ব্রহ্মপুত্রে চীনের মেগা-বাঁধ যেভাবে বাংলাদেশ-ভারতকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
ব্রহ্মপুত্রে চীনের মেগা-বাঁধ যেভাবে বাংলাদেশ-ভারতকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে
ইয়ারলুং জাংবো নদে বাঁধ নির্মাণ করছে চীন। ছবি: রয়টার্স

চীন বর্তমানে তার সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বিতর্কিত অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর একটি নির্মাণ করছে। আর সেটি হলো ইয়ারলুং জাংবো নদের ওপর একটি বিশাল জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থা। এই প্রকল্পের প্রভাব ভারত ও বাংলাদেশের ওপর সুদূরপ্রসারী হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মানুষের জীবন ও পরিবেশের ওপর।

ইয়ারলুং জাংবো নদ তিব্বত থেকে প্রবাহিত হয়ে ভারতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত হয়। এই নদী কৃষি, মাছ ধরা ও দৈনন্দিন পানির চাহিদা পূরণ করে লাখ লাখ মানুষের জীবিকার ভিত্তি গড়ে তুলেছে এবং পরে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়।

ভারত ও বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ এই নদের ওপর নির্ভরশীল। ভারত ও বাংলাদেশে মাছ ধরা ও কৃষিকাজে অন্যতম ভরসা হিসেবে মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ব্রহ্মপুত্র নদ।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, উজানে বড় পরিসরের বাঁধ নদীর স্বাভাবিক ছন্দকে এমনভাবে বদলে দিতে পারে, যার প্রভাব এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি।

মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের এই প্রকল্পে ইয়ারলুং জাংবো নদের ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশে পাঁচটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রায় ১৬৮ বিলিয়ন ডলার খরচে নির্মাণ হচ্ছে এই বাঁধ। বেইজিং একে জলবায়ু-বান্ধব ও পরিচ্ছন্ন শক্তির উৎস হিসেবে তুলে ধরলেও, বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা এতে স্থানীয় আদিবাসীদের বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ২০৩০-এর দশকের প্রথম ভাগ থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে এই প্রকল্পে প্রথম দফায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

তিব্বতের ইয়ারলুং জাংবো নদ। ছবি: রয়টার্স
তিব্বতের ইয়ারলুং জাংবো নদ। ছবি: রয়টার্স

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকল্পটি প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত জটিল। এতে বাঁধ, জলাধার এবং সুড়ঙ্গ দিয়ে সংযুক্ত ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক থাকবে। আমেরিকান থিংক ট্যাঙ্ক স্টিমসন সেন্টারের এনার্জি ওয়াটার অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি প্রোগ্রামের পরিচালক ব্রায়ান আইলার একে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত প্রকল্প হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে সতর্ক করে বলেছেন, এটি একই সঙ্গে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব উদ্বেগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, জলবিদ্যুৎ পরিকল্পনাটি ব্যাপক গবেষণার পর তৈরি হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ প্রকৌশল নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষায় পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যবস্থা নিয়েছে, যাতে নিম্নাঞ্চলে কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে।

তবে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি অনেক বেশি। ব্রহ্মপুত্রের উজানে জলপ্রবাহের যেকোনো পরিবর্তন পলি পরিবহন, মাছের চলাচল এবং মৌসুমি বন্যার ধরনকে প্রভাবিত করতে পারে, যা নিম্নাঞ্চলের কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ব্রহ্মপুত্র তার বেশিরভাগ পানি পায় মৌসুমি বৃষ্টি ও ভারতের অভ্যন্তরীণ শাখা নদী থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উজানের পরিবর্তন নদীর স্বাভাবিক স্পন্দনকেও ব্যাহত করতে পারে।

পরিবেশগত উদ্বেগের পাশাপাশি এই বাঁধে রয়েছে বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব। নয়াদিল্লির এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ঋষি গুপ্ত বলেছেন, “হিমালয়ে বিশেষ করে তিব্বতে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে চীনের অবকাঠামো উন্নয়নগুলো কৌশলগতভাবে স্থাপন করা।” তাঁর মতে, এই প্রকল্প চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে তিব্বত ও সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার বৃহত্তর লক্ষ্যের অংশ।

ইয়ারলুং জাংবো অঞ্চল নিজেই পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এটি জাতীয় পর্যায়ের প্রকৃতি সংরক্ষণাগার দিয়ে ঘেরা এবং এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মেঘলা চিতা, কালো ভাল্লুক ও লাল পান্ডাসহ বহু বিপন্ন প্রাণীর আবাসস্থল রয়েছে। বিজ্ঞানী ও অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই এমন ভঙ্গুর ভূখণ্ডে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছেন।

মানবিক খরচও একটি বড় অমীমাংসিত বিষয়। যে কাউন্টিগুলোতে এই জলবিদ্যুৎ ব্যবস্থা নির্মিত হবে, সেখানে মনপা ও লোবা সম্প্রদায়সহ হাজার হাজার মানুষ বসবাস করে। যারা চীনের স্বীকৃত সবচেয়ে ছোট জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। চীনা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, এই প্রকল্পে তিব্বতে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোর স্থানান্তর জড়িত।

ভারতের ধরমশালাভিত্তিক তিব্বত পলিসি ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক টেম্পা গিয়ালতসেন জামলা বলেছেন, “মানুষকে তাদের পৈতৃক ঘরবাড়ি থেকে জোরপূর্বক সরিয়ে নেওয়া হতে পারে। এতে স্থানীয় আয়ের উৎস ধ্বংস হবে, পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বিলুপ্ত হবে।”

অরুণাচল প্রদেশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জুলাই মাসে সতর্ক করে বলেন, এই প্রকল্প অঞ্চলটির অস্তিত্বের জন্য হুমকি এবং এটিকে ভবিষ্যতে ‘জল বোমা’ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) তিনি বলেন, “চীনের ওপর ভরসা করা যায় না। কেউ জানে না তারা কী করবে এবং কখন”। তাঁর আশঙ্কা, পানি ছেড়ে দিলে বা আটকে রাখলে রাজ্যের বিশাল অংশ হয় বন্যায় ভাসবে, নয়তো ভয়াবহভাবে শুকিয়ে যাবে।

ভারত জানিয়েছে, তারা চীনের পরিকল্পনাগুলো “সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ” করছে। নয়াদিল্লির কর্মকর্তারা ভারতের নাগরিকদের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ও সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

মেকং নদীতে চীনের বাঁধ এই সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে। সেখানে চীন বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে ভিয়েতনামের মতো নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলোতে খরা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে বেইজিং এটি অস্বীকার করে।

এই অনিশ্চয়তা ইতোমধ্যে ভারতের সিদ্ধান্তেও প্রভাব ফেলেছে। উজানের উন্নয়ন নিয়ে উদ্বেগের কারণে ভারতের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ কোম্পানি ব্রহ্মপুত্রে তাদের প্রস্তাবিত ১১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের প্রকল্প দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে।

একই নদের দুই দেশের বিশাল প্রকল্প এগোনোর ফলে বিশেষজ্ঞরা একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন। ব্রায়ান আইলারের মতে, সহযোগিতা হলে ঝুঁকি কিছুটা কমানো সম্ভব। তিনি বলেন, “দুই দেশ যদি মেগা বাঁধ ব্যবস্থার সামগ্রিক নকশা নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তাহলে কিছু ঝুঁকি এড়ানো যেতে পারে।” নচেৎ তাঁর সতর্কবার্তা, “ভারত ও চীনের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের এই প্রতিযোগিতা হবে নিম্নাঞ্চলের জন্য এক ভয়ংকর দৌড়।”

সম্পর্কিত