগেই বলা হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে বায়োমেকানিক্স বা বোলিং অ্যাকশন সংক্রান্ত বিজ্ঞানটা খুব ভালো বুঝতেন। অন্যান্য প্রযুক্তিতেও তাঁর অগাধ দখল ছিল। কখনোই পাদপ্রদীপের আলোয় আসেননি। কখনোই কোনো কিছুর জন্য নিজের কৃতিত্ব দাবি করেননি। এই যে আজ দেশের ক্রিকেটে ভালো ভালো পেস বোলার তৈরি হয়েছে, এসবের নেপথ্যে মাহবুব আলীর আছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাসকিন তো ছিলেনই, শরীফুল ইসলাম, তানজিম হাসান সাকিব, মুশফিক হাসান, রিপন মন্ডলদের সরাসরি শিক্ষক তিনি।

৫৯ বছরের জীবন মাহবুব আলীর। ৩৫ বছরই তিনি উৎসর্গ করেছেন দেশের ক্রিকেটের পেছনে। এমন মানুষ চলে গেলেন মাঠের সবুজ জমিনেই।

সম্পর্কিত