এআই যেভাবে গতি আনছে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে

এআই যেভাবে গতি আনছে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে
ব্রিটিশ পতাকা এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। ছবি: রয়টার্স

উৎপাদন খাতে পিছিয়ে থাকা ব্রিটেন আশার আলো দেখছে। আর এ আশা দেখাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। বিশেষত পরিষেবা খাতে অল্প সময়ে বেশি গ্রাহকসেবার দরজা খুলে দিয়েছে এআই, যা দেশটির অর্থনীতিতে বড় গতি আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আধুনিক বিশ্বে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বিপ্লব নতুন কোনো বিষয় নয়। বর্তমান সময়ে এআই আমাদের জীবনকে সহজের পাশাপাশি অর্থ উপার্জন করতে সাহায্য করছে। এ ক্ষেত্রে দেশ হিসেবে ব্রিটেনের উদাহরণকে সামনে আনা যায়।

ব্রিটেনের মধ্যম শ্রেণির একটি আইটি ফার্মের অ্যাকাউন্ট্যান্টরা কাজ দ্রুত করার জন্য এআই ব্যবহার শুরু করে। মজার বিষয় এআই ব্যবহারের ফলে তাদের মুনাফার হার বৃদ্ধি পায়।

গত দুই দশক ধরে দেশটির অর্থনীতি ধুঁকছে। তাই ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী রাচেল রিভস বাজেটে কর বাড়ানোর কথা ভেবেছিলেন। তবে এআই-এর সম্প্রসারণ ব্রিটেনের অর্থনীতিতে আশা তৈরি করছে।

ব্রিটেনে এআই ব্যবহার ক্রমশই বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিদরা জানান, অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্রিটেনের  বেসরকারি পরিষেবা খাতে আধিপত্য বেশি। যদি দেশটি হিসাবরক্ষণ এবং অর্থায়নের মতো শক্তিশালী ক্ষেত্রগুলোতেও এআই ব্যবহার করতে পারে, তবে আরও বেশি উন্নতি আসতে পারে। 

ব্রিটেনে আগে করপোরেট জালিয়াতি পরীক্ষার জন্য দুই সপ্তাহের বেশি সময়ের প্রয়োজন হতো। তবে এখন তা দুই ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করা সম্ভব। একবার ভেবে দেখুন যদি কোনো কাজ এত দ্রুত শেষ করা সম্ভব হয়, তাহলে ওই একই সময়ে কতগুলো কাজ যাবে?

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আইটি কোম্পানি এমকেএসের ‘ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশন’ প্রধান বেকি শিল্ডস বলেন, “এআই কর্মীদের একই কাজ থেকে মুক্তি দিচ্ছে এবং ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করার জন্য আরও বেশি সময় দিচ্ছে।”

কর্মচারী। ছবি: রয়টার্স
কর্মচারী। ছবি: রয়টার্স

বেকি শিল্ডস আরও বলেন, “লার্জ ল্যাংগুয়েজ মডেলগুলো প্রযুক্তির অন্য ধারাগুলোর চেয়ে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। প্রতিদিন আরও নতুনত্ব যুক্ত হচ্ছে।”

তবে এআইয়ের জন্য ব্রিটেন কতটা প্রস্তুত, তা এখনো প্রশ্নের সম্মুখীন। আর যদি ব্রিটেন প্রস্তুতও হয়ে থাকে, তবে সে সুবিধা কতখানি ভোগ করতে পারবে দেশটির নাগরিকেরা। 

এআই-এর জন্য ইউকে প্রস্তুত

যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির প্রায় ৮০ শতাংশ আসে পরিষেবা খাত থেকে, যা আমেরিকার মতোই। সরকারি পরিষেবা বাদ দিলে এই খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি।

শুরুতে আমরা যুক্তরাজ্যের একটি আইটি ফার্ম নিয়ে কথা বলেছিলাম। আইটি ফার্ম এমকেএস তাদের কাজে জেমিনির ২.৫ মডেলের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

এ সম্পর্কিত এক গবেষণায় দেখা যায়, কোম্পানিটির যে দল এআই ব্যবহার করেছে, তা অন্যদলের চেয়ে চারগুণ বেশি হারে মুনাফা করেছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির সামগ্রিক মুনাফার হার বেড়েছিল ৮ শতাংশ।

আগে একই কাজের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে আলাদা করে অর্ডার, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ইত্যাদির প্রমাণপত্রের দরকার হতো। এখন সেখানে গ্রাহকরা তাদের পুরো ডেটাসেট আপলোড করতে পারে, যা কোম্পানিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে।

এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে কিছু বাড়তি কাজ করতে হলেও পরে সে কাজের সুফল পাওয়া যায় ব্যাপকভাবে। কারণ, শুরুতে কাজটি গুছিয়ে করতে পারলে তার পুনর্ব্যবহার করা যায় বারবার। এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহকদের কাগজপত্র জমা দেওয়ার ঝামেলা কমিয়ে আনা সম্ভব। আবার এর মাধ্যমে খুব অল্প সময়ে এবং একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করে আইটি কোম্পানিগুলো।

বিষয়টি নিয়ে এমকেএসের কর্মকর্তা বেকি শিল্ডস বলেন, “এআইয়ের ব্যবহার এখনো শেখার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। কিন্তু এর ইতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট।”

যুক্তরাজ্যের প্রায় প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন জেনারেল প্র্যাক্টিশনার (জিপি) রোগীর পরামর্শের সময় চ্যাটজিপিটি-এর মতো এআই ব্যবহার করছেন।

জিপি-রা রোগীর অ্যাপয়েন্টমেন্টের সারাংশ তৈরি, রোগ নির্ণয়ে সহায়তা এবং রুটিন প্রশাসনিক কাজের জন্য এআই ব্যবহার করছেন। 

নুফিল্ড ট্রাস্ট থিঙ্কট্যাঙ্ক ২,১০৮ জন পারিবারিক চিকিৎসকের ওপর একটি সমীক্ষা চালায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৩ শতাংশ পুরুষ জিপি এবং ২৫ শতাংশ নারী জিপি এআই ব্যবহার করছেন।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার জানিয়েছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্তরাজ্যের সরকারি পরিষেবাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ‘বিশাল সম্ভাবনা’ তৈরি করেছে।

স্টারমার চেষ্টা করছেন দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বড় পরিসরে এআই ব্যবহার নিশ্চিত করতে। কর্মজীবী মানুষের জন্য এআই প্রযুক্তি ব্যবহার আরও বাড়াতে চান তিনি।

ব্রিটিশ সরকার জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে প্রধান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো সহযোগিতা করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রকল্পে ১৪ বিলিয়ন পাউন্ড (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিয়োগ করতে চায়। এর মধ্য দিয়ে ১৩ হাজার ২৫০টি কর্মসংস্থান হবে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। ছবি: রয়টার্স
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। ছবি: রয়টার্স

গুগল ডিপমাইন্ড ব্রিটিশ সরকারের এআই সম্পর্কিত কর্মপরিকল্পনা ‘এআই অপরচুনিটিস অ্যাকশন প্ল্যান’-কে সমর্থন করবে। এ ছাড়া ব্রিটিশ সরকার ১৩৭ মিলিয়ন পাউন্ডের (১৮২ মিলিয়ন ডলারের বেশি) ‘এআই ফর সায়েন্স স্ট্র্যাটেজি’ প্রজেক্টকে আরও শক্তিশালী করতেও কাজ করবে গুগল। 

উৎপাদনশীলতার টানাপোড়েন

অন্যান্য দেশের মতো ব্রিটেনেও ২০০৭-০৮ সালের মহামন্দার প্রভাব পড়ে। ফলে গত ২০ বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বল হয়ে গেছে।

থিংকট্যাংক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ-এর মতে, উৎপাদন খাতের দুর্বলতার কারণেই ২০০৮ সাল থেকে ব্রিটেনের মজুরি বৃদ্ধি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে।

কিয়ার স্টারমার সরকার উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে অর্থনীতিকে সচল করতে পরিকল্পনা, অবকাঠামোর আধুনিকায়ন ও মানুষের দক্ষতা উন্নয়নের চেষ্টা করছে।

সরকার আশা করছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তারা সরকারি পরিষেবাগুলোতে আরও বেশি কর্মদক্ষতা আনতে পারবে। তবে জি-৭ জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেনের মুদ্রাস্ফীতির হার সর্বোচ্চ এবং অনেক মানুষ চাকরির বাজার থেকে সরে যাচ্ছে।

২০২৩ সালে জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেনের ব্যবসায়িক বিনিয়োগের হার ছিল দ্বিতীয়-সর্বনিম্ন। ২০২৪ সালে বিভিন্ন পরিষেবা বাণিজ্যে ব্রিটেন ২৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত আয় হয়, যা শীর্ষে থাকা আমেরিকার পরের অবস্থান।

ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রীর উপদেষ্টা সে সময় মন্তব্য করেছিলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্রিটেনের জন্য একটি ‘তুরুপের তাস’ হতে পারে। তবে ব্রিটিশ কারখানাগুলোয় এআই-এর সুবিধা এখও পর্যাপ্ত নয়। প্রবৃদ্ধি বাড়লে কি চাকরি কমবে?

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়ে বিশ্লেষকরা জানান, এআই-এর কারণে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কতটা হবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা খুব কঠিন। কারণ বাস্তব জগতে এর প্রয়োগ সম্পর্কে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি এআইকে একটি বড় পরিবর্তনকারী শক্তি হিসেবে দেখেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, টমাস এডিসন লাইট বাল্ব আবিষ্কারের পরও বিদ্যুতের প্রভাব উৎপাদন খাতে পড়তে প্রায় ৪০ বছর সময় লেগেছিল। তাই এআই নিয়ে আমাদের ‘বিনিয়োগ ও পড়ালেখা’ ধরে রাখতে হবে।

অন্যদিকে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যান আর্ক মনে করেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আগামী বছরগুলোতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধিতে শূন্য দশমিক ১ থেকে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ যোগ করতে পারে, যা অর্থনীতিতে সাহায্য করলেও সরকারের বাজেট তৈরিতে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো দূর করবে না।

এআই এবং মানুষ। ছবি: রয়টার্স
এআই এবং মানুষ। ছবি: রয়টার্স

অন্যদিকে ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের পল ডেলস বিশ্বাস করেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্ভবত ২০৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। ব্রিটেন ইউরোপের অন্যান্য বড় দেশগুলোর চেয়ে বেশি এআই ব্যবহার করতে পারে। কারণ হিসেবে দেশটির নিয়ম ও শ্রম আইনগুলো তুলনামূলক সহজ হওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

এআই-এর সুবিধাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় সংস্থাগুলোর পক্ষে যায়। কারণ বিনিয়োগ করার মতো তহবিল শুধু বড় কোম্পানিগুলোর কাছে আছে। এতে অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে।

শুরুতে উল্লেখ করা উদাহরণে ফেরা যাক। অ্যাকাউন্ট্যান্ট-এর মতো জায়গায় এআইয়ের পারদর্শিতা নিয়ে ব্রিটেনের কিছু সংস্থা উদ্বিগ্ন। তাদের মতে, ব্যবসায়ীরা এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছে না।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেসরকারি খাতের ১৭ শতাংশ নিয়োগকর্তা এআই-এর সহজলভ্যতার কারণে পরবর্তী ১২ মাসে কর্মী সংখ্যা কমানোর চেষ্টা করছেন। যেখানে মাত্র ৬ শতাংশ নিয়োগকর্তা কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছেন।

এআই নিয়ে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান থাকলেও ব্রিটেনে এআইয়ের ব্যবহার বাড়ছে। ব্রিটেনের অগ্রগতিতে এআইয়ের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে নাকি মুখ থুবড়ে পড়বে, তা দেখা সময়ের বিষয়।

সম্পর্কিত