রিতু চক্রবর্ত্তী

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় নানা অর্থায়নে এ সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পগুলোর ৫৪ শতাংশেই অনিয়ম রয়েছে। এমনকি চার বছরের প্রকল্প সম্পন্ন করতে ১৪ বছর লাগার উদাহরণও আছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে–বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যা বলে, তার মধ্যে আন্তরিকতা কতটা?
চলতি বছরের নভেম্বরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘গভার্ন্যান্স চ্যালেঞ্জেস ইন ক্লাইমেট ফিন্যান্স ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নে ৫১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ করা অর্থের ৫৭ দশমিক ৮ শতাংশই গেছে অবকাঠামো খাতে। মাত্র ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ গেছে মিটিগেশন বা প্রশমন খাতে। বাকিটা খাদ্যনিরাপত্তাসহ অন্য খাতগুলোয় বরাদ্দ করা হয়।
আর গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের ডেটা অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত পেয়েছে ৪৬ কোটি ৪৩ লাখ মার্কিন ডলার। চলমান আছে ১০টি প্রকল্প।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্টের আওতায় মোট ৮৯১টি প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ করেছে টিআইবি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের জাতীয় জলবায়ু তহবিল থেকে বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি অংশ দুর্নীতির প্রভাবে আক্রান্ত, যা জলবায়ু অর্থায়ন ব্যবস্থাপনায় শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা তুলে ধরেছে।
এই গবেষণা অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট (বিসিসিটিএ) থেকে করা বরাদ্দের ৫৪ শতাংশেই অনিয়ম পাওয়া গেছে। এই সময়ে ৮৯১টি প্রকল্পে দুর্নীতির পরিমাণ আনুমানিক ২৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার, যা প্রায় ২ হাজার ১১ কোটি টাকার সমপরিমাণ।
টিআইবি এই গবেষণায় প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো কিছু ত্রুটি দেখিয়েছে। এর মধ্যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে না পারা অন্যতম। গবেষণা অনুযায়ী, প্রকল্পগুলোর গড় মেয়াদ ৬৪৮ দিন থেকে বেড়ে ১,৫১৫ দিনে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, প্রকল্প বাস্তবায়নে পূর্বনির্ধারিত সময়ের তুলনায় প্রায় ১৩৩.৮ শতাংশ বেশি সময় লেগেছে। কিছু ক্ষেত্রে চার বছর মেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে লেগেছে ১৪ বছর পর্যন্ত।

আন্তর্জাতিক অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোতেও একই ধরনের বিলম্ব দেখা গেছে। গবেষণা অনুযায়ী, ৫১টি প্রকল্পের মধ্যে ৪১ দশমিক ২ শতাংশের সময়সীমা বাড়াতে হয়েছে।
তিন পর্বের এই বিশ্লেষণের প্রথম পর্বের একটি উদাহরণ এ পর্যায়ে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমরা মালাউইর উদাহরণ টেনে দেখিয়েছিলাম যে, কীভাবে তারা নিজেরাই নিজেদের সংকট ও সম্ভাবনা বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছে। সেইসঙ্গে আমরা এও বলেছিলাম যে, তারা এটি করতে পেরেছিল শুধু জোরালোভাবে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারার কারণে।
এ ক্ষেত্রে আমাদের জোরালো প্রতিনিধিত্ব না থাকায় আমরা নিজেদের মালাউইর মতো করে তুলে ধরতে পারিনি। পারার কথাও নয়। জোরালো দাবি তুলে ধরতে হলে প্রয়োজন হয় শক্ত ভিতের। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ঘরে–বাইরে নানা উৎসের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর অস্বাভাবিক হারের বর্ধিত মেয়াদ, বিরাট অঙ্কের দুর্নীতি সেই ভিতকে আগে থেকেই নড়বড়ে করে দিচ্ছে। আর এই নড়বড়ে ভিতে দাঁড়িয়ে আর যা–ই হোক ভাষণ দেওয়া সম্ভব হলেও দাবি আদায় বা দাবির পক্ষে আস্থা অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে এগোতে হলে প্রস্তুতির বিকল্প নেই। আর এ প্রস্তুতি শুধু জলাবায়ু সম্মেলনের দুই সপ্তাহের বিষয় নয়, সারা বছরের বিষয়।
আমরা যদি প্রকল্পগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখব, আমাদের প্রকল্পগুলো বেশির ভাগই অভিযোজনকেন্দ্রিক। মিটিগেশন বা প্রশমনভিত্তিক প্রকল্প খুবই কম। এমনকি আমরা যদি গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের ওয়েবসাইট অনুযায়ী চলমান ১০টি প্রকল্পের দিকে তাকাই, তবে আটটি প্রকল্পকেই অভিযোজনকেন্দ্রিক হিসেবে তালিকাবদ্ধ করতে পারব।
এবারের কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ এলডিসি ব্লক থেকে অভিন্ন যেসব দাবি জানিয়েছে, তার অন্যতম হলো–অভিযোজন-সংক্রান্ত তহবিল তিনগুণ করা। কিন্তু অভিযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে জলবায়ু পরিবর্তন কতটা মোকাবিলা করা যাবে সেই প্রশ্ন ওঠে, যেখানে ৯ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চঝুঁকিতে আছে।
এ বিষয়ে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশনের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ চরচাকে বলেন, “অভিযোজনের অংশ হিসেবে আমরা নদীতে বাঁধ দিচ্ছি বন্যা ঠেকাতে। কিন্তু এভাবে আমরা নতুন ভূমি তৈরি হওয়াও বন্ধ করে দিচ্ছি। ফলে বন্যাকে আমরা প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসেবেই দেখছি। কিন্তু এর আশীর্বাদ যে আছে, সেটা ভুলে যাচ্ছি।”
আজাদ বলেন, “বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিসকোর্সে লোকাল কনটেক্সট উঠে আসেনি। তাই আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মিল রেখে, নদীর সাথে সমঝোতার পথ না খুঁজে, এবং সেই অনুযায়ী বাড়িঘর না বানিয়ে, বানাচ্ছি বাঁধ।”

আমরা কেন প্রশমনকে গুরুত্ব দিই না–এই প্রসঙ্গে আজাদ বলেন, “আমাদের নীতিনির্ধারকরা সবসময়ই ‘ট্র্যাডিশনাল’। আর এই ধারাবাহিকতায়ই জলবায়ু মোকাবিলায় আমরা অভিযোজন তহবিলের আকাঙ্ক্ষাই রাখি, টেকসই সমাধানে আমদের আগ্রহ কম। দিনশেষে আমাদের মিটিগেশনেই যেতে হবে, নয়তো ওই ব্যঙের মতো হবে, যে ফুটন্ত পানিতে প্রথমে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে, পরে হাল ছেড়ে দেয় এবং শেষে মরে যায়।”
আর তাই আজাদ মনে করেন জলবায়ু মোকাবিলায় আমাদের ‘উদ্ভাবনী’ হতে হবে।
আমরা প্রতি বছরই জলবায়ু সম্মেলনে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের টেকসই জলবায়ু মোকাবিলার তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। তাই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা ৯ কোটি মানুষেরও ভাগ্যে তেমন পরিবর্তন নেই। তবে বছর বছর বাড়ছে দূর্গতি। গত ১০ নভেম্বর যখন এবারের কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলন শুরু হচ্ছে, ঠিক তখন রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে আমরা দেখলাম কুড়িগ্রামের নুরুন নবী নামের এক কৃষক ৩১ বারের মতো ভিটেমাটি হারাচ্ছেন নদীভাঙনে।
এই ৩০ বছরে নুরুন নবীদের মতো মানুষের ভাগ্যে আমরা তেমন পরিবর্তন দেখি না। দেখি যে, তাদের মতো জলাবায়ু উদ্বাস্তুরা ভিটেমাটি আর জীবিকা হারিয়ে যখন শহরের দিকে পা বাড়ান, তাদের জায়গা হয় কড়াইল বা বেগুনবাড়ির মতো বস্তিতে। আর সেই আশ্রয়ও স্থায়ী হচ্ছে না, কখনো আগুন বা কখনো আগুনের আড়ালে থাকা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। কোনো ধরনের পুনর্বাসন পরিকল্পনা ছাড়াই এ ধরনের বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে, যার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশই আসলে ক্লাইমেট রিফিউজি বা জলবায়ু উদ্বাস্তু।
এই জলবায়ু উদ্বাস্তু বা বাস্তুচ্যুতদের কী হবে–এ নিয়ে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় থাকছে না কোনো আলাদা পরিকল্পনা। আজাদের মতে, আমাদের হাতে তাদের জন্য কোনো ‘মাস্টারপ্ল্যান’ নেই। তিনি বলেন, “আমরা উন্নয়ন করছি। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কোনো প্ল্যান নেই, যেমন মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে জীবিকা হারানো মানুষদের জন্য প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে কোনো পরিকল্পনাই নেই। যে উন্নয়নে আমাদের বর্তমান ঝুঁকিতে পড়ছে, তা কীভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে–আমি আসলে জানি না।”
এই প্রসঙ্গে আলাপ উঠলে আমাদের নীতিনির্ধারকরা হয়তো আমাদের দারিদ্র্যের কথা বলবেন। কিন্তু ব্রাজিলের মতো মধ্যম আয়ের দেশেরও বাস্তুচ্যুতদের জন্য আছে ‘মাই হোম মাই লাইফ’ নামের সরকারি হাউজিং প্রোগ্রাম। ব্রাজিলের সমান জিডিপি না থাকলেও আমরা এতটাও ‘গরীব’ না যে, আমরা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য একটা আবাসন প্রকল্প নিতে পারব না।

অবশ্য আবাসন প্রকল্প যে, আমাদের একেবারেই নেই তা নয়। আশ্রয়ন প্রকল্প নামে এক আবাসন কার্যক্রম বাংলাদেশেরও আছে গত কয়েক বছর ধরে। কিন্তু যখন দেখা যায়, অবস্থানজনিত বা নির্মাণজনিত কারণে এসব বাসস্থানের অধিকাংশই পরিত্যক্ত, তখন বোঝা যায় বাস্তুচ্যুতদের এতে খুব বেশি লাভ হয়নি।
আর এর পেছনের কারণ খুঁজতে আমাদের খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। এ পর্বের শুরুতেই আমরা দেখেছি যে, দেশীয় অর্থায়নের ৫৪ শতাংশেই দুর্নীতি এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়নেই ব্যাপক কালবিলম্ব। তাই আমাদের আশ্রয়ণ প্রকল্প কেন ব্রাজিলের ‘মাই হোম, মাই লাইফ’ হয়ে ওঠে না, তা বুঝতে খুব বেশি পরিশ্রম করার প্রয়োজন হয় না।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় নানা অর্থায়নে এ সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পগুলোর ৫৪ শতাংশেই অনিয়ম রয়েছে। এমনকি চার বছরের প্রকল্প সম্পন্ন করতে ১৪ বছর লাগার উদাহরণও আছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে–বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যা বলে, তার মধ্যে আন্তরিকতা কতটা?
চলতি বছরের নভেম্বরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘গভার্ন্যান্স চ্যালেঞ্জেস ইন ক্লাইমেট ফিন্যান্স ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নে ৫১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ করা অর্থের ৫৭ দশমিক ৮ শতাংশই গেছে অবকাঠামো খাতে। মাত্র ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ গেছে মিটিগেশন বা প্রশমন খাতে। বাকিটা খাদ্যনিরাপত্তাসহ অন্য খাতগুলোয় বরাদ্দ করা হয়।
আর গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের ডেটা অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত পেয়েছে ৪৬ কোটি ৪৩ লাখ মার্কিন ডলার। চলমান আছে ১০টি প্রকল্প।
এ ছাড়া বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্টের আওতায় মোট ৮৯১টি প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ করেছে টিআইবি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের জাতীয় জলবায়ু তহবিল থেকে বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি অংশ দুর্নীতির প্রভাবে আক্রান্ত, যা জলবায়ু অর্থায়ন ব্যবস্থাপনায় শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা তুলে ধরেছে।
এই গবেষণা অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট (বিসিসিটিএ) থেকে করা বরাদ্দের ৫৪ শতাংশেই অনিয়ম পাওয়া গেছে। এই সময়ে ৮৯১টি প্রকল্পে দুর্নীতির পরিমাণ আনুমানিক ২৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার, যা প্রায় ২ হাজার ১১ কোটি টাকার সমপরিমাণ।
টিআইবি এই গবেষণায় প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো কিছু ত্রুটি দেখিয়েছে। এর মধ্যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে না পারা অন্যতম। গবেষণা অনুযায়ী, প্রকল্পগুলোর গড় মেয়াদ ৬৪৮ দিন থেকে বেড়ে ১,৫১৫ দিনে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, প্রকল্প বাস্তবায়নে পূর্বনির্ধারিত সময়ের তুলনায় প্রায় ১৩৩.৮ শতাংশ বেশি সময় লেগেছে। কিছু ক্ষেত্রে চার বছর মেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে লেগেছে ১৪ বছর পর্যন্ত।

আন্তর্জাতিক অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোতেও একই ধরনের বিলম্ব দেখা গেছে। গবেষণা অনুযায়ী, ৫১টি প্রকল্পের মধ্যে ৪১ দশমিক ২ শতাংশের সময়সীমা বাড়াতে হয়েছে।
তিন পর্বের এই বিশ্লেষণের প্রথম পর্বের একটি উদাহরণ এ পর্যায়ে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমরা মালাউইর উদাহরণ টেনে দেখিয়েছিলাম যে, কীভাবে তারা নিজেরাই নিজেদের সংকট ও সম্ভাবনা বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছে। সেইসঙ্গে আমরা এও বলেছিলাম যে, তারা এটি করতে পেরেছিল শুধু জোরালোভাবে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারার কারণে।
এ ক্ষেত্রে আমাদের জোরালো প্রতিনিধিত্ব না থাকায় আমরা নিজেদের মালাউইর মতো করে তুলে ধরতে পারিনি। পারার কথাও নয়। জোরালো দাবি তুলে ধরতে হলে প্রয়োজন হয় শক্ত ভিতের। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ঘরে–বাইরে নানা উৎসের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলোর অস্বাভাবিক হারের বর্ধিত মেয়াদ, বিরাট অঙ্কের দুর্নীতি সেই ভিতকে আগে থেকেই নড়বড়ে করে দিচ্ছে। আর এই নড়বড়ে ভিতে দাঁড়িয়ে আর যা–ই হোক ভাষণ দেওয়া সম্ভব হলেও দাবি আদায় বা দাবির পক্ষে আস্থা অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে এগোতে হলে প্রস্তুতির বিকল্প নেই। আর এ প্রস্তুতি শুধু জলাবায়ু সম্মেলনের দুই সপ্তাহের বিষয় নয়, সারা বছরের বিষয়।
আমরা যদি প্রকল্পগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখব, আমাদের প্রকল্পগুলো বেশির ভাগই অভিযোজনকেন্দ্রিক। মিটিগেশন বা প্রশমনভিত্তিক প্রকল্প খুবই কম। এমনকি আমরা যদি গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের ওয়েবসাইট অনুযায়ী চলমান ১০টি প্রকল্পের দিকে তাকাই, তবে আটটি প্রকল্পকেই অভিযোজনকেন্দ্রিক হিসেবে তালিকাবদ্ধ করতে পারব।
এবারের কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ এলডিসি ব্লক থেকে অভিন্ন যেসব দাবি জানিয়েছে, তার অন্যতম হলো–অভিযোজন-সংক্রান্ত তহবিল তিনগুণ করা। কিন্তু অভিযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে জলবায়ু পরিবর্তন কতটা মোকাবিলা করা যাবে সেই প্রশ্ন ওঠে, যেখানে ৯ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের উচ্চঝুঁকিতে আছে।
এ বিষয়ে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশনের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ চরচাকে বলেন, “অভিযোজনের অংশ হিসেবে আমরা নদীতে বাঁধ দিচ্ছি বন্যা ঠেকাতে। কিন্তু এভাবে আমরা নতুন ভূমি তৈরি হওয়াও বন্ধ করে দিচ্ছি। ফলে বন্যাকে আমরা প্রাকৃতিক দূর্যোগ হিসেবেই দেখছি। কিন্তু এর আশীর্বাদ যে আছে, সেটা ভুলে যাচ্ছি।”
আজাদ বলেন, “বাংলাদেশের ডেভেলপমেন্ট ডিসকোর্সে লোকাল কনটেক্সট উঠে আসেনি। তাই আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মিল রেখে, নদীর সাথে সমঝোতার পথ না খুঁজে, এবং সেই অনুযায়ী বাড়িঘর না বানিয়ে, বানাচ্ছি বাঁধ।”

আমরা কেন প্রশমনকে গুরুত্ব দিই না–এই প্রসঙ্গে আজাদ বলেন, “আমাদের নীতিনির্ধারকরা সবসময়ই ‘ট্র্যাডিশনাল’। আর এই ধারাবাহিকতায়ই জলবায়ু মোকাবিলায় আমরা অভিযোজন তহবিলের আকাঙ্ক্ষাই রাখি, টেকসই সমাধানে আমদের আগ্রহ কম। দিনশেষে আমাদের মিটিগেশনেই যেতে হবে, নয়তো ওই ব্যঙের মতো হবে, যে ফুটন্ত পানিতে প্রথমে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে, পরে হাল ছেড়ে দেয় এবং শেষে মরে যায়।”
আর তাই আজাদ মনে করেন জলবায়ু মোকাবিলায় আমাদের ‘উদ্ভাবনী’ হতে হবে।
আমরা প্রতি বছরই জলবায়ু সম্মেলনে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের টেকসই জলবায়ু মোকাবিলার তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। তাই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা ৯ কোটি মানুষেরও ভাগ্যে তেমন পরিবর্তন নেই। তবে বছর বছর বাড়ছে দূর্গতি। গত ১০ নভেম্বর যখন এবারের কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলন শুরু হচ্ছে, ঠিক তখন রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে আমরা দেখলাম কুড়িগ্রামের নুরুন নবী নামের এক কৃষক ৩১ বারের মতো ভিটেমাটি হারাচ্ছেন নদীভাঙনে।
এই ৩০ বছরে নুরুন নবীদের মতো মানুষের ভাগ্যে আমরা তেমন পরিবর্তন দেখি না। দেখি যে, তাদের মতো জলাবায়ু উদ্বাস্তুরা ভিটেমাটি আর জীবিকা হারিয়ে যখন শহরের দিকে পা বাড়ান, তাদের জায়গা হয় কড়াইল বা বেগুনবাড়ির মতো বস্তিতে। আর সেই আশ্রয়ও স্থায়ী হচ্ছে না, কখনো আগুন বা কখনো আগুনের আড়ালে থাকা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। কোনো ধরনের পুনর্বাসন পরিকল্পনা ছাড়াই এ ধরনের বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে, যার বাসিন্দাদের একটা বড় অংশই আসলে ক্লাইমেট রিফিউজি বা জলবায়ু উদ্বাস্তু।
এই জলবায়ু উদ্বাস্তু বা বাস্তুচ্যুতদের কী হবে–এ নিয়ে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় থাকছে না কোনো আলাদা পরিকল্পনা। আজাদের মতে, আমাদের হাতে তাদের জন্য কোনো ‘মাস্টারপ্ল্যান’ নেই। তিনি বলেন, “আমরা উন্নয়ন করছি। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কোনো প্ল্যান নেই, যেমন মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে জীবিকা হারানো মানুষদের জন্য প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে কোনো পরিকল্পনাই নেই। যে উন্নয়নে আমাদের বর্তমান ঝুঁকিতে পড়ছে, তা কীভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে–আমি আসলে জানি না।”
এই প্রসঙ্গে আলাপ উঠলে আমাদের নীতিনির্ধারকরা হয়তো আমাদের দারিদ্র্যের কথা বলবেন। কিন্তু ব্রাজিলের মতো মধ্যম আয়ের দেশেরও বাস্তুচ্যুতদের জন্য আছে ‘মাই হোম মাই লাইফ’ নামের সরকারি হাউজিং প্রোগ্রাম। ব্রাজিলের সমান জিডিপি না থাকলেও আমরা এতটাও ‘গরীব’ না যে, আমরা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য একটা আবাসন প্রকল্প নিতে পারব না।

অবশ্য আবাসন প্রকল্প যে, আমাদের একেবারেই নেই তা নয়। আশ্রয়ন প্রকল্প নামে এক আবাসন কার্যক্রম বাংলাদেশেরও আছে গত কয়েক বছর ধরে। কিন্তু যখন দেখা যায়, অবস্থানজনিত বা নির্মাণজনিত কারণে এসব বাসস্থানের অধিকাংশই পরিত্যক্ত, তখন বোঝা যায় বাস্তুচ্যুতদের এতে খুব বেশি লাভ হয়নি।
আর এর পেছনের কারণ খুঁজতে আমাদের খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। এ পর্বের শুরুতেই আমরা দেখেছি যে, দেশীয় অর্থায়নের ৫৪ শতাংশেই দুর্নীতি এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়নেই ব্যাপক কালবিলম্ব। তাই আমাদের আশ্রয়ণ প্রকল্প কেন ব্রাজিলের ‘মাই হোম, মাই লাইফ’ হয়ে ওঠে না, তা বুঝতে খুব বেশি পরিশ্রম করার প্রয়োজন হয় না।