তিন যুগেরও বেশি পরে নতুন সময়ের ভোটাররা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (চাকসু) নাজিম উদ্দিন ও আজিম উদ্দিন আহমেদের উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিয়েছেন ছাত্রশিবিরের দুই নেতাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের মত এখানেও জয়ের ধারা বহাল রেখেছে ইসলামী ছাত্র শিবির। ৪৪ বছর পর চাকসুতে প্রত্যাবর্তন ঘটল সংগঠনটির। আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনামলের বেশির ভাগ সময় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যেই আসতে পারেনি জামায়োতে ইসলামীর এই ছাত্র সংগঠটি।
১৯৯০ সালের সবশেষ নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্যানেল থেকে এজিএস পদে জয়লাভ করা ছাত্রদল এবার এককভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে জেতার লড়াইয়ে নামলেও সফল হতে পারেনি। সেবারের মত এবারও শুধু এজিএস পদই পেয়েছে।
গত বুধবার ভোট শেষের ১২ ঘণ্টা পর ভোর পৌনে ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়।
চট্টগ্রাম নগর থেকে দূরে পাহাড় ঘেরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজার ৫১৬ ভোটারের মধ্যে ৬৫ শতাংশের ভোট দেওয়ার তথ্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ভোটগ্রহণ শেষে শুরু হয় গণনা। শুরুতে কয়েক ঘণ্টা উৎসবমুখর পরিবেশ থাকলেও বেলা গড়াতেই বাড়তে থাকে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ আর বর্জন।
এক ঘষাতেই উঠে গেল অমোচনীয় কালি
চাকসু ভোটে প্রথম অভিযোগ ওঠে অমোচনীয় কালি নিয়ে। আঙুলে যে অমোচনীয় কালি দেওয়া হয়, তা এক ঘষাতেই উঠে যায় বলে অভিযোগ করে ছাত্রদল, শিবির, অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্যসহ বেশ কয়েকটি প্যানেল।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন বলেছিলেন জাতীয় নির্বাচনের জন্য ব্যবহার করা কালি জার্মান থেকে আনা হয় কিন্তু আমরা তা আনতে পারিনি। তবে, আমরা সবচেয়ে ভালো কালি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। বর্তমান আধুনিক যুগে কালি আসলে পরিচয় যাচাইয়ের প্রধান মাধ্যম নয়, আইডি কার্ড, ভোটার লিস্ট থেকেই যাচাই করা হবে।
৪০০ ব্যালটে স্বাক্ষর না থাকার অভিযোগ
চাকসু নির্বাচনের সব থেকে গুরুতর অভিযোগ ওঠে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ কেন্দ্রে নির্বাচন কর্মকর্তার সই ছাড়া অন্তত ৪০০ ব্যালট বাক্সে জমা দেওয়ার। এ অভিযোগ তুলেছেন বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের প্রার্থীরা। নির্বাচন কর্মকর্তা এ অভিযোগ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন।
নির্বাচন বর্জন এক প্যানেলের
জাল ভোট, সইবিহীন ব্যালট পেপার প্রদানসহ ১০টি কারণ দেখিয়ে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় ‘বিশ্ব ইনসানিয়াত বিপ্লব স্টুডেন্ট ফ্রন্ট’ সমর্থিত ‘রেভল্যুশন ফর স্টেট অব হিউম্যানিটি’ প্যানেল। নির্বাচনে শিবিরের প্যানেলকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল প্যানেলটি।
নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এক প্যানেলের
ভোটে কারচুপির অভিযোগ তোলে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্ট সমর্থিত ‘দ্রোহ পর্ষদ’ প্যানেল। কারচুপি হওয়া কেন্দ্রের ফল স্থগিত করে সমাধান করা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দেখে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন প্যানেলটির প্রার্থীরা।
হল সংসদে মিশ্র জয়
চাকসুর হল সংসদে ছাত্রদল আর শিবির সমানভাবে এগিয়ে।এ.এফ. রহমান হল,আলাওল হল, শিল্পি রশিদ চৌধুরী হোস্টেল, সূর্যসেন হলের প্রায় প্রথম তিন পদে ছাত্রদল এগিয়ে। যদিও, ফরহাদ হোসেন হল, আব্দুর রব হলের প্রায় সব পদে শিবির বিজয় লাভ করে।
শিবিরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ
শিবিরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ভোটার স্লিপ কেন্দ্রে ১০০ মিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিতরণ করার অভিযোগ উঠেছিল। সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী তামজিদ উদ্দীন এ অভিযোগ করেছিলেন। কেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে ব্যালট বা ভোটার স্লিপ বিতরণ করা আচরণবিধির ১৫-এর খ এর স্পষ্ট লঙ্ঘন।
চাকসু নির্বাচনে অন্ধ আনুগত্যে ভোট দেওয়ার সমালোচনা
নির্বাচনের পরিবেশসহ সব কিছু নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল শিক্ষার্থীরা। তবে, অনেকে ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টি পদে শিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে প্যানেলের বাইরে যোগ্য ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিকে ভোট দেওয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকে।
এলইডি স্ক্রিন বন্ধ থাকা
নির্বাচনের সময় কিছু কিছু কেন্দ্রে এলইডি স্ক্রিন সাময়িক বন্ধ ছিল। যদিও নির্বাচন কমিশন বলেছে, যান্ত্রিক কিছু ক্রুটির কারণে তা হয়েছিল, ফুটেজ সব সময়ের সংরক্ষণ থাকবে।
বিএনপি-ছাত্রদল ও জামায়াত-ছাত্রশিবির মুখোমুখি
চবির প্রধান ফটকের অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের এক নম্বর গেট এলাকায় রাত থেকে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল বিএনপি-ছাত্রদল এবং জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। চাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
চাকসুকে কেন্দ্রে করে ছাত্রদল নেতা বহিষ্কার
দলীয় সিদান্তে বাইরে গিয়ে প্রার্থীকে সমর্থন করার কারণে চবি ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন-উর-রশিদকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এছাড়াও, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কারণে আবদুল্লাহ আল মামুনকে আজীবনের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ত্রুটি থাকলেও চাকসু নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ছিল বলে মন্তব্য করেছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির।
তিন পদে জয়ী যারা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি ও জিএস হিসেবে হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের ইব্রাহিম রনি ও সাঈদ বিন হাবিব আর এজিএস পদে জয়ী হয়েছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক।
ভিপি পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত ইব্রাহিম রনি ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়েছিলেন, জিএস পদে সাঈদ বিন হাবিব ৮ হাজার ৩১ ভোট পেয়েছিলেন। এ ছাড়া এজিএস পদে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের আইয়ুবুর রহমান তৌফিক ৭ হাজার ১৪ ভোট পান।
ভিপি ইব্রাহিম রনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ সেশনের ইতিহাস বিভাগ শিক্ষার্থী, জিএস সাঈদ বিন হাবিব ২০১৯-২০ সেশনের ইতিহাস বিভাগ শিক্ষার্থী। এজিএস আইয়ুবুর রহমাব তৌফিক ২১-২২ সেশনের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ বিভাগের শিক্ষার্থী।
চাকসুর ভিপি-জিএসসহ ২৬ পদের মধ্যে ২৪টিতেই জয় পেয়েছেন শিবির প্যানেলের প্রার্থীরা। বাকি দুইজন ছাত্রদলের এজিএস আইয়ুবুর রহমান তৌফিক ও ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’র সহ-খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক তামান্না মাহাবুব প্রীতি।
দুই হল সংসদে পুনঃনিরীক্ষণেও আগের ফল
চাকসু নির্বাচনের হল সংসদ পর্যায়ে পুনঃনিরীক্ষণের পরও কোনো পরিবর্তন আসেনি। আগের ফলাফলের মতোই সোহরাওয়ার্দী হলে ভিপি পদে শিবির সমর্থিত প্রার্থী আবরার ফারাবী ১ হাজার ২০৬ ভোট পেয়ে ৩ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল। অন্যদিকে, অতীশ দীপঙ্কর হলে ভিপি পদে ২১৭ ভোট পেয়ে মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন রিপুল চাকমা।
সার্বিক বিষয়ে চাকসু নির্বাচন কমিশনের সচিব অধ্যাপক এ কে এম. আরিফুল হক সিদ্দিকী বলেলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের সবকিছু এলইডি স্ক্রিনে দেখানো হয়েছে। কারচুপি বা জালিয়াতির সুযোগই রাখা হয়নি। তবে, আচরণবিধি লঙ্ঘনের কিছু অভিযোগ এসেছিল।”