জুলাই সনদের যেভাবে বাস্তবায়ন চায় ঐকমত্য কমিশন

তাসীন মল্লিক
তাসীন মল্লিক
জুলাই সনদের যেভাবে বাস্তবায়ন চায় ঐকমত্য কমিশন
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা মঙ্গলবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ছবি: ঐকমত্য কমিশন

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন সম্পর্কিত সুপারিশ প্রধান উপদেস্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। পৃথক দুটি খসড়া ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ–২০২৫’ সরকারপ্রধানের কাছে জমাও দিয়েছে কমিশন।

আজ মঙ্গলবার কমিশন প্রস্তাব করেছে, সরকার ‘অবিলম্বে’ একটি আদেশ জারি করে এই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে গণভোট আয়োজন করবে। প্রস্তাবিত ব্যালটে প্রশ্ন হিসেবে থাকবে, “আপনি কি ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ এবং ইহার তফসিল-১ এ থাকা সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?”

আরেকটি খসড়ায় প্রস্তাবিত ব্যালটে প্রশ্ন হিসেবে থাকবে, “আপনি কি ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ এবং ইহার তফসিল-১ এ থাকা সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত খসড়া বিলের প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?”

কমিশন গণভোট সংসদ নির্বাচনের দিন অথবা তার আগে যেকোনো দিনেই করার প্রস্তাব করেছে। কমিশনের মতে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একযোগে জাতীয় সংসদ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, তবে সংস্কার পরিষদের মেয়াদ হবে ২৭০ দিন। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিষদ তার দায়িত্ব শেষ করতে না পারে, তাহলে গণভোটে গৃহীত বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক বছর আলোচনা করে রাষ্ট্র সংস্কারে যেসব উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার সম্বলিত জুলাই জাতীয় সনদ গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়।

সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতা থাকায় আলাদাভাবে আলোচনা করে বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে।

জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছিল। আর বিএনপিসহ কয়েকটি দল এর বিরোধিতা করে আসছিল।

শেষ পর্যন্ত গণভোটের বিষয়ে ‘ঐকমত্য’ হয়েছে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হলেও সেই গণভোট কবে, কীভাবে হবে তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতের ঐক্য ছিল না।

জামায়াতসহ কয়েকটি দল ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে আগামী নভেম্বরেই গণভোট চায়। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতেও তারা আন্দোলন করছে। অন্যদিকে এ দুই বিষয়ে প্রবল আপত্তি আছে বিএনপির।

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ছবি: ঐকমত্য কমিশন
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ছবি: ঐকমত্য কমিশন

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দিকনির্দেশনা

কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে যেসব বিষয় সাংবিধানিক নয়, সেগুলো অধ্যাদেশ বা অফিস আদেশের মাধ্যমে দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তাই সরকার যেন এই বিষয়গুলো তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করে, সে অনুরোধ করা হয়েছে।

সংবিধান-সংক্রান্ত ৪৮টি বিষয় বাস্তবায়নের জন্য কীভাবে আইনি ভিত্তি তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে দুটি বিকল্প দিকনির্দেশনাও সরকারকে দেওয়া হয়েছে। কমিশন সুপারিশ করেছে যে সরকার যেন গণভোটের মাধ্যমে জনগণের কাছে সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অনুমোদন চায়। এ প্রশ্ন গণভোটের ব্যালটে অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বা নির্বাচন দিবসেই গণভোট আয়োজন করা হবে।

সংসদ ও সংস্কার পরিষদের কাঠামো

সুপারিশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের পর যে সংসদ গঠিত হবে তার সদস্যরাই সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তারা সংসদ ও পরিষদের জন্য পৃথকভাবে শপথ নেবেন এবং একইভাবে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করবেন। পরিষদের বৈঠকে স্পিকার সভাপতিত্ব করবেন; স্পিকার অনুপস্থিত থাকলে ডেপুটি স্পিকার বা প্যানেল সদস্যরা দায়িত্ব নেবেন।

এই পরিষদ নিজস্ব কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করবে—যার মধ্যে অধিবেশন আহ্বান, মুলতবি, প্রস্তাব উত্থাপন ও গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। পরিষদের সচিবালয় হিসেবে কাজ করবে জাতীয় সংসদ সচিবালয়।

উচ্চকক্ষ প্রস্তাব

কমিশন তাদের সুপারিশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাবও দিয়েছে। জনগণের অনুমোদন মিললে সংসদ গঠনের ৪৫ দিনের মধ্যেই এই উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। সাধারণভাবে নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য সদস্যদের তালিকা প্রকাশের কথা বলা হলেও, প্রথমবারের ক্ষেত্রে সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে সেই বিধান প্রযোজ্য হবে না।

এ ছাড়া কমিশন বিকল্প আরেকটি পথও প্রস্তাব করেছে। তাতে বলা হয়েছে, সরকার যদি আদেশ জারি করে গণভোট নেয়, তাহলে আদেশের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত ৪৮টি বিষয় বিল আকারে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা যেতে পারে। গণভোটে জনগণের সম্মতি পেলে এই বিল সংস্কার পরিষদের কাজে সহায়ক হবে। পরিষদ তখন জুলাই সনদের মূলনীতি অনুসারে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংযোজন, সংশোধন বা বিয়োজন করতে পারবে। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিষদ তার কাজ শেষ করতে না পারলে, গণভোটে অনুমোদিত বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে।

সম্পর্কিত