ড. হাবিব সিদ্দিকি

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। একইসাথে টালমাটাল করে দিয়েছে দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্ক- ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় বন্ধন। পরবর্তীতে দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস্যভাবে আস্থার সংকট ঘনীভূত হয়েছে, পাল্টাপাল্টি বাকবিতণ্ডা বেড়েছে এবং উভয় দেশই এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা একটি উদ্বেগজনক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নয়াদিল্লি এই সম্পর্ককে একসময় কোঅপারেটিভ প্রাগমেটিজম বা 'সহযোগিতামূলক বাস্তববাদ' হিসেবে অভিহিত করলেও অধিকাংশ বাংলাদেশির কাছে এটি ছিল সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে এক অসম সমঝোতা। বর্তমানে সেই সুসম্পর্ক অভিযোগ এবং সরাসরি বৈরিতার দিকে মোড় নিয়েছে।
জুলাই বিপ্লবের (যাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতাও বলা হয়) অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ওসমান হাদdর হত্যাকাণ্ড বর্তমানে একটি চরম উত্তপ্ত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ভঙ্গুরতাকে যেমন ফুটিয়ে তুলেছে, তেমনি ভারত-বিরোধী মনোভাবকেও আরও উসকে দিয়েছে।
স্ক্রল ডট ইন-এর এক লেখায় অশোক সোয়াইন বলেছেন যে, এই হত্যাকাণ্ড ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ককে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ভারতে পালিয়ে গেছেন- যখন শেখ হাসিনাকে ১,৪০০-এর বেশি বাংলাদেশির মৃত্যুর দায়ে দণ্ডিত করার দাবি জানানো হচ্ছে, তখন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা ভারতকে আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে।
বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হাদি হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদ এবং তার সহযোগীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, "এই লেনদেনগুলো মানি লন্ডারিং, সংঘবদ্ধ অপরাধ এবং সম্ভাব্য জঙ্গি অর্থায়নের সাথে যুক্ত থাকতে পারে।"
সাম্প্রতিক সংবাদ এবং বিশ্লেষণে বাংলাদেশের রাজপথে ভারত-বিরোধী ক্ষোভ, দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং ক্রমবর্ধমান ভীতির বিষয় উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, উভয় পক্ষ যদি এভাবে 'আগুনে ঘি ঢালা' অব্যাহত রাখে, তবে গত এক দশকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা থমকে যেতে পারে বা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
কীভাবে আমরা এই পর্যায়ে পৌঁছালাম?
'স্ক্রল'-এর বিশ্লেষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। তা হলো ভারতীয় রাজনৈতিক আলোচনা এবং গণমাধ্যমের একাংশ বাংলাদেশের এই পটপরিবর্তনকে মূলত একটি 'নিরাপত্তা ঝুঁকি' হিসেবে বিবেচনা করছে। তারা হাসিনা-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাকে সন্দেহের চোখে দেখছে, ঢাকা-বিরোধী বক্তব্যগুলোকে বড় করে দেখাচ্ছে এবং ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানকে চরমপন্থী হুমকি হিসেবে তুলে ধরছে। নিবন্ধটিতে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান বাংলাদেশের ভেতরে বিদ্যমান অস্থির জনমতে আগুনের ওপর ঘি ঢালার মতো কাজ করছে।
এই নেতিবাচক পরিস্থিতির সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু প্রতীকী সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুতির পর ভারতে শেখ হাসিনার দীর্ঘকালীন অবস্থান। অনেক বাংলাদেশি বিষয়টিকে দেখছেন নতুন ব্যবস্থার বিপরীতে পুরনো ব্যবস্থার ওপর নয়াদিল্লির রাজনৈতিক বাজি হিসেবে। এই দৃশ্যমান পরিস্থিতিগুলো মোটেও তুচ্ছ নয়। বরং এগুলো ভারতবিরোধী জনমত গঠন করছে এবং নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসার ক্ষেত্রে আরও অনমনীয় করে তুলতে পারে।
স্বতন্ত্র বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কের এই নির্লিপ্ততা এখন আর শুধু কূটনৈতিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। এটি সরাসরি ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত হানছে। একসময় ভারতের হাসপাতালগুলোর জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলারের আয়ের উৎস ছিল বাংলাদেশি 'মেডিক্যাল ট্যুরিজম'। বর্তমানে সেই খাতে ধস নামা থেকে স্পষ্ট হয় যে, রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপগুলো কীভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
জুলাই বিপ্লবের দাবি কী ছিল এবং কেন এটি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ
আমার ব্যক্তিগত এবং যৌথভাবে লিখিত প্রবন্ধগুলোতে এটি জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের তরুণদের এই গণঅভ্যুত্থান ছিল মূলত জবাবদিহিতা, আইনের শাসন এবং মর্যাদার লড়াই। এটি ছিল স্বজনপ্রীতি, রাজনীতিকীকরণ হওয়া প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ।
আমরা আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং অর্থনৈতিক স্বস্তি নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় জবাবদিহিতা অধ্যাদেশ, একটি শক্তিশালী দুর্নীতি দমন ব্যুরো এবং দ্রুত পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছি। একইসাথে এতে সংখ্যালঘু সুরক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃঢ় নিশ্চয়তা রাখা হয়েছে, যাতে কোনো পক্ষই উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই রাজনৈতিক উত্তরণকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে না পারে।
অভ্যন্তরীণ এই অগ্রাধিকারগুলো অনিবার্যভাবেই দেশটির পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করছে। যে সরকার দেশে পদ্ধতিগত সংস্কার করতে চায়, সীমান্তের অপরপাশে তাদের জন্য একটি স্থিতিশীল ও হস্তক্ষেপহীন প্রতিবেশী প্রয়োজন।
অন্যদিকে, কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র যদি পক্ষপাতের সংকেত দেয় - তা রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার রাজনীতি হোক বা নিরাপত্তাকেন্দ্রিক মন্তব্যের মাধ্যমেই হোক না কেন-তা ঢাকার উদারপন্থীদের অবস্থান দুর্বল করে দেয়। এর ফলে কট্টরপন্থীরা শক্তিশালী হয় এবং বাস্তবসম্মত দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার পথ সংকুচিত হয়ে আসে।
উত্তোজনার আবর্ত: ঘটনা ও বাগাড়ম্বর
হাসিনার পতনের পর থেকে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যম। ভুয়া খবর এবং বানোয়াট বয়ানের একটি জোয়ার তৈরি করে বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতার এমন এক ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে, যেন তাদের অস্তিত্বই এখন বিপন্ন। তবে স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকরা এই দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাননি, বরং এগুলোকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতি হিসেবে উন্মোচিত করেছেন। এই প্রচারণা মূলত গোঁড়ামি এবং অসহিষ্ণুতার সেই বৃহত্তর কাঠামোর সঙ্গেই মিলে যায়, যা বর্তমান বিজেপি শাসনামলে ভারতের রাজনৈতিক আলোচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের নিজস্ব বাংলাভাষী মুসলিমরাও এই চরম প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছেন। ২০২৫ সালের মে থেকে জুনের মধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ভারতীয় নাগরিকসহ ১,৫০০ এরও বেশি বাংলাভাষী মুসলিমকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে 'পুশ-ব্যাক' বা বিতাড়িত করেছে, যা মানবিক উদ্বেগ এবং কূটনৈতিক টানাপড়েনকে আরও উসকে দিয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরে বিশেষ করে অধিকৃত কাশ্মীর এবং উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলিমদের ঘরবাড়ি, মসজিদ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে নয়া দিল্লিতে প্রকাশ্যেই আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে তিনি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে চরমপন্থীদের ক্ষমতায়ন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অস্থিতিশীল করার অভিযোগ তুলেছেন। এই আচরণ মূলত নির্বাসনে থেকে রাজনৈতিক সমালোচনা উসকে দেওয়ারই নামান্তর। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যেই ভারত এই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে। ভারত-পন্থী এবং আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্কের অর্থায়নে (এর অনেকগুলোই ভারত থেকে পরিচালিত হচ্ছে) বাংলাদেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং ঘেরাও কর্মসূচি প্রায় প্রাত্যহিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে প্রতিটি ইস্যুই দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কোনো এক ভারতীয় রাজনীতিবিদ চট্টগ্রাম দখলের ডাক দিচ্ছেন, পাল্টা জবাবে ঢাকা থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি আসছে, চলছে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক তলব, ওসমান হাদী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ভারত-বিরোধী বিক্ষোভ এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশন। এসব দাবির সত্যতা যাই হোক না কেন, দুই দেশের মধ্যেই একে অপরের প্রতি বৈরী মনোভাব তৈরি হচ্ছে। আর এই বিষয়টিই অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এই চক্র যদি চলতেই থাকে, তবে এর প্রথম শিকার হবে দুই দেশের মধ্যকার কানেক্টিভিটি বা সংযোগ প্রকল্পগুলো, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সংস্কার এবং দীর্ঘদিনের সেই নিরব কারিগরি সহযোগিতা- যা ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক ধাক্কা থেকে এই সম্পর্ককে সুরক্ষা দিয়ে এসেছে। তবে এর চেয়েও গভীর ঝুঁকি হলো একটি কাঠামোগত পরিবর্তন- যেখানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মূল সমস্যা সমাধান তো হবেই না, কেবল পারস্পরিক অভিযোগ ও বৈরীতাই বাড়বে।

এখানে আমি ঢাকা ও নয়াদিল্লির জন্য ১০টা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের পরামর্শ দিচ্ছি-
১। পারস্পরিক নিরাপদ আশ্রয় না দেওয়ার অঙ্গীকার
উভয় পক্ষকে প্রকাশ্যে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, কোনো দেশই রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল পলাতক ব্যক্তিদের আশ্রয় দেবে না কিংবা তাদের ভূখণ্ডকে একে অপরের অস্থিতিশীলতায় ব্যবহৃত হতে দেবে না। প্রতিটি ঘটনার আলাদা সমন্বয় এবং দ্রুত বিভ্রান্তি দূর করার জন্য দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি হটলাইন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এটি ক্ষমতাচ্যুতির পর নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ সংক্রান্ত নেতিবাচক ধারণা এবং এ সংক্রান্ত গুজবগুলো মোকাবিলায় সরাসরি ভূমিকা রাখবে। উচ্চপর্যায়ের মামলাগুলোতে স্বচ্ছ সহযোগিতার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে, যার মধ্যে ফৌজদারি অপরাধের সম্মুখীন ব্যক্তিদের বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকবে। আর এতে থাকবে আইনের শাসনের প্রতি উভয় পক্ষের পারস্পরিক অঙ্গীকার।
২) গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বক্তব্যের পরিমিতিবোধ
উভয় দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উত্তেজনা প্রশমনকারী ভাষা ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে 'চরমপন্থা' হিসেবে আখ্যা দিয়ে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রায়িত করা এবং প্রতিবেশীকে নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রেস কাউন্সিলগুলোর মাধ্যমে সম্পাদকীয় গোলটেবিল বৈঠক এবং যৌথ মিডিয়া অ্যাডভাইজরি বা নির্দেশিকা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা উসকানিমূলক এবং চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশনের প্রবণতা কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে।
৩) সংখ্যালঘু সুরক্ষাকে অভিন্ন ‘রেড লাইন’ হিসেবে পুনঃনিশ্চিত করা
ঢাকা এবং নয়াদিল্লি, উভয় পক্ষ থেকেই পুনরায় এই বার্তা দিতে হবে যে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং মন্দির, গির্জা বা মসজিদে হামলা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। এই লক্ষ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা যেতে পারে। মন্দির ভাঙচুরের গুজবকে কীভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় তা ২০২৪ সালের আগস্টে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কাছে লেখা আমার খোলা চিঠিতে আমি উল্লেখ করেছিলাম। এটি মোকাবিলা করতে প্রয়োজন স্বচ্ছ ও যৌথ ফ্যাক্ট-চেকিং এবং দ্রুত জনসমক্ষে তথ্য প্রকাশ করা।
৪) পরিস্থিতি শান্ত করতে জবাবদিহিতামূলক সংস্কার ত্বরান্বিত করা
জাতীয় জবাবদিহিতা অধ্যাদেশ কার্যকর করা, একটি স্বাধীন সম্পদ পুনরুদ্ধার ব্যুরো গঠন এবং প্রতি মাসের অগ্রগতির পরিসংখ্যান (কত সম্পদ জব্দ হলো, কত তহবিল উদ্ধার হলো এবং কতটি মামলা দায়ের হলো) প্রকাশ করতে হবে। অর্থনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা রাজনীতিকে শান্ত করে জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি বিদেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত ‘অরাজকতার বয়ান’ নস্যাৎ করতে সহায়ক হবে।
৫) নদ-নদী ও জ্বালানি: ১০০ দিনের মধ্যে দৃশ্যমান সাফল্য
অল্প সময়ের মধ্যে অর্জনযোগ্য কিছু লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতে হবে, যেমন আন্তঃদেশীয় নদী বিষয়ক তথ্য বিনিময়, পরীক্ষামূলকভাবে ঋতুভিত্তিক পানি বণ্টন এবং বিদ্যুৎ বাণিজ্য তফসিলে স্বচ্ছতা বাড়ানো। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে এটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে যে, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এখনো তাদের জন্য বাস্তব সুফল বয়ে আনছে। বড় বড় যৌথ বিবৃতির চেয়ে দ্রুত দৃশ্যমান সাফল্য জনমনে আস্থা ফেরাতে বেশি কার্যকর।
৬) রাজনৈতিক শরণার্থী ও হাই-প্রোফাইল মামলার যৌথ প্রোটোকল
শেখ হাসিনার অবস্থানের সংবেদনশীলতার কথা বিবেচনায় রেখে ঢাকা ও নয়াদিল্লির উচিত মামলা পরিচালনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রোটোকল বা বিধিমালা তৈরি করা। এর মধ্যে মানবিক সুরক্ষা, রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবহার রোধ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিষয়ে স্বচ্ছতা ও স্পষ্ট সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত। স্বচ্ছ নিয়মাবলী থাকলে উত্তজনা প্রশমিত হয় এবং গুজব ছড়ানোর সুযোগ কমে যায়।
৭) সীমান্ত জননিরাপত্তা চার্টার
একটি ‘সীমান্ত মানব নিরাপত্তা উদ্যোগ’ (Border Human Security Initiative) চালু করা প্রয়োজন। এর আওতায় সীমান্তে প্রাণঘাতী ঘটনা কমিয়ে আনতে যৌথ প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি লিয়াজোঁ বোর্ড এবং তথ্য বিনিময়ের জন্য শেয়ারড ড্যাশবোর্ড তৈরি করা যেতে পারে। গণমাধ্যমে প্রচারিত অনেক উত্তেজনাকর ঘটনার সূত্রপাত হয় সীমান্ত এলাকা থেকে। তাই কিছু মানব-নিয়ন্ত্রিত প্রোটোকল অনুসরণ করলে সীমান্তকে ভয়ের পরিবর্তে একটি স্বাভাবিক চলাচলের পথে পরিণত করা সম্ভব।
৮) রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তরুণ সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিনিময় কর্মসূচি
স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামস, নদী ও লজিস্টিকস বিষয়ক বিভিন্ন ইভেন্ট এবং যৌথ বৃত্তি বাড়ানো প্রয়োজন। জুলাই বিপ্লব ছিল তরুণদের নেতৃত্বাধীন। তাই এই প্রজন্মকে যদি গঠনমূলক আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগের সুযোগ করে দেওয়া হয়, তবে তারা বৈরী প্রচারণার বিপদ সম্পর্কে সংবেদনশীল হবে এবং দুই দেশের সহনশীল সম্পর্কের পক্ষে একটি জনমত তৈরি হবে।
৯) কূটনীতিকদের মধ্যে ‘নো সারপ্রাইজ’ বা আগাম বার্তার চুক্তি
উভয় দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনাররা এই মর্মে একমত হতে পারেন যে, যেকোনো সংবেদনশীল পদক্ষেপ (যেমন: সমন পাঠানো, অ্যাডভাইজারি জারি বা বড় কোনো জনবিবৃতি) নেওয়ার আগে তারা ব্যক্তিগতভাবে একে অপরকে আগাম অবহিত করবেন। এই 'নো সারপ্রাইজ' বা আগাম বার্তার অভ্যাস থাকলে তুচ্ছ প্রতীকী ঘটনাগুলো সহজে বড় ধরনের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে রূপ নিতে পারবে না।
১০) ভারতের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ক্ষমা প্রার্থনা
গত কয়েক দশক ভারতের আচরণ একজন প্রতিবেশী বা অংশীদারের মতো ছিল না, বরং তাদের আচরণ ছিল আধিপত্যবাদী শক্তির মতো। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে এবং বাংলাদেশের স্বার্থের বিনিময়ে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। এই ধারার অবসান হওয়া জরুরি। অতীতের ভুলগুলোর অকপট স্বীকারোক্তিই প্রকৃত ‘রিসেট’ বা সম্পর্কের নতুন শুরু হতে পারে । বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা দীর্ঘদিনের এই গভীর অবিশ্বাস দূর করতে এবং সম্পর্ক পুনর্গঠনে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে।
তবে হ্যাঁ, ভারতের জন্য এভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া একদমই সহজ হবে না। কিন্তু ভারতের নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য এটি অপরিহার্য। হাসিনা আমলে 'কানেক্টিভিটি' বা সংযোগের নামে ভারত নজিরবিহীন ও একতরফা সুবিধা ভোগ করেছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে স্থলপথ ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল যাকে 'সেভেন সিস্টার্স' অঞ্চলের সমুদ্র ব্যবহারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ নিশ্চিত করেছে, যা তাদের আঞ্চলিক এবং সামুদ্রিক কৌশলকে শক্তিশালী করেছে।
ভারত এর থেকে ব্যাপক সুফল ভোগ করেছে। মিতালী, বন্ধন এবং মৈত্রী এক্সপ্রেসের মতো নতুন আন্তঃসীমান্ত যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো বাণিজ্য ও পর্যটনকে চাঙ্গা করেছে। আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ, মৈত্রী সেতু, উন্নত অভ্যন্তরীণ নৌপথ এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে প্রবেশাধিকার পণ্য আনা-নেওয়াকে আরও দ্রুত ও সস্তা করেছে, যা উত্তর-পূর্ব ভারত, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ ভারতের লজিস্টিক ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য এনেছে, খরচ কমিয়েছে এবং রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। এই প্রকল্পগুলো কেবল বাণিজ্যকেই ত্বরান্বিত করেনি, সেইসাথে এগুলো ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও সুসংহত করেছে এবং কানেক্টিভিটিকে একটি কৌশলগত সম্পদে পরিণত করেছে।
অতীতের হস্তক্ষেপের কথা স্বীকার করা এবং একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা ভারতকে ছোট করবে না, বরং এতে দেশটির নৈতিক অবস্থানই আরো জোরদার হবে, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে গড়ে তুলবে।
কেন এই পদ্ধতিটি এখন বাস্তবসম্মত
এই বছরের স্বতন্ত্র কৌশলগত পর্যালোচনাগুলোয় একটি বিষয় স্পষ্ট যে, গত দশকের সমস্যা সমাধানের প্রবণতা থেকে সরে গিয়ে দুই দেশ এখন পারস্পরিক সন্দেহের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এই নেতিবাচক ধারা পরিবর্তনের জন্য খুব বিশাল কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই, বরং প্রয়োজন ছোট ছোট আস্থা বৃদ্ধিমূলক পদক্ষেপ। এগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার চলাকালীন কারিগরি সহযোগিতাকে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখবে। এটি জনসমক্ষে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।
কারণ নাগরিকরা তখন সহযোগিতার বাস্তব সুফল দেখতে পাবে। এবং নয়াদিল্লিও বাস্তববাদী অংশীদার বা প্রতিবেশী পাবে যাদের মধ্যে ভারতবিরোধি মেরুকরণ থাকবে না ( That, in turn, strengthens Dhaka’s hand with its own public—because citizens can see practical benefits—and gives New Delhi pragmatic partners rather than polarized counterparts. )
জুলাই বিপ্লব যেমন শেষ পর্যন্ত মর্যাদা এবং জবাবদিহিতার একটি দাবি ছিল, তেমনি হাসিনা-পরবর্তী একটি স্থিতিশীল পররাষ্ট্রনীতি উভয় পক্ষেরই পূর্বাভাসযোগ্য আচরণ এবং সংযমের ওপর নির্ভরশীল। উত্তেজনা কমানোর দ্রুততম উপায় হলো নেতিবাচক প্রণোদনা বদলে দেওয়া। অর্থাৎ, লোকদেখানো উসকানিমূলক আচরণ বন্ধ করা, প্রচারহীন স্থায়ী সমাধানকে গুরুত্ব দেওয়া এবং অগ্রগতির বিষয়টি স্বচ্ছভাবে দেখা।
ড. হাবিব সিদ্দিকী
ড. হাবিব সিদ্দিকী মানবাধিকারের উন্নয়ন এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও সাম্যভিত্তিক বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরে একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি মানবিকতা, বিশ্ব রাজনীতি, ও মানবাধিকার বিষয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি করছেন। যার অনেকগুলোই বিভিন্ন সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, জার্নাল এবং ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে।
*লেখাটি ইউরেশিয়া রিভিউয়ে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনুবাদ করে প্রকাশিত*

২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। একইসাথে টালমাটাল করে দিয়েছে দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্ক- ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় বন্ধন। পরবর্তীতে দুই দেশের মধ্যে অবিশ্বাস্যভাবে আস্থার সংকট ঘনীভূত হয়েছে, পাল্টাপাল্টি বাকবিতণ্ডা বেড়েছে এবং উভয় দেশই এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা একটি উদ্বেগজনক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নয়াদিল্লি এই সম্পর্ককে একসময় কোঅপারেটিভ প্রাগমেটিজম বা 'সহযোগিতামূলক বাস্তববাদ' হিসেবে অভিহিত করলেও অধিকাংশ বাংলাদেশির কাছে এটি ছিল সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে এক অসম সমঝোতা। বর্তমানে সেই সুসম্পর্ক অভিযোগ এবং সরাসরি বৈরিতার দিকে মোড় নিয়েছে।
জুলাই বিপ্লবের (যাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতাও বলা হয়) অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ওসমান হাদdর হত্যাকাণ্ড বর্তমানে একটি চরম উত্তপ্ত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ভঙ্গুরতাকে যেমন ফুটিয়ে তুলেছে, তেমনি ভারত-বিরোধী মনোভাবকেও আরও উসকে দিয়েছে।
স্ক্রল ডট ইন-এর এক লেখায় অশোক সোয়াইন বলেছেন যে, এই হত্যাকাণ্ড ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ককে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ভারতে পালিয়ে গেছেন- যখন শেখ হাসিনাকে ১,৪০০-এর বেশি বাংলাদেশির মৃত্যুর দায়ে দণ্ডিত করার দাবি জানানো হচ্ছে, তখন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা ভারতকে আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে।
বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হাদি হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদ এবং তার সহযোগীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, "এই লেনদেনগুলো মানি লন্ডারিং, সংঘবদ্ধ অপরাধ এবং সম্ভাব্য জঙ্গি অর্থায়নের সাথে যুক্ত থাকতে পারে।"
সাম্প্রতিক সংবাদ এবং বিশ্লেষণে বাংলাদেশের রাজপথে ভারত-বিরোধী ক্ষোভ, দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং ক্রমবর্ধমান ভীতির বিষয় উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, উভয় পক্ষ যদি এভাবে 'আগুনে ঘি ঢালা' অব্যাহত রাখে, তবে গত এক দশকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা থমকে যেতে পারে বা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
কীভাবে আমরা এই পর্যায়ে পৌঁছালাম?
'স্ক্রল'-এর বিশ্লেষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। তা হলো ভারতীয় রাজনৈতিক আলোচনা এবং গণমাধ্যমের একাংশ বাংলাদেশের এই পটপরিবর্তনকে মূলত একটি 'নিরাপত্তা ঝুঁকি' হিসেবে বিবেচনা করছে। তারা হাসিনা-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাকে সন্দেহের চোখে দেখছে, ঢাকা-বিরোধী বক্তব্যগুলোকে বড় করে দেখাচ্ছে এবং ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানকে চরমপন্থী হুমকি হিসেবে তুলে ধরছে। নিবন্ধটিতে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান বাংলাদেশের ভেতরে বিদ্যমান অস্থির জনমতে আগুনের ওপর ঘি ঢালার মতো কাজ করছে।
এই নেতিবাচক পরিস্থিতির সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু প্রতীকী সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুতির পর ভারতে শেখ হাসিনার দীর্ঘকালীন অবস্থান। অনেক বাংলাদেশি বিষয়টিকে দেখছেন নতুন ব্যবস্থার বিপরীতে পুরনো ব্যবস্থার ওপর নয়াদিল্লির রাজনৈতিক বাজি হিসেবে। এই দৃশ্যমান পরিস্থিতিগুলো মোটেও তুচ্ছ নয়। বরং এগুলো ভারতবিরোধী জনমত গঠন করছে এবং নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসার ক্ষেত্রে আরও অনমনীয় করে তুলতে পারে।
স্বতন্ত্র বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কের এই নির্লিপ্ততা এখন আর শুধু কূটনৈতিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। এটি সরাসরি ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত হানছে। একসময় ভারতের হাসপাতালগুলোর জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলারের আয়ের উৎস ছিল বাংলাদেশি 'মেডিক্যাল ট্যুরিজম'। বর্তমানে সেই খাতে ধস নামা থেকে স্পষ্ট হয় যে, রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপগুলো কীভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
জুলাই বিপ্লবের দাবি কী ছিল এবং কেন এটি বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ
আমার ব্যক্তিগত এবং যৌথভাবে লিখিত প্রবন্ধগুলোতে এটি জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের তরুণদের এই গণঅভ্যুত্থান ছিল মূলত জবাবদিহিতা, আইনের শাসন এবং মর্যাদার লড়াই। এটি ছিল স্বজনপ্রীতি, রাজনীতিকীকরণ হওয়া প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ।
আমরা আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং অর্থনৈতিক স্বস্তি নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় জবাবদিহিতা অধ্যাদেশ, একটি শক্তিশালী দুর্নীতি দমন ব্যুরো এবং দ্রুত পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছি। একইসাথে এতে সংখ্যালঘু সুরক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃঢ় নিশ্চয়তা রাখা হয়েছে, যাতে কোনো পক্ষই উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই রাজনৈতিক উত্তরণকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে না পারে।
অভ্যন্তরীণ এই অগ্রাধিকারগুলো অনিবার্যভাবেই দেশটির পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করছে। যে সরকার দেশে পদ্ধতিগত সংস্কার করতে চায়, সীমান্তের অপরপাশে তাদের জন্য একটি স্থিতিশীল ও হস্তক্ষেপহীন প্রতিবেশী প্রয়োজন।
অন্যদিকে, কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র যদি পক্ষপাতের সংকেত দেয় - তা রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার রাজনীতি হোক বা নিরাপত্তাকেন্দ্রিক মন্তব্যের মাধ্যমেই হোক না কেন-তা ঢাকার উদারপন্থীদের অবস্থান দুর্বল করে দেয়। এর ফলে কট্টরপন্থীরা শক্তিশালী হয় এবং বাস্তবসম্মত দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার পথ সংকুচিত হয়ে আসে।
উত্তোজনার আবর্ত: ঘটনা ও বাগাড়ম্বর
হাসিনার পতনের পর থেকে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যম। ভুয়া খবর এবং বানোয়াট বয়ানের একটি জোয়ার তৈরি করে বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতার এমন এক ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে, যেন তাদের অস্তিত্বই এখন বিপন্ন। তবে স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকরা এই দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাননি, বরং এগুলোকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিকৃতি হিসেবে উন্মোচিত করেছেন। এই প্রচারণা মূলত গোঁড়ামি এবং অসহিষ্ণুতার সেই বৃহত্তর কাঠামোর সঙ্গেই মিলে যায়, যা বর্তমান বিজেপি শাসনামলে ভারতের রাজনৈতিক আলোচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের নিজস্ব বাংলাভাষী মুসলিমরাও এই চরম প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছেন। ২০২৫ সালের মে থেকে জুনের মধ্যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ভারতীয় নাগরিকসহ ১,৫০০ এরও বেশি বাংলাভাষী মুসলিমকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে 'পুশ-ব্যাক' বা বিতাড়িত করেছে, যা মানবিক উদ্বেগ এবং কূটনৈতিক টানাপড়েনকে আরও উসকে দিয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরে বিশেষ করে অধিকৃত কাশ্মীর এবং উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলিমদের ঘরবাড়ি, মসজিদ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে নয়া দিল্লিতে প্রকাশ্যেই আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে তিনি ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে চরমপন্থীদের ক্ষমতায়ন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অস্থিতিশীল করার অভিযোগ তুলেছেন। এই আচরণ মূলত নির্বাসনে থেকে রাজনৈতিক সমালোচনা উসকে দেওয়ারই নামান্তর। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যেই ভারত এই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে। ভারত-পন্থী এবং আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্কের অর্থায়নে (এর অনেকগুলোই ভারত থেকে পরিচালিত হচ্ছে) বাংলাদেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং ঘেরাও কর্মসূচি প্রায় প্রাত্যহিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে প্রতিটি ইস্যুই দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কোনো এক ভারতীয় রাজনীতিবিদ চট্টগ্রাম দখলের ডাক দিচ্ছেন, পাল্টা জবাবে ঢাকা থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি আসছে, চলছে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক তলব, ওসমান হাদী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ভারত-বিরোধী বিক্ষোভ এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশন। এসব দাবির সত্যতা যাই হোক না কেন, দুই দেশের মধ্যেই একে অপরের প্রতি বৈরী মনোভাব তৈরি হচ্ছে। আর এই বিষয়টিই অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এই চক্র যদি চলতেই থাকে, তবে এর প্রথম শিকার হবে দুই দেশের মধ্যকার কানেক্টিভিটি বা সংযোগ প্রকল্পগুলো, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সংস্কার এবং দীর্ঘদিনের সেই নিরব কারিগরি সহযোগিতা- যা ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক ধাক্কা থেকে এই সম্পর্ককে সুরক্ষা দিয়ে এসেছে। তবে এর চেয়েও গভীর ঝুঁকি হলো একটি কাঠামোগত পরিবর্তন- যেখানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মূল সমস্যা সমাধান তো হবেই না, কেবল পারস্পরিক অভিযোগ ও বৈরীতাই বাড়বে।

এখানে আমি ঢাকা ও নয়াদিল্লির জন্য ১০টা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের পরামর্শ দিচ্ছি-
১। পারস্পরিক নিরাপদ আশ্রয় না দেওয়ার অঙ্গীকার
উভয় পক্ষকে প্রকাশ্যে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, কোনো দেশই রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল পলাতক ব্যক্তিদের আশ্রয় দেবে না কিংবা তাদের ভূখণ্ডকে একে অপরের অস্থিতিশীলতায় ব্যবহৃত হতে দেবে না। প্রতিটি ঘটনার আলাদা সমন্বয় এবং দ্রুত বিভ্রান্তি দূর করার জন্য দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি হটলাইন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এটি ক্ষমতাচ্যুতির পর নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ সংক্রান্ত নেতিবাচক ধারণা এবং এ সংক্রান্ত গুজবগুলো মোকাবিলায় সরাসরি ভূমিকা রাখবে। উচ্চপর্যায়ের মামলাগুলোতে স্বচ্ছ সহযোগিতার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে, যার মধ্যে ফৌজদারি অপরাধের সম্মুখীন ব্যক্তিদের বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা থাকবে। আর এতে থাকবে আইনের শাসনের প্রতি উভয় পক্ষের পারস্পরিক অঙ্গীকার।
২) গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বক্তব্যের পরিমিতিবোধ
উভয় দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উত্তেজনা প্রশমনকারী ভাষা ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে, ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনকে 'চরমপন্থা' হিসেবে আখ্যা দিয়ে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রায়িত করা এবং প্রতিবেশীকে নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রেস কাউন্সিলগুলোর মাধ্যমে সম্পাদকীয় গোলটেবিল বৈঠক এবং যৌথ মিডিয়া অ্যাডভাইজরি বা নির্দেশিকা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা উসকানিমূলক এবং চাঞ্চল্যকর সংবাদ পরিবেশনের প্রবণতা কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে।
৩) সংখ্যালঘু সুরক্ষাকে অভিন্ন ‘রেড লাইন’ হিসেবে পুনঃনিশ্চিত করা
ঢাকা এবং নয়াদিল্লি, উভয় পক্ষ থেকেই পুনরায় এই বার্তা দিতে হবে যে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং মন্দির, গির্জা বা মসজিদে হামলা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। এই লক্ষ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা যেতে পারে। মন্দির ভাঙচুরের গুজবকে কীভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় তা ২০২৪ সালের আগস্টে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কাছে লেখা আমার খোলা চিঠিতে আমি উল্লেখ করেছিলাম। এটি মোকাবিলা করতে প্রয়োজন স্বচ্ছ ও যৌথ ফ্যাক্ট-চেকিং এবং দ্রুত জনসমক্ষে তথ্য প্রকাশ করা।
৪) পরিস্থিতি শান্ত করতে জবাবদিহিতামূলক সংস্কার ত্বরান্বিত করা
জাতীয় জবাবদিহিতা অধ্যাদেশ কার্যকর করা, একটি স্বাধীন সম্পদ পুনরুদ্ধার ব্যুরো গঠন এবং প্রতি মাসের অগ্রগতির পরিসংখ্যান (কত সম্পদ জব্দ হলো, কত তহবিল উদ্ধার হলো এবং কতটি মামলা দায়ের হলো) প্রকাশ করতে হবে। অর্থনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা রাজনীতিকে শান্ত করে জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি বিদেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত ‘অরাজকতার বয়ান’ নস্যাৎ করতে সহায়ক হবে।
৫) নদ-নদী ও জ্বালানি: ১০০ দিনের মধ্যে দৃশ্যমান সাফল্য
অল্প সময়ের মধ্যে অর্জনযোগ্য কিছু লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতে হবে, যেমন আন্তঃদেশীয় নদী বিষয়ক তথ্য বিনিময়, পরীক্ষামূলকভাবে ঋতুভিত্তিক পানি বণ্টন এবং বিদ্যুৎ বাণিজ্য তফসিলে স্বচ্ছতা বাড়ানো। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে এটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে যে, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এখনো তাদের জন্য বাস্তব সুফল বয়ে আনছে। বড় বড় যৌথ বিবৃতির চেয়ে দ্রুত দৃশ্যমান সাফল্য জনমনে আস্থা ফেরাতে বেশি কার্যকর।
৬) রাজনৈতিক শরণার্থী ও হাই-প্রোফাইল মামলার যৌথ প্রোটোকল
শেখ হাসিনার অবস্থানের সংবেদনশীলতার কথা বিবেচনায় রেখে ঢাকা ও নয়াদিল্লির উচিত মামলা পরিচালনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রোটোকল বা বিধিমালা তৈরি করা। এর মধ্যে মানবিক সুরক্ষা, রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবহার রোধ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিষয়ে স্বচ্ছতা ও স্পষ্ট সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত। স্বচ্ছ নিয়মাবলী থাকলে উত্তজনা প্রশমিত হয় এবং গুজব ছড়ানোর সুযোগ কমে যায়।
৭) সীমান্ত জননিরাপত্তা চার্টার
একটি ‘সীমান্ত মানব নিরাপত্তা উদ্যোগ’ (Border Human Security Initiative) চালু করা প্রয়োজন। এর আওতায় সীমান্তে প্রাণঘাতী ঘটনা কমিয়ে আনতে যৌথ প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি লিয়াজোঁ বোর্ড এবং তথ্য বিনিময়ের জন্য শেয়ারড ড্যাশবোর্ড তৈরি করা যেতে পারে। গণমাধ্যমে প্রচারিত অনেক উত্তেজনাকর ঘটনার সূত্রপাত হয় সীমান্ত এলাকা থেকে। তাই কিছু মানব-নিয়ন্ত্রিত প্রোটোকল অনুসরণ করলে সীমান্তকে ভয়ের পরিবর্তে একটি স্বাভাবিক চলাচলের পথে পরিণত করা সম্ভব।
৮) রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তরুণ সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিনিময় কর্মসূচি
স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামস, নদী ও লজিস্টিকস বিষয়ক বিভিন্ন ইভেন্ট এবং যৌথ বৃত্তি বাড়ানো প্রয়োজন। জুলাই বিপ্লব ছিল তরুণদের নেতৃত্বাধীন। তাই এই প্রজন্মকে যদি গঠনমূলক আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগের সুযোগ করে দেওয়া হয়, তবে তারা বৈরী প্রচারণার বিপদ সম্পর্কে সংবেদনশীল হবে এবং দুই দেশের সহনশীল সম্পর্কের পক্ষে একটি জনমত তৈরি হবে।
৯) কূটনীতিকদের মধ্যে ‘নো সারপ্রাইজ’ বা আগাম বার্তার চুক্তি
উভয় দেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনাররা এই মর্মে একমত হতে পারেন যে, যেকোনো সংবেদনশীল পদক্ষেপ (যেমন: সমন পাঠানো, অ্যাডভাইজারি জারি বা বড় কোনো জনবিবৃতি) নেওয়ার আগে তারা ব্যক্তিগতভাবে একে অপরকে আগাম অবহিত করবেন। এই 'নো সারপ্রাইজ' বা আগাম বার্তার অভ্যাস থাকলে তুচ্ছ প্রতীকী ঘটনাগুলো সহজে বড় ধরনের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে রূপ নিতে পারবে না।
১০) ভারতের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ক্ষমা প্রার্থনা
গত কয়েক দশক ভারতের আচরণ একজন প্রতিবেশী বা অংশীদারের মতো ছিল না, বরং তাদের আচরণ ছিল আধিপত্যবাদী শক্তির মতো। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে এবং বাংলাদেশের স্বার্থের বিনিময়ে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। এই ধারার অবসান হওয়া জরুরি। অতীতের ভুলগুলোর অকপট স্বীকারোক্তিই প্রকৃত ‘রিসেট’ বা সম্পর্কের নতুন শুরু হতে পারে । বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা দীর্ঘদিনের এই গভীর অবিশ্বাস দূর করতে এবং সম্পর্ক পুনর্গঠনে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে।
তবে হ্যাঁ, ভারতের জন্য এভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া একদমই সহজ হবে না। কিন্তু ভারতের নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য এটি অপরিহার্য। হাসিনা আমলে 'কানেক্টিভিটি' বা সংযোগের নামে ভারত নজিরবিহীন ও একতরফা সুবিধা ভোগ করেছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে স্থলপথ ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল যাকে 'সেভেন সিস্টার্স' অঞ্চলের সমুদ্র ব্যবহারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ নিশ্চিত করেছে, যা তাদের আঞ্চলিক এবং সামুদ্রিক কৌশলকে শক্তিশালী করেছে।
ভারত এর থেকে ব্যাপক সুফল ভোগ করেছে। মিতালী, বন্ধন এবং মৈত্রী এক্সপ্রেসের মতো নতুন আন্তঃসীমান্ত যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো বাণিজ্য ও পর্যটনকে চাঙ্গা করেছে। আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ, মৈত্রী সেতু, উন্নত অভ্যন্তরীণ নৌপথ এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে প্রবেশাধিকার পণ্য আনা-নেওয়াকে আরও দ্রুত ও সস্তা করেছে, যা উত্তর-পূর্ব ভারত, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ ভারতের লজিস্টিক ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য এনেছে, খরচ কমিয়েছে এবং রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। এই প্রকল্পগুলো কেবল বাণিজ্যকেই ত্বরান্বিত করেনি, সেইসাথে এগুলো ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও সুসংহত করেছে এবং কানেক্টিভিটিকে একটি কৌশলগত সম্পদে পরিণত করেছে।
অতীতের হস্তক্ষেপের কথা স্বীকার করা এবং একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা ভারতকে ছোট করবে না, বরং এতে দেশটির নৈতিক অবস্থানই আরো জোরদার হবে, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে গড়ে তুলবে।
কেন এই পদ্ধতিটি এখন বাস্তবসম্মত
এই বছরের স্বতন্ত্র কৌশলগত পর্যালোচনাগুলোয় একটি বিষয় স্পষ্ট যে, গত দশকের সমস্যা সমাধানের প্রবণতা থেকে সরে গিয়ে দুই দেশ এখন পারস্পরিক সন্দেহের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এই নেতিবাচক ধারা পরিবর্তনের জন্য খুব বিশাল কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই, বরং প্রয়োজন ছোট ছোট আস্থা বৃদ্ধিমূলক পদক্ষেপ। এগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার চলাকালীন কারিগরি সহযোগিতাকে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখবে। এটি জনসমক্ষে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।
কারণ নাগরিকরা তখন সহযোগিতার বাস্তব সুফল দেখতে পাবে। এবং নয়াদিল্লিও বাস্তববাদী অংশীদার বা প্রতিবেশী পাবে যাদের মধ্যে ভারতবিরোধি মেরুকরণ থাকবে না ( That, in turn, strengthens Dhaka’s hand with its own public—because citizens can see practical benefits—and gives New Delhi pragmatic partners rather than polarized counterparts. )
জুলাই বিপ্লব যেমন শেষ পর্যন্ত মর্যাদা এবং জবাবদিহিতার একটি দাবি ছিল, তেমনি হাসিনা-পরবর্তী একটি স্থিতিশীল পররাষ্ট্রনীতি উভয় পক্ষেরই পূর্বাভাসযোগ্য আচরণ এবং সংযমের ওপর নির্ভরশীল। উত্তেজনা কমানোর দ্রুততম উপায় হলো নেতিবাচক প্রণোদনা বদলে দেওয়া। অর্থাৎ, লোকদেখানো উসকানিমূলক আচরণ বন্ধ করা, প্রচারহীন স্থায়ী সমাধানকে গুরুত্ব দেওয়া এবং অগ্রগতির বিষয়টি স্বচ্ছভাবে দেখা।
ড. হাবিব সিদ্দিকী
ড. হাবিব সিদ্দিকী মানবাধিকারের উন্নয়ন এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও সাম্যভিত্তিক বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরে একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৮০ সাল থেকে তিনি মানবিকতা, বিশ্ব রাজনীতি, ও মানবাধিকার বিষয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি করছেন। যার অনেকগুলোই বিভিন্ন সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, জার্নাল এবং ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়েছে।
*লেখাটি ইউরেশিয়া রিভিউয়ে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনুবাদ করে প্রকাশিত*