নাইর ইকবাল

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এক গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সাড়ে আট বছরের শাসনকালের। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেষ মুহূর্তে মরিয়া হয়েই তিনি সেনাবাহিনীর সাহায্য প্রত্যাশা করেছিলেন। তার আশা ছিল তৎকালীন সেনাবাহিনীতে তার যেসব অনুগত কর্মকর্তা অপারেশনাল দায়িত্বে ছিলেন, তারা কোনো না কোনোভাবে তাকে রক্ষা করবে। কিন্তু এরশাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সেনাবাহিনী তার কথা শোনেনি। তার শাসন টিকিয়ে রাখতে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণেও রাজি ছিল না আজ থেকে ৩৫ বছর আগের সেনাবাহিনী।
নব্বইয়ের নভেম্বরের ২৭ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সরকারি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন। মিলন নিহত হওয়ার আগেই বিরোধী জোটের ঘোষিত কর্মসূচি চলছিল। তার মৃত্যু সে আগুনে ঘি ঢালে। গণবিস্ফোরণ ঘটে ঢাকাসহ সারা দেশে। ২৭ নভেম্বর রাতেই জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। পরিস্থিতি পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঢাকার রাজপথ চলে যায় আন্দোলনকারীদের দখলে। বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে সাধারণ জনতার নিহত হয়।
এরশাদ ভেবেছিলেন জরুরি অবস্থা জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেই বিরোধী দলের আন্দোলন তিনি দমন করতে পারবেন। এ ব্যাপারে তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসীই ছিলেন। এরশাদ মনে করতেন একজন সেনাশাসক হিসেবে তার প্রতি সব সময়ই অনুগত আছে গোটা সেনাবাহিনী। কিন্তু তিনি যে কতটা ভুল ভেবেছিলেন, সেটি বুঝতে পারেন কয়েকদিন পর।
আন্দোলনের সময় এরশাদের মনস্তত্ত্ব বোঝা যায় তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খানের লেখা বই ‘আমার সৈনিক জীবন: পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’–এ। বইটির একটা অংশে তিনি এরশাদের সামরিক সচিব থাকাকালের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। তিনি সেখানে লিখেছেন, এরশাদ ১ ডিসেম্বরের দিকে তাকে পদত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি মত বদলে ফেলেন। একইসঙ্গে মনজুর রশীদ খানের মনে হয়েছিল, এরশাদ বিরোধী জোটের একটি অংশের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে যেকোনো ধরনের সমঝোতার আশা করছেন। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ বিরোধী দলের উদ্দেশে বিশেষ এক ফর্মুলা পেশ করেন। সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৫ দিন আগে তিনি পদত্যাগ করবেন। তবে বিরোধী দল সেই ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এর মধ্যেই সেনা সদরে সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরউদ্দিন খান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে সেনাবাহিনীর মধ্যস্তরের কর্মকর্তারা সেনাবাহিনী প্রধানকে সাফ জানিয়ে দেন, এরশাদের ক্ষমতা ধরে রাখার কোনো ঘুঁটি হিসেবে সেনাবাহিনীকে যেন ব্যবহার না করা হয়। একই মনোভাব ছিল বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারও। এরশাদের সামরিক সচিব মনজুর রশীদ খান এই বৈঠকের কথা জানতে পারেন সেনা সদরে গিয়ে। এরশাদই তাকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে পাঠিয়েছিলেন। সেনা সদরে মনজুর রশীদ খানকে এ বৈঠকের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতিকে তা জানানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন সে সময়ের চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) মেজর জেনারেল আবদুস সালাম। মনজুর রশীদ খান সেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
বঙ্গভবনে ফিরে মনজুর রশীদ খান এরশাদকে সেনা সদরের ঘটনাবলি জানান। এরশাদ বেশ ভেঙে পড়েন। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা যে তার সমর্থনে নেই, এটা তিনি মেনেই নিতে পারছিলেন না। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে তার সেই সময়ের সবচেয়ে অনুগত জেনারেল রফিকুল ইসলামের খোঁজ করেন। মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম ছিলেন সাভারে অবস্থিত নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার পর থেকেই সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেভাবে রাষ্ট্রপতির কাছাকাছি ছিলেন না। এমন তথ্য পাওয়া যায় সামরিক সচিব মনজুর রশীদ খানের বই থেকেই। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নূরউদ্দিন, সিজিএস, কিউএমজি বা অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল, এরা প্রায় সবাই কোনো না কোনো ছুতায় রাষ্ট্রপতিকে এড়িয়ে চলছিলেন।
শেষ পর্যন্ত এরশাদ ৫ ডিসেম্বর রাতে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একজন পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচন করতে বলেন, যার হাতেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়ে তিনি সরে যাবেন। এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণায় সারা দেশে উৎসবের আবহ তৈরি হয়। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়।
সারা দেশ যখন এরশাদের পদত্যাগের মুহূর্তটি দেখার অপেক্ষায়, ঠিক তখনই সবার অলক্ষ্যে ক্যান্টনমেন্টে অন্য এক খেলা চলছিল। এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েও শেষ মুহূর্তে মরিয়া প্রচেষ্টায় নামেন। তিনি তার অনুগত নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামকে দিয়ে সামরিক আইন জারি করে বা এ ধরনের কোনো ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ প্রয়াস নিয়েছিলেন।
ক্যান্টনমেন্টের সেনা ভবনে, যেটি ছিল রাষ্ট্রপতি এরশাদের বাসভবন, সেখানে জড়ো হয়েছিলেন তার অনুগত মন্ত্রীরা। জাতীয় পার্টি সরকারের শীর্ষ নয়/দশজন মন্ত্রীকে নিয়ে বৈঠক করছিলেন এরশাদ। তবে এর মধ্যেই তিনি নিজের এডিসিকে নির্দেশ দেন মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামকে যেকোনো মূল্যে খুঁজে বের করার। রফিকের সঙ্গে এরশাদ কোনোভাবেই কথা বলতে পারছিলেন না। জানা যায়, সেনা সদর থেকেই পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে রফিককে বিরত রাখা হয়েছিল, তিনি যেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে না পারেন।
নিজের বাসভবনে বসেই জেনারেল রফিককে নিয়ে একটা মন্তব্য করেছিলেন এরশাদ। সামরিক সচিব মনজুর রশীদ খান সেই মন্তব্যের কথা লিখেছেন তার বইয়ে। এরশাদ সেই ৫ ডিসেম্বর রাতে তার স্ত্রী রওশন এরশাদকে বলেছিলেন, ‘Rafique is a great fighter, he will give life for me. I will talk to him.’
কিন্তু রফিককে কোনোভাবেই খুঁজে পাননি এরশাদ। তিনি এতে বেশ রাগান্বিত হন। জেনারেল রফিক ছিলেন এরশাদের পরীক্ষিত সেনা কর্মকর্তা। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ যে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে এরশাদ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন, তখন জেনারেল রফিক ছিলেন ঢাকার ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার। তিনি এরশাদকে ক্ষমতা দখলে সব ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও জেনারেল রফিককে হাতের নাগালে পাননি এরশাদ। সেটি সম্ভব হয়েছিল সেনাবাহিনীর সার্বিক নীতির কারণেই। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জনতার সঙ্গেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছিল তাদের যেন কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করা হয়। মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশার সঙ্গে থেকেই আজ থেকে ৩৫ বছর আগে সেনাবাহিনী এরশাদ পতনে রেখেছিল নেপথ্য ভূমিকা।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এক গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সাড়ে আট বছরের শাসনকালের। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেষ মুহূর্তে মরিয়া হয়েই তিনি সেনাবাহিনীর সাহায্য প্রত্যাশা করেছিলেন। তার আশা ছিল তৎকালীন সেনাবাহিনীতে তার যেসব অনুগত কর্মকর্তা অপারেশনাল দায়িত্বে ছিলেন, তারা কোনো না কোনোভাবে তাকে রক্ষা করবে। কিন্তু এরশাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সেনাবাহিনী তার কথা শোনেনি। তার শাসন টিকিয়ে রাখতে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণেও রাজি ছিল না আজ থেকে ৩৫ বছর আগের সেনাবাহিনী।
নব্বইয়ের নভেম্বরের ২৭ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সরকারি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন। মিলন নিহত হওয়ার আগেই বিরোধী জোটের ঘোষিত কর্মসূচি চলছিল। তার মৃত্যু সে আগুনে ঘি ঢালে। গণবিস্ফোরণ ঘটে ঢাকাসহ সারা দেশে। ২৭ নভেম্বর রাতেই জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। পরিস্থিতি পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঢাকার রাজপথ চলে যায় আন্দোলনকারীদের দখলে। বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে সাধারণ জনতার নিহত হয়।
এরশাদ ভেবেছিলেন জরুরি অবস্থা জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেই বিরোধী দলের আন্দোলন তিনি দমন করতে পারবেন। এ ব্যাপারে তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসীই ছিলেন। এরশাদ মনে করতেন একজন সেনাশাসক হিসেবে তার প্রতি সব সময়ই অনুগত আছে গোটা সেনাবাহিনী। কিন্তু তিনি যে কতটা ভুল ভেবেছিলেন, সেটি বুঝতে পারেন কয়েকদিন পর।
আন্দোলনের সময় এরশাদের মনস্তত্ত্ব বোঝা যায় তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খানের লেখা বই ‘আমার সৈনিক জীবন: পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’–এ। বইটির একটা অংশে তিনি এরশাদের সামরিক সচিব থাকাকালের কাহিনি বর্ণনা করেছেন। তিনি সেখানে লিখেছেন, এরশাদ ১ ডিসেম্বরের দিকে তাকে পদত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি মত বদলে ফেলেন। একইসঙ্গে মনজুর রশীদ খানের মনে হয়েছিল, এরশাদ বিরোধী জোটের একটি অংশের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে যেকোনো ধরনের সমঝোতার আশা করছেন। ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ বিরোধী দলের উদ্দেশে বিশেষ এক ফর্মুলা পেশ করেন। সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৫ দিন আগে তিনি পদত্যাগ করবেন। তবে বিরোধী দল সেই ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এর মধ্যেই সেনা সদরে সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূরউদ্দিন খান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে সেনাবাহিনীর মধ্যস্তরের কর্মকর্তারা সেনাবাহিনী প্রধানকে সাফ জানিয়ে দেন, এরশাদের ক্ষমতা ধরে রাখার কোনো ঘুঁটি হিসেবে সেনাবাহিনীকে যেন ব্যবহার না করা হয়। একই মনোভাব ছিল বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারও। এরশাদের সামরিক সচিব মনজুর রশীদ খান এই বৈঠকের কথা জানতে পারেন সেনা সদরে গিয়ে। এরশাদই তাকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে পাঠিয়েছিলেন। সেনা সদরে মনজুর রশীদ খানকে এ বৈঠকের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতিকে তা জানানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন সে সময়ের চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) মেজর জেনারেল আবদুস সালাম। মনজুর রশীদ খান সেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
বঙ্গভবনে ফিরে মনজুর রশীদ খান এরশাদকে সেনা সদরের ঘটনাবলি জানান। এরশাদ বেশ ভেঙে পড়েন। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা যে তার সমর্থনে নেই, এটা তিনি মেনেই নিতে পারছিলেন না। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে তার সেই সময়ের সবচেয়ে অনুগত জেনারেল রফিকুল ইসলামের খোঁজ করেন। মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম ছিলেন সাভারে অবস্থিত নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার পর থেকেই সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেভাবে রাষ্ট্রপতির কাছাকাছি ছিলেন না। এমন তথ্য পাওয়া যায় সামরিক সচিব মনজুর রশীদ খানের বই থেকেই। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নূরউদ্দিন, সিজিএস, কিউএমজি বা অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল, এরা প্রায় সবাই কোনো না কোনো ছুতায় রাষ্ট্রপতিকে এড়িয়ে চলছিলেন।
শেষ পর্যন্ত এরশাদ ৫ ডিসেম্বর রাতে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একজন পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচন করতে বলেন, যার হাতেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়ে তিনি সরে যাবেন। এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণায় সারা দেশে উৎসবের আবহ তৈরি হয়। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়।
সারা দেশ যখন এরশাদের পদত্যাগের মুহূর্তটি দেখার অপেক্ষায়, ঠিক তখনই সবার অলক্ষ্যে ক্যান্টনমেন্টে অন্য এক খেলা চলছিল। এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েও শেষ মুহূর্তে মরিয়া প্রচেষ্টায় নামেন। তিনি তার অনুগত নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামকে দিয়ে সামরিক আইন জারি করে বা এ ধরনের কোনো ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ প্রয়াস নিয়েছিলেন।
ক্যান্টনমেন্টের সেনা ভবনে, যেটি ছিল রাষ্ট্রপতি এরশাদের বাসভবন, সেখানে জড়ো হয়েছিলেন তার অনুগত মন্ত্রীরা। জাতীয় পার্টি সরকারের শীর্ষ নয়/দশজন মন্ত্রীকে নিয়ে বৈঠক করছিলেন এরশাদ। তবে এর মধ্যেই তিনি নিজের এডিসিকে নির্দেশ দেন মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামকে যেকোনো মূল্যে খুঁজে বের করার। রফিকের সঙ্গে এরশাদ কোনোভাবেই কথা বলতে পারছিলেন না। জানা যায়, সেনা সদর থেকেই পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে রফিককে বিরত রাখা হয়েছিল, তিনি যেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে না পারেন।
নিজের বাসভবনে বসেই জেনারেল রফিককে নিয়ে একটা মন্তব্য করেছিলেন এরশাদ। সামরিক সচিব মনজুর রশীদ খান সেই মন্তব্যের কথা লিখেছেন তার বইয়ে। এরশাদ সেই ৫ ডিসেম্বর রাতে তার স্ত্রী রওশন এরশাদকে বলেছিলেন, ‘Rafique is a great fighter, he will give life for me. I will talk to him.’
কিন্তু রফিককে কোনোভাবেই খুঁজে পাননি এরশাদ। তিনি এতে বেশ রাগান্বিত হন। জেনারেল রফিক ছিলেন এরশাদের পরীক্ষিত সেনা কর্মকর্তা। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ যে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে এরশাদ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন, তখন জেনারেল রফিক ছিলেন ঢাকার ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার। তিনি এরশাদকে ক্ষমতা দখলে সব ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও জেনারেল রফিককে হাতের নাগালে পাননি এরশাদ। সেটি সম্ভব হয়েছিল সেনাবাহিনীর সার্বিক নীতির কারণেই। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জনতার সঙ্গেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছিল তাদের যেন কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করা হয়। মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশার সঙ্গে থেকেই আজ থেকে ৩৫ বছর আগে সেনাবাহিনী এরশাদ পতনে রেখেছিল নেপথ্য ভূমিকা।