সোহানুর রহমান

বিশ্ব যখন অপরিবর্তনীয় জলবায়ু ক্ষতি, সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতির জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তখন জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে কোনো দূরবর্তী ধারণা নয়, বরং প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং নদী ভাঙনে লাখো মানুষ স্থানচ্যুত হচ্ছে। কৃষি, স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। উপকূল থেকে হাওর সব জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জীবন ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। এই সংকটকে আরও জটিল করেছে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর ভার বহনের অতিরিক্ত দায়, যা বাংলাদেশকে বহুমাত্রিক মানবিক ও অর্থনৈতিক চাপের মুখে ফেলেছে।
এই বাস্তবতার মধ্যেই কপ৩০-এ বাংলাদেশ তার অগ্রাধিকার ও অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। এই অবস্থান কেবল ক্ষতিগ্রস্ত দেশের নয়, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবিকেও প্রতিফলিত করে। কপ৩০-এ বাংলাদেশের অবস্থান মূলত তিনটি বার্তায় সংক্ষেপ করা যায়–এক, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতা; দুই, ন্যায্যতা বা সুবিচার ছাড়া স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়; তিন, অভিযোজন, ক্ষয়ক্ষতি ও ন্যায্য রূপান্তরে কার্যকর অর্থায়ন ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো টিকে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশ কেবল দাবি জানিয়েই থেমে যায়নি, বরং বৈশ্বিক আলোচনাকে বাস্তবসম্মত, ন্যায়ভিত্তিক ও মানুষকেন্দ্রিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে।
বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান মাত্র শূন্য দশমকি ৫ শতাংশেরও কম। অথচ ক্ষতির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। এই বৈপরীত্যকে সামনে এনে বাংলাদেশ পরিষ্কারভাবে বলেছে, কম দায়-বেশি ক্ষতির নীতির ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের জলবায়ু-সংক্রান্ত মতামতকে কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে রূপান্তরের আহ্বান বাংলাদেশের বক্তব্যকে আরও শক্তিশালী করেছে। জলবায়ু, সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতির আন্তঃসম্পর্ককে কপ আলোচনায় আনার জোর বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও প্রাসঙ্গিক করেছে।
ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বছরে কমপক্ষে ১২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের দাবি তুলেছে বাংলাদেশ। পূর্বানুমানযোগ্য অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন ছাড়া প্রকল্প পরিকল্পনা করা বা দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্গঠন করা কঠিন হয়ে পড়ে। সীমিত বাজেট থেকে দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধি হলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও পুষ্টির মতো মৌলিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
ক্ষয়ক্ষতি তহবিলকে দ্রুত কার্যকর করার দাবি বাংলাদেশের বক্তৃতায় বারবার উঠে এসেছে। জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা, ফসলহানি ও জীবিকা-ধ্বংসের মতো বাস্তব ক্ষত বাংলাদেশকে প্রতিদিনই সামাল দিতে হয়। তাই তহবিলকে অবিলম্বে কার্যকর করা, অর্থপ্রবাহ সহজ করা ও অনুদানভিত্তিক সহায়তা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

জলবায়ু অর্থায়নের নামে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর উচ্চ সুদের ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৫৫টি দেশ ২০২৩ সালে ঋণদাতাদের কাছে ৪৭.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে। অথচ অভিযোজন ও প্রতিরোধে পেয়েছে মাত্র ৩৩.৭৪ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু ঋণ ২৩.১২ ডলার। এই ঋণভিত্তিক অর্থায়ন এবং ধীর অর্থছাড় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য মারাত্মক। দক্ষিণ এশিয়ায় মাথাপিছু ঋণের বোঝা ২৯.৮৭ ডলার, এবং যদি ঋণভিত্তিক অর্থায়ন অব্যাহত থাকে, ২০৩১ সালে বাংলাদেশ অত্যন্ত উচ্চঝুঁকির দেশগুলোর তালিকায় থাকবে।
বাংলাদেশের এনডিসি ৩.০ (জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান ৩.০) দেশের জলবায়ু প্রতিশ্রুতি শক্তিশালী করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে মূল কৌশল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই পরিকল্পনায়, বিশেষ করে সরকারি ভবনে শক্তি দক্ষতা বাড়ানো এবং সোলারাইজেশনের প্রচার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া সৌর, বায়ু ও বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ২০৩৫ সালের মধ্যে বিজনেস-অ্যাজ-ইউজুয়াল পরিস্থিতি থেকে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শর্তহীনভাবে ৬.৩৯ শতাংশ এবং শর্তসাপেক্ষে ১৩.৯২ শতাংশ হ্রাস করা। নবায়নযোগ্য শক্তিকে কেন্দ্র করে গঠিত এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী এনডিসি ৩.০ বাংলাদেশের জন্য কেবল পরিবেশগত প্রয়োজনীয়তা নয়, বরং একটি অর্থনৈতিক সুযোগও।
বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে জাতীয় পরিকল্পনাগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য আছে। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতা উপেক্ষা করা হয়েছে। ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যানে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫-এ বলা হয়েছে, ২০৪০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য ৩০ শতাংশ হবে। আবার সমন্বিত বিদ্যুৎ-জ্বালানি মহাপরিকল্পনায় ২০৪০ সালের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ শতাংশ। এই ভিন্নতা বাস্তবায়নের দিক থেকে জটিলতা তৈরি করছে এবং এর কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত কৌশল অপরিহার্য।
নিঃসরণ কমানোর রোডম্যাপ এবং ন্যায্য রূপান্তরের কাঠামো তৈরি হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত বলছে, বাংলাদেশ ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্য রক্ষার নৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছে। তবে প্রযুক্তি, দক্ষতা ও অর্থায়নের ঘাটতি রূপান্তরের গতি ধীর করছে।
সুন্দরবন, চরাঞ্চল, নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা এবং উপকূলীয় অঞ্চলের বাস্তবতা দেখিয়ে বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন ও প্রকৃতিনির্ভর সমাধানে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছে। ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ, জলবায়ু-সহনশীল কৃষি ও কমিউনিটি-ভিত্তিক বন্যা ব্যবস্থাপনা কার্যকর ও টেকসই পথ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশ বহু বছর ধরে কপ প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকভাবে সোচ্চার থেকেছে। ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠন, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিশ্রুতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নিয়ে কথা বলেছে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অগ্রাধিকার ও স্থানীয় অভিযোজন কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্থান পেয়েছে। জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান শক্তিশালী হয়েছে এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সুরক্ষার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনায় প্রভাব রেখেছে। সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সমন্বয় নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্জন এখনো চূড়ান্ত নয়। তবে এটি দেশের স্বীকৃত রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানকে দৃঢ় করেছে।

বাংলাদেশের জন্য অভিযোজন প্রধান অগ্রাধিকার। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদী ভাঙন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান লাখো মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন দেশের জন্য অত্যাবশ্যক। অন্যদিকে, মোট নিঃসরণ বিশ্বের মাত্র ০.৫ শতাংশের কম হওয়ায় মোকাবিলা গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রধান অগ্রাধিকার নয়।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু-সংক্রান্ত বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করছে। জাতীয় বাস্তুচ্যুতি নীতি এবং কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন, আবাসন ও জীবিকা নিশ্চিত করা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি-ভিত্তিক বন্যা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং কেন্দ্রভিত্তিক পুনর্বাসন প্রকল্প চালু রয়েছে। কপ আলোচনায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের স্বীকৃতি ও সমন্বিত সহায়তার দাবি তুলেছে। তবে বাস্তবায়ন এখনো আংশিক এবং তহবিল সীমিত হওয়ায় হাজারো পরিবার যথাযথ সহায়তা পায়নি।
কপ৩০–এর আউটকাম বাংলাদেশের জন্য যেমন সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও। অভিযোজন তহবিল, জাস্ট ট্রানজিশন, জেন্ডার সমতা এবং বন ও সমুদ্র সংরক্ষণে অগ্রগতি হয়েছে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি রূপান্তরের স্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকা এবং পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব দেশের জলবায়ু অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার সক্ষমতাকে সীমিত করছে। বাংলাদেশের জন্য এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো শক্তিশালী প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা এবং আন্তর্জাতিক অর্থায়ন কার্যকরভাবে ব্যবহার করা।
কপ৩০–এর ফলাফল বাংলাদেশের জন্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। অভিযোজন তহবিল, জাস্ট ট্রানজিশন এবং জেন্ডার সমতা বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে কপ৩০–এ ২০৩৫ সালের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অভিযোজন তহবিল তিনগুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাস্ট ট্রানজিশন মেকানিজম এবং হালনাগাদ জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যুবক ও প্রতিবন্ধীসহ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হবে। এই উদ্যোগগুলো বাংলাদেশের জলবায়ু নীতি ও কর্মপরিকল্পনায় সমতা, অন্তর্ভুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরকে শক্তিশালী করবে।
তবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর স্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকা এবং বাস্তবায়নযোগ্য তহবিলের সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশের জন্য হতাশাজনক। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই সমুদ্রবন্দর, উপকূল ও নদী ভাঙনের কারণে ঝুঁকিতে আছে। দীর্ঘমেয়াদি তহবিল ব্যবস্থার জন্য এখনো পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি। লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে বরাদ্দ সীমিত থাকায় জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সহায়তা কম। অর্থাৎ, দেশকে এখন শক্তিশালী, তথ্যভিত্তিক প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বন, সমুদ্র ও উপকূল সংরক্ষণে নতুন উদ্যোগ বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে। ট্রপিক্যাল ফ্রস্ট ফরএভার ফ্যাসিলিটি এবং ব্লু এনডিসি চ্যালেঞ্জের মতো প্রকল্পে বাংলাদেশ অংশগ্রহণের মাধ্যমে বন সংরক্ষণ, পুনর্জীবিত সমুদ্রভূমি, নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক খাদ্য ও নীল কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। এটি জলবায়ু প্রতিরোধ ও সবুজ অর্থনীতি গঠনে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা দেবে।
আর্থিক কাঠামোর ক্ষেত্রে, ২০৩৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল জোগাড়ের লক্ষ্য বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এতে কারা দায়বদ্ধ, তা স্পষ্ট নয়। অর্থের অভাব ও ঋণভিত্তিক অর্থায়নের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো ঋণের বোঝা বাড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশকে নিজস্ব তহবিল ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক তহবিল সহজে ব্যবহারযোগ্য হয়।
লেখক: নির্বাহী সমন্বয়কারী, ইয়ুথনেট গ্লোবাল

বিশ্ব যখন অপরিবর্তনীয় জলবায়ু ক্ষতি, সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতির জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তখন জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে কোনো দূরবর্তী ধারণা নয়, বরং প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং নদী ভাঙনে লাখো মানুষ স্থানচ্যুত হচ্ছে। কৃষি, স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। উপকূল থেকে হাওর সব জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জীবন ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। এই সংকটকে আরও জটিল করেছে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর ভার বহনের অতিরিক্ত দায়, যা বাংলাদেশকে বহুমাত্রিক মানবিক ও অর্থনৈতিক চাপের মুখে ফেলেছে।
এই বাস্তবতার মধ্যেই কপ৩০-এ বাংলাদেশ তার অগ্রাধিকার ও অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। এই অবস্থান কেবল ক্ষতিগ্রস্ত দেশের নয়, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবিকেও প্রতিফলিত করে। কপ৩০-এ বাংলাদেশের অবস্থান মূলত তিনটি বার্তায় সংক্ষেপ করা যায়–এক, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের দৈনন্দিন বাস্তবতা; দুই, ন্যায্যতা বা সুবিচার ছাড়া স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়; তিন, অভিযোজন, ক্ষয়ক্ষতি ও ন্যায্য রূপান্তরে কার্যকর অর্থায়ন ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো টিকে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশ কেবল দাবি জানিয়েই থেমে যায়নি, বরং বৈশ্বিক আলোচনাকে বাস্তবসম্মত, ন্যায়ভিত্তিক ও মানুষকেন্দ্রিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে।
বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান মাত্র শূন্য দশমকি ৫ শতাংশেরও কম। অথচ ক্ষতির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। এই বৈপরীত্যকে সামনে এনে বাংলাদেশ পরিষ্কারভাবে বলেছে, কম দায়-বেশি ক্ষতির নীতির ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের জলবায়ু-সংক্রান্ত মতামতকে কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে রূপান্তরের আহ্বান বাংলাদেশের বক্তব্যকে আরও শক্তিশালী করেছে। জলবায়ু, সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতির আন্তঃসম্পর্ককে কপ আলোচনায় আনার জোর বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও প্রাসঙ্গিক করেছে।
ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বছরে কমপক্ষে ১২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের দাবি তুলেছে বাংলাদেশ। পূর্বানুমানযোগ্য অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন ছাড়া প্রকল্প পরিকল্পনা করা বা দুর্যোগ-পরবর্তী পুনর্গঠন করা কঠিন হয়ে পড়ে। সীমিত বাজেট থেকে দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধি হলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও পুষ্টির মতো মৌলিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
ক্ষয়ক্ষতি তহবিলকে দ্রুত কার্যকর করার দাবি বাংলাদেশের বক্তৃতায় বারবার উঠে এসেছে। জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা, ফসলহানি ও জীবিকা-ধ্বংসের মতো বাস্তব ক্ষত বাংলাদেশকে প্রতিদিনই সামাল দিতে হয়। তাই তহবিলকে অবিলম্বে কার্যকর করা, অর্থপ্রবাহ সহজ করা ও অনুদানভিত্তিক সহায়তা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

জলবায়ু অর্থায়নের নামে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর উচ্চ সুদের ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ৫৫টি দেশ ২০২৩ সালে ঋণদাতাদের কাছে ৪৭.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে। অথচ অভিযোজন ও প্রতিরোধে পেয়েছে মাত্র ৩৩.৭৪ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু ঋণ ২৩.১২ ডলার। এই ঋণভিত্তিক অর্থায়ন এবং ধীর অর্থছাড় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য মারাত্মক। দক্ষিণ এশিয়ায় মাথাপিছু ঋণের বোঝা ২৯.৮৭ ডলার, এবং যদি ঋণভিত্তিক অর্থায়ন অব্যাহত থাকে, ২০৩১ সালে বাংলাদেশ অত্যন্ত উচ্চঝুঁকির দেশগুলোর তালিকায় থাকবে।
বাংলাদেশের এনডিসি ৩.০ (জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান ৩.০) দেশের জলবায়ু প্রতিশ্রুতি শক্তিশালী করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে মূল কৌশল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই পরিকল্পনায়, বিশেষ করে সরকারি ভবনে শক্তি দক্ষতা বাড়ানো এবং সোলারাইজেশনের প্রচার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া সৌর, বায়ু ও বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ২০৩৫ সালের মধ্যে বিজনেস-অ্যাজ-ইউজুয়াল পরিস্থিতি থেকে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শর্তহীনভাবে ৬.৩৯ শতাংশ এবং শর্তসাপেক্ষে ১৩.৯২ শতাংশ হ্রাস করা। নবায়নযোগ্য শক্তিকে কেন্দ্র করে গঠিত এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী এনডিসি ৩.০ বাংলাদেশের জন্য কেবল পরিবেশগত প্রয়োজনীয়তা নয়, বরং একটি অর্থনৈতিক সুযোগও।
বাংলাদেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে বিদ্যুতের ২৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে জাতীয় পরিকল্পনাগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য আছে। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতা উপেক্ষা করা হয়েছে। ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যানে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫-এ বলা হয়েছে, ২০৪০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য ৩০ শতাংশ হবে। আবার সমন্বিত বিদ্যুৎ-জ্বালানি মহাপরিকল্পনায় ২০৪০ সালের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ শতাংশ। এই ভিন্নতা বাস্তবায়নের দিক থেকে জটিলতা তৈরি করছে এবং এর কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত কৌশল অপরিহার্য।
নিঃসরণ কমানোর রোডম্যাপ এবং ন্যায্য রূপান্তরের কাঠামো তৈরি হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত বলছে, বাংলাদেশ ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্য রক্ষার নৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছে। তবে প্রযুক্তি, দক্ষতা ও অর্থায়নের ঘাটতি রূপান্তরের গতি ধীর করছে।
সুন্দরবন, চরাঞ্চল, নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা এবং উপকূলীয় অঞ্চলের বাস্তবতা দেখিয়ে বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন ও প্রকৃতিনির্ভর সমাধানে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছে। ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ, জলবায়ু-সহনশীল কৃষি ও কমিউনিটি-ভিত্তিক বন্যা ব্যবস্থাপনা কার্যকর ও টেকসই পথ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বাংলাদেশ বহু বছর ধরে কপ প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকভাবে সোচ্চার থেকেছে। ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠন, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিশ্রুতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নিয়ে কথা বলেছে। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অগ্রাধিকার ও স্থানীয় অভিযোজন কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্থান পেয়েছে। জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান শক্তিশালী হয়েছে এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সুরক্ষার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনায় প্রভাব রেখেছে। সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সমন্বয় নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্জন এখনো চূড়ান্ত নয়। তবে এটি দেশের স্বীকৃত রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানকে দৃঢ় করেছে।

বাংলাদেশের জন্য অভিযোজন প্রধান অগ্রাধিকার। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদী ভাঙন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান লাখো মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন দেশের জন্য অত্যাবশ্যক। অন্যদিকে, মোট নিঃসরণ বিশ্বের মাত্র ০.৫ শতাংশের কম হওয়ায় মোকাবিলা গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রধান অগ্রাধিকার নয়।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু-সংক্রান্ত বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করছে। জাতীয় বাস্তুচ্যুতি নীতি এবং কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন, আবাসন ও জীবিকা নিশ্চিত করা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি-ভিত্তিক বন্যা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং কেন্দ্রভিত্তিক পুনর্বাসন প্রকল্প চালু রয়েছে। কপ আলোচনায় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের স্বীকৃতি ও সমন্বিত সহায়তার দাবি তুলেছে। তবে বাস্তবায়ন এখনো আংশিক এবং তহবিল সীমিত হওয়ায় হাজারো পরিবার যথাযথ সহায়তা পায়নি।
কপ৩০–এর আউটকাম বাংলাদেশের জন্য যেমন সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও। অভিযোজন তহবিল, জাস্ট ট্রানজিশন, জেন্ডার সমতা এবং বন ও সমুদ্র সংরক্ষণে অগ্রগতি হয়েছে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি রূপান্তরের স্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকা এবং পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব দেশের জলবায়ু অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার সক্ষমতাকে সীমিত করছে। বাংলাদেশের জন্য এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো শক্তিশালী প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা এবং আন্তর্জাতিক অর্থায়ন কার্যকরভাবে ব্যবহার করা।
কপ৩০–এর ফলাফল বাংলাদেশের জন্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। অভিযোজন তহবিল, জাস্ট ট্রানজিশন এবং জেন্ডার সমতা বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে কপ৩০–এ ২০৩৫ সালের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অভিযোজন তহবিল তিনগুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাস্ট ট্রানজিশন মেকানিজম এবং হালনাগাদ জেন্ডার অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, যুবক ও প্রতিবন্ধীসহ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হবে। এই উদ্যোগগুলো বাংলাদেশের জলবায়ু নীতি ও কর্মপরিকল্পনায় সমতা, অন্তর্ভুক্তি ও ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরকে শক্তিশালী করবে।
তবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর স্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকা এবং বাস্তবায়নযোগ্য তহবিলের সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশের জন্য হতাশাজনক। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই সমুদ্রবন্দর, উপকূল ও নদী ভাঙনের কারণে ঝুঁকিতে আছে। দীর্ঘমেয়াদি তহবিল ব্যবস্থার জন্য এখনো পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি। লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে বরাদ্দ সীমিত থাকায় জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সহায়তা কম। অর্থাৎ, দেশকে এখন শক্তিশালী, তথ্যভিত্তিক প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বন, সমুদ্র ও উপকূল সংরক্ষণে নতুন উদ্যোগ বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে। ট্রপিক্যাল ফ্রস্ট ফরএভার ফ্যাসিলিটি এবং ব্লু এনডিসি চ্যালেঞ্জের মতো প্রকল্পে বাংলাদেশ অংশগ্রহণের মাধ্যমে বন সংরক্ষণ, পুনর্জীবিত সমুদ্রভূমি, নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক খাদ্য ও নীল কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। এটি জলবায়ু প্রতিরোধ ও সবুজ অর্থনীতি গঠনে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা দেবে।
আর্থিক কাঠামোর ক্ষেত্রে, ২০৩৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল জোগাড়ের লক্ষ্য বাংলাদেশসহ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এতে কারা দায়বদ্ধ, তা স্পষ্ট নয়। অর্থের অভাব ও ঋণভিত্তিক অর্থায়নের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো ঋণের বোঝা বাড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশকে নিজস্ব তহবিল ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক তহবিল সহজে ব্যবহারযোগ্য হয়।
লেখক: নির্বাহী সমন্বয়কারী, ইয়ুথনেট গ্লোবাল