ভারতের ধনীদের এত ভয় কীসের

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
ভারতের ধনীদের এত ভয় কীসের
রাজনীতিবিদরাও গরিবদের চুপ করিয়ে রাখতে নানারকম উপহার-সামগ্রী বিতরণ করেন। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

ভারতে বিভিন্ন শ্রেণির ভেতরের বৈষম্য যথেষ্ট চোখে পড়ে। কিন্তু তারপরেও সেখানে সামাজিক স্থিতিশীলতা বেশ লক্ষণীয়। এই দুইয়ের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে বেশ দোটানায় পড়ে যায় বাইরের থেকে ঘুরতে আসা মানুষজন। এমনকি, সে দেশের উচ্চশিক্ষিত এবং ঘরে কাজের লোক, ড্রাইভার রাখার সামর্থ্য আছে এমন মানুষও ভেবে এর কুল কিনারা করতে পারেন না যে, ভারতের বিভিন্ন শহরে এত বৈষম্য কেন? কেন রিও ডি জেনিরো বা জোহানেসবার্গের মতো নয় এই শহরগুলো?

কলামিস্ট মনু জোসেফ তার সদ্য লেখা ‘হোয়াই পুওর ডোন্ট কিল আস’ বইয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বইটি এরইমধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, বিদ্যমান শ্রেণিবৈষম্য সত্ত্বেও এই সামাজিক স্থিতিশীলতার কিছু কারণ জোসেফ তার বইতে দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতের শহরগুলির যে চূড়ান্ত কদর্যতা, সেটাই ধনীদের রক্ষা করছে। শহরগুলোর চাকচিক্য দেখে গরিবদের মধ্যে এই আশ্বাস তৈরি হয় যে তারাও পিছিয়ে নেই। শিক্ষিত হতে পারলে আর ভালো ইংরেজি জানলে তাদের দিন বদলাবে, অবস্থার উন্নতি হবে। এসব বিশ্বাসও তাদের মধ্যে আশা জাগিয়ে রাখে। আবার, বড়লোকদের অর্থ-প্রতিপত্তি দেখে তাদের মধ্যেও এই আশা জাগে যে, হয়ত তারাও একসময় এমন সুখের মুখ দেখবে। রাজনীতিবিদরাও গরিবদের চুপ করিয়ে রাখতে নানারকম উপহার-সামগ্রী বিতরণ করেন।

পুলিশের বর্বরতা, কারাগারের ভয়াবহতা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা গরিবদের ভয়ে রাখে, যার ফলে তারা সংযত থাকে।

ভারতে আয়কর কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সম্ভাব্য বেকারত্ব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের অনাস্থা ও ক্ষোভ বেড়েছে
ভারতে আয়কর কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সম্ভাব্য বেকারত্ব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের অনাস্থা ও ক্ষোভ বেড়েছে

মনু জোসেফের তত্ত্ব অনুযায়ী আপাতত ধরে নেওয়া যাক-ভারতের দরিদ্র শ্রেণি সচরাচর তাদের দেশের ধনীদের বিরুদ্ধে কথা বলে না। কিন্তু তাহলে আবার নকশাল আন্দোলনের কথা স্মরণ করতে হয়-যা পৃথিবীর দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকা মাওবাদী বিদ্রোহ। ষাট-সত্তরের দশকে ভারতের গ্রামাঞ্চলের ধনিক শ্রেণি নকশালদের ভয়ে তটস্থ থাকত। প্রখ্যাত লেখক অরুন্ধতী রায়, তার সাম্প্রতিক স্মৃতিকথায়, জন্মভূমি আসামের কথা লিখেছেন। ১৯৬৯ সালের একদিনের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। যেদিন আসামের নকশালরা এক চা বাগানের মালিককে খুঁটিতে বেঁধে তার মাথা কেটে দিয়েছিল। কালক্রমে নকশাল আন্দোলন বিলুপ্ত হয়েছে, সাথে নকশালরাও। তবে তারা রাষ্ট্রের ভয়ে আন্দোলন থামিয়ে দিয়ে পালিয়েছে এমন না। বরং রাষ্ট্রীয় নৃশংসতার লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কারণেই তারা হারিয়ে গেছে।

জোসেফের তবে এই বইয়ের মূল বিষয় গ্রামাঞ্চল বা সেখানকার ধনীদের বিরুদ্ধে হওয়া সহিংসতা না। বইটিতে যেসমস্ত ধনীদের কথা বলা হয়েছে তাদের চাকর-বাকররা আর আগের মত ‘জি হুজুর, জি হুজুর’ করছে না। আর এতে করে তাদেরকে যে ভয়টি জেঁকে ধরেছে তা-ই মূলত এই বইটির মূলকথা।

জোসেফও পরিচারিকা, ড্রাইভার এবং ওয়েটারদের নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন তার লেখায়। তার এই ভয় ২০০৮ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পাওয়া ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে এক ড্রাইভার তার মালিককে খুন করে।

এখানে আবার একটা শ্রেণিগত ত্রুটি আছে। বৈশ্বিক মাপকাঠিতে ভারতের এসব পেশার মানুষের আয়-রোজগার খুব কম হলেও তারা স্থানীয় মাপকাঠিতে মধ্যবিত্ত।

আর তাদের নিয়োগকর্তারা হলেন সেই শ্রেণি, যারা আয়ের বণ্টন তালিকার একেবারে শীর্ষে অবস্থান করেন। বইটির শুরুতে একটি নোটে জোসেফ প্রশ্ন করেছেন, “পৃথিবীর সবচেয়ে অসম অঞ্চলগুলির মধ্যে একটা হওয়া সত্ত্বেও এখানে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে কেন কোনো সংঘাত নেই?” প্রশ্নটি এক অর্থে বিশাল। তবে আলোচনার পথ বেশ সংকীর্ণ। কেন ‘আমরা’ আমাদের বাড়ির কাজের লোকজনকে নিয়ে আতঙ্কে থাকি না? আর এখানে ‘আমরা’ বলতে তিনি ভারতের অভিজাত শ্রেণিকে বুঝিয়েছেন।

ভারতের ধনকুবেরদের জন্য গরিবদের থেকে সম্ভাব্য সহিংসতা নিয়ে আতঙ্ক অমূলক
ভারতের ধনকুবেরদের জন্য গরিবদের থেকে সম্ভাব্য সহিংসতা নিয়ে আতঙ্ক অমূলক

তবে এই বইতে এই প্রশ্নেরও উত্তর নেই। এই প্রশ্নে জোসেফ বারবার ‘অতি গরিব’ বলেছেন। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে বলেননি এই অতি গরিব আসলে কারা। জোসেফের সবচেয়ে জোরাল যুক্তিটি হল যে ‘গরিবরাই গরিবদের সবচেয়ে বড় শত্রু’, এবং তিনি দলিতদের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের দিকে ইঙ্গিত করেন। এক্ষেত্রে আরেকটা ভালো বিশ্লেষণ পাওয়া যায় আমেরিকান সাংবাদিক ক্যাথরিন বু-এর ২০১২ সালের অনুসন্ধানী বই ‘বিহাইন্ড দ্য বিউটিফুল ফরেভার্স’-এ। তিনিও বিস্মিত হয়েছিলেন, কেন ভারতের শহরগুলিকে ‘বিদ্রোহী ভিডিও গেম মেটাল স্লাগ ৩-এর মতো’ দেখায় না। মুম্বাইয়ের একটি শোচনীয় বস্তির বাসিন্দাদের তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষণ এবং সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা তার বইটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে, কীভাবে গরিবরা সামান্য কিছু খাবার বা জিনিসপত্রের জন্য ঝগড়া করতে গিয়ে একে অপরের ক্ষতি করে, যার ফলে ধনীরা অক্ষত থেকে যায়।

২০১২ সালের ভারতের জন্য যে প্রশ্নটি সঠিক ছিল, তা ২০২৫ সালে এসে সঠিক নাও হতে পারে। ক্যাথরিন বু-এর বইটি প্রকাশের পর থেকে এই সময়ে এসে ভারতের অর্থনীতি আসলেই দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি অনেক বড় হয়েছে। এই দেশের মানুষকে এখন আরও বেশি সুযোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রত্যাশা অনেক বেশি।

আর এই প্রত্যাশার বিষয়টাই বেশ ভীতিকর। কারণ গত কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, ভারতে আয়কর কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর সম্ভাব্য বেকারত্ব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের অনাস্থা ও ক্ষোভ বেড়েছে। তাই ভারতের ধনকুবেরদের জন্য গরিবদের থেকে সম্ভাব্য সহিংসতা নিয়ে আতঙ্ক অমূলক। তারচেয়ে বরং মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রত্যাশা আর বর্তমানে সেই প্রত্যাশা নিয়ে জন্মানো অনিশ্চয়তার ক্ষোভই তাদের বড় আতঙ্কের কারণ হওয়া উচিত।

সম্পর্কিত