গোটা ইউরোপকে জব্দ করল একা রাশিয়া

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
গোটা ইউরোপকে জব্দ করল একা রাশিয়া
পুতিনের সোভিয়েত পুনরুদ্ধার ও ন্যাটো আক্রমণের কোন আগ্রহ নেই বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন। ছবি: রয়টার্স

১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫। ভোর ৪টা। শীতের ব্রাসেলসে তখনো রাত। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সদরদপ্তরের ভেতরে দমবন্ধ বাতাস। সেখানে মুখ অন্ধকার করে বসে ছিলেন ইউরোপের তাবড় তাবড় নেতারা। চারদিকে চাপা উত্তেজনা। টানা ১৯ ঘণ্টা ধরে আলোচনার ফল কিনা এই।

বসেছিলেন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্নের সমাধান করতে, কী করে যেন তা ট্রিলিয়ন পেরিয়ে গেল। গত কয়েক মাস ধরে এই নেতারাই প্রতিশ্রুতিই দিচ্ছিলেন, রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ থেকে ১০৫ বিলিয়ন ডলার ইউক্রেনকে দেওয়া হবে। ব্রাসেলসে ওই কক্ষের বাইরে ইউরোপের তাবত গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা অপেক্ষায় ছিলেন সুসংবাদটা শুনতে। কিন্তু দরজা খুলতেই গল্প বদলে গেল।

ক্লান্ত নেতারা ক্যামেরার ঝলকানির সামনে বেরিয়ে এলেন। আর তখনই জানা গেল— জব্দের সিদ্ধান্ত বাতিল। জব্দ অর্থ থেকে ঋণ দেওয়ার প্রকল্প ভেস্তে গেছে। এর বদলে ইউরোপিয় ইউনিয়ন নিজেরাই ঋণ নেবে। ফলে ইউরোপীয় করদাতাদের ঘাড়ে চাপবে আরও ৯০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ।

কেন? তারা কেন পিছু হটল? কেন ১০৫ বিলিয়ন ডলারের ‘জব্দ অর্থ’ ছেড়ে নিজেদের জনগণের ওপর করের বোঝা চাপাল?

ইউরোপের গণমাধ্যমকে আমরা ধ্রুবসত্য বলে বিশ্বাস করি। বিবিসি, রয়টার্স এমন কতশত গণমাধ্যম সত্যের অপর নাম হয়ে উঠেছে। তারাই বলল— এটা নাকি কারিগরি জটিলতার বিষয়। তারা আরও বলল— এটা ঐক্যের প্রশ্ন।

আসলে তারা মিথ্যা বলেছে। কারণ সত্য আরও অন্ধকার। আর অনেক বেশি ভয়ংকর। সেই সত্য লুকিয়ে আছে মস্কোর একটি আদালতে দায়ের করা মামলায়। যেখানে দাবি করা হয়েছে ১৮ ট্রিলিয়ন রুবল।

সত্য লুকিয়ে আছে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ভেতর। যার নাম হয়তো আপনি কখনো শোনেননি। তার নাম—ইউরোক্লিয়ার।

সত্য লুকিয়ে আছে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গোপন সতর্কবার্তায়। যেখানে বলা হয়েছে—
রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করলে ইউরো মুদ্রাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

এতকিছুর পরেও নিরুত্তাপ ছিল রাশিয়া। আসলে এই অর্থনৈতিক পারমাণবিক অস্ত্রের কথা জানত মস্কো।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জি-৭ দেশগুলো প্রায় ২৬০ বিলিয়ন ডলারের রুশ সম্পদ জব্দ করে রেখেছে। আর ফাঁকটা এখানেই। কারণ এই অর্থ ওয়াশিংটনের কোনো ভল্টে নেই। লন্ডনের কোনো ব্যাংকে নেই। এর বড় অংশ—প্রায় ১৯১ বিলিয়ন ডলার—রয়েছে বেলজিয়ামে।

আরও নির্দিষ্ট করে বললে— ইউরোক্লিয়ারের অ্যাকাউন্টে।

তাহলে ইউরোক্লিয়ার কী?

ইউরোক্লিয়ার হলো বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার ভেতরের পাইপলাইন।

এটি একটি কেন্দ্রীয় সিকিউরিটিজ ডিপোজিটরি। আপনি যখন জার্মান বন্ড বা ফরাসি শেয়ার কেনেন,
তখন প্রকৃত মালিকানা হস্তান্তরের কাজটি করে ইউরোক্লিয়ার। বিশ্বের ৯০টি দেশে তাদের ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ আছে। ইউরোপীয় পুঁজিবাজারের হৃদস্পন্দন এটি।

এই হৃদস্পন্দন থেমে গেলে— ইউরোপীয় অর্থনীতি মারা যাবে।

এখন আসি রুশ সম্পদের কথায়। এই সম্পদগুলো বিশেষ ধরনের। এগুলো এমন বন্ড, যেগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। বন্ডের মেয়াদ শেষ হলে নগদ অর্থ ফেরত দিতে হয়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোক্লিয়ার সেই নগদ অর্থ মস্কোকে দিতে পারছে না। ফলে টাকার পাহাড় জমে গেছে।
পড়ে থাকা অর্থের আবার সুদ বাড়ছে। ফলে প্রতিদিনই জমা অর্থের পরিমান বাড়ছে। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ এই আটক অর্থের সুদ হবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।

এই সময় ইউরোপীয় কমিশনের মাথায় দারুন এক যুক্তি আসে। তারা বলে, মূল অর্থ রাশিয়ার। কিন্তু সুদ তো না। তাই এই সুদ থেকে এই নগদ অর্থ নেওয়া যাক। আর এই অর্থকে জামানত রেখে ইউক্রেনের জন্য ১০৫ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঋণ দেওয়া হবে।

রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন। ছবি: রয়টার্স
রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন। ছবি: রয়টার্স

কিন্তু তারা একটি বিষয় ভুলে গিয়েছিল। অর্থনীতিতে ঝুঁকিমুক্ত সম্পদ বলে কিছু নেই। এই টাকায় হাত দিলেই তারা বৈশ্বিক অর্থনীতির সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়ে যেত। তাই ব্রাসেলস যখন এ নিয়ে আইনের খসড়া তৈরি করছিল, আর তখন মামলার মুসাবিদা করছিল মস্কো।

ক্রেমলিন খুব ভালো করেই জানত— ইউরোপের দুর্বলতা কোথায়। দুর্বলতা রাজনীতিবিদরা নন, ইউরোক্লিয়ার।

১২ ডিসেম্বর ২০২৫। ব্রাসেলস সম্মেলনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মস্কোর একটি সালিশি আদালতে মামলা দায়ের করে। বিবাদী—ইউরোক্লিয়ার। দাবি—১৮ ট্রিলিয়ন রুবল, অর্থাৎ প্রায় ২২৯ বিলিয়ন ডলার।

মামলার যুক্তি খুবই সরল। “তোমরা আমাদের টাকা ফেরত দিচ্ছ না। তাই তোমরা খেলাপি। আমরা পুরো অর্থ এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।”

আপনি বলতেই পারেন— রুশ আদালতের রায় বেলজিয়ামে কার্যকর হবে না। সেটা সত্য।

কিন্তু ইউরোক্লিয়ার শুধু বেলজিয়ামে নয়। এর গ্রাহক সারা বিশ্বে। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—
ইউরোক্লিয়ারের সম্পদ রাশিয়ার ভেতরেও আছে। পশ্চিমা ব্যাংক, বিনিয়োগ তহবিল, পেনশন ফান্ড—সবগুলোরই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রাশিয়ায় আটকে আছে।
ক্রেমলিনের বার্তা ছিল নির্মম আর স্পষ্ট। “তোমরা যদি ব্রাসেলসে আমাদের ১০৫ বিলিয়ন ডলার জব্দ কর, আমরা মস্কোতে ২২৯ বিলিয়ন ডলারের পশ্চিমা সম্পদ জব্দ করে ইউরোক্লিয়ারকে দেউলিয়া করে দেব।”

পুরোই সমান সমান। কিন্তু বেলজিয়ামের জন্য এটি ছিল অস্তিত্বের প্রশ্ন। রুশ আদালতে ইউরোক্লিয়ার দেউলিয়া ঘোষিত হলে পুরো ইউরোজোন জুড়ে এর প্রভাব পড়তো।

আর এখানেই দৃশ্যে আসেন বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী বার্ট ডে ভেভার। মাসের পর মাস তিনি নীরব ছিলেন। কিন্তু ডিসেম্বরের সম্মেলন কাছে আসতেই তিনি বুঝলেন— তাঁর দেশকে গিলোটিনের নিচে মাথা রাখতে বলা হচ্ছে। কারণ সম্পদগুলো বেলজিয়ামে। মামলা হলে—বেলজিয়ামই অভিযুক্ত হবে। জব্দ হলে—ইউরোক্লিয়ারেরই ক্ষতি। অর্থাৎ ঝুঁকি ১০০ ভাগ বেলজিয়ামের। আর কৃতিত্ব—২৬টি ইউরোপীয় দেশের।

রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মুখ খুললেন ভেভর। বললেন— “আমাকে প্যারাশুট দিন। তারপর আমরা একসঙ্গে লাফ দেব।” তিনি চাইলেন, শক্ত দায়মুক্তির ব্যবস্থা। চাইলেন লিখিত নিশ্চয়তা।

যদি ইউরোক্লিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি—সবাই দায় ভাগ করে নেবে। ঘর তখনই নেমে এল নিস্তব্ধতা। কারণ চেক সই করার সময় নেতারা দ্বিধায় পড়লেন।

রুশ টাকা খরচ করতে সবাই রাজি। কিন্তু বেলজিয়ামের ঝুঁকি বহন করতে নয়। ঠিক তখনই হস্তক্ষেপ করল ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা একটি গোপন নোট পাঠাল।

নোটটি ছিল বিস্ফোরক। তারা জানিয়ে দিল— এই পরিকল্পনার জন্য তারা কোনো অর্থ সহায়তা দেবে না। কারণ—রিজার্ভ মুদ্রার ঝুঁকি।

ইউরো হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রিজার্ভ মুদ্রা। সৌদি আরব, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ ইউরো ধরে রাখে। কারণ তারা বিশ্বাস করে—ইউরোপে সম্পত্তির অধিকার পবিত্র।

এই সম্পদ জব্দ হলে এই বার্তা যাবে যে— “রাজনীতি মিললে টাকা নিরাপদ। মিল না হলে নয়।” এর ফল হবে পুঁজির বিদায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ইউরো বিক্রি করবে। সোনা বা ইউয়ান কিনবে।

ঋণের সুদ বাড়বে। মুদ্রাস্ফীতি ফিরবে। ইউরো ধসে পড়বে। ইসিবি বলল— “ইউক্রেনকে সহায়তা রাজনৈতিক লক্ষ্য। আর ইউরো রক্ষা—বাঁচা মরার প্রশ্ন।” তারা বেঁচে থাকাকেই বেছে নিয়েছে।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। ছবি: রয়টার্স
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। ছবি: রয়টার্স

শেষ আঘাতটা এল রোম থেকে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির কাছ থেকে। শুরুতে তিনি ইউক্রেনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু এক হুমকিতে মত বদলালেন তিনি। ইতালির ব্যাংক ইউনিক্রেডিটের রাশিয়ায় বিপুল ঝুঁকি ছিল। রাশিয়া প্রতিশোধ নিলে ইতালীয় ও অস্ট্রিয়ান ব্যাংকই প্রথম ধাক্কা খেত।

মেলোনি বুঝলেন—এই ঋণের মূল্য দেবে ইতালীয় শেয়ারহোল্ডাররা। তিনি বেলজিয়ামের পাশে দাঁড়ালেন। সম্মতি ভেঙে গেল।

পুরো সম্মেলনের ওপর নেমে এলো কালো ছায়া।

আরেকটি প্রসঙ্গ না বললেই নয়। ১৯৮৯ সালে বেলজিয়াম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছিল। রাশিয়া সেই চুক্তির উত্তরাধিকারী। চুক্তি স্পষ্ট। ক্ষতিপূরণ ছাড়া জব্দ নিষিদ্ধ।

আইনজীবীরা বললেন— রাশিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে জিতবে। বেলজিয়ামের জাহাজ, বিমান, দূতাবাসের অর্থ— সবই জব্দ হতে পারে।

অবশেষে ভোর ৪টায় সিদ্ধান্ত হলো– এই ঝুঁকি নেওয়া অসম্ভব। তাই পরিকল্পনায় বদল। ৯০ বিলিয়ন ডলারের যৌথ ঋণ।

রাশিয়ার টাকা নয়। বাজার থেকে ধার করা টাকা। ইউরোপীয় করদাতাদের টাকা। এটাই নিরাপদ।
পরদিন খবরের কাগজ, টিভি সবকিছুতে শিরোনাম এল—
ঐক্য। ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন।

এই শব্দগুলো শুনতে শুনতে ক্রেমলিনে হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছিল। কারণ রাশিয়া ঐক্যবদ্ধ ইউরোপকে ঠেকাতে পেরেছে।

সম্পর্কিত