চরচা ডেস্ক

জুলাই অভ্যুত্থানে প্রাণঘাতী দমন-পীড়ন করায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়বে– তা নিয়ে আমেরিকান থিংকট্যাঙ্ক আটলান্টিক কাউন্সিল বলছে, গত বছর ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতেই দণ্ড দেওয়া হলো।
আটলান্টিক কাউন্সিল আমেরিকার অন্যতম থিংক ট্যাঙ্ক, যারা মূলত বৈদেশিক ব্যাপারে কথা বলে। এদিকে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন থেকে বেরিয়ে আসার পথে এই রায় কী অর্থ বয়ে আনবে তা নিয়ে তিন বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন। সেই মতামত আটলান্টিক কাউন্সিল তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।
হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে বাংলাদেশে মেরুকরণ বাড়বে
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড দেশের সহিংস রাজনীতিতে গভীর বিভাজনমূলক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
গত বছরের জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন সহিংসভাবে দমনে তার (শেখ হাসিনা) ভূমিকা নিয়ে এ রায়। তবে ট্রাইব্যুনালটির নিরপেক্ষতা নিয়ে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন রয়েছে। কারণ এই ট্রাইব্যুনালই গত সরকারের আমলে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিরুদ্ধে ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ রায় দিয়েছিল। এই কারণে আদালতের যেকোনো সিদ্ধান্তই ‘রাজনৈতিক স্মৃতিচারণ ও অবিশ্বাসের’ চোখে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
এ দণ্ডাদেশের প্রতি জনতার প্রতিক্রিয়ায় তীব্র বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। ১০ বছর আগে, হাজার হাজার বাংলাদেশি মিলেনিয়াল (যারা ১৯৮১-৯৬ এর মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন) শাহবাগে নেমে জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের সমর্থনে নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছিল। এখন, বাংলাদেশের জেন জি-দের বড় অংশ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে উল্লাস করছে। দুটি সময়েই জনগণের দাবি ছিল মূল শক্তি। রাজনৈতিক স্রোত কত দ্রুত বদলে যেতে পারে এটা তারই প্রমাণ।
এখানে লক্ষণীয়, অনেকেই মৃত্যুদণ্ডের সমর্থক বলে উল্লাস করছেন না; তারা উদ্যাপন করছেন কারণ জুলাইয়ের আন্দোলনে তাদের ঘনিষ্ঠ জনদের হারিয়েছেন। এই আন্দোলন শেখ হাসিনার সরকার পতনের পাশাপাশি জাতীয় মনোভাবকেও পাল্টে দিয়েছিল।
ভারতের পক্ষ থেকে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা খুবই কম। নয়াদিল্লি ইতিমধ্যে বিচারের মানদণ্ড নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। দেশটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলবে যে, এটি ন্যায়বিচার নয়। এতে বর্তমান সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
দেশের ভেতরে নির্বাচন প্রক্রিয়া একেবারেই সহজ নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে বাদ পড়েছে। দলটির নেতারা ক্রমাগত প্রতিরোধের হুমকি দিচ্ছেন। ফলে একতরফা রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এর ফলে বাংলাদেশ এখন দুই বিপরীত শিবিরে বিভক্ত- এক. যারা মনে করেন, বছরের পর বছর স্বৈরাচারী মনোভাবের পর এটিই জবাবদিহিতা নিশ্চিতের একমাত্র পথ। দুই. যারা বলেন, মৃত্যুদণ্ড ন্যায়বিচারকে দুর্বল করে এবং জাতীয় ঐকমত্য পুনর্মিলনই জরুরি।
সময় বলবে, কোন দৃষ্টিভঙ্গি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তবে দেশটির ইতিহাস বলছে, ঘটনায় নাটকীয় মোড় থাকা নিশ্চিত।
(লিখেছেন রুদাবেহ শাহিদ– ননরেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো, অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল সাউথ এশিয়া সেন্টার। ভিজিটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটি।
কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি নয়াদিল্লি
এই রায় ভারতকে কঠিন সংকটে ফেলেছে। এখন শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের ওপর নজিরবিহীন চাপ তৈরি হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা ভারতের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি ও তার পরিবারের সঙ্গে ভারতের সরকারি ও বিরোধীদলের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং নয়াদিল্লি এমন কিছু করবে না যাতে বিশ্বাসভঙ্গ হয়।
কিন্তু ভারত প্রত্যর্পণে রাজি না হলে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের পরিবর্তনগুলো নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ করে ভারতবিরোধী রাজনৈতিক-ধর্মীয় শক্তির উত্থান। কিন্তু বাণিজ্য, যোগাযোগ, সীমান্ত নিরাপত্তা এসব ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। এগুলো একটি বন্ধুত্বপূর্ণ কিংবা কার্যকর সম্পর্ক ছাড়া সম্ভব নয়।

নয়াদিল্লির জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মধ্যপন্থা হলো, হাসিনাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। সম্ভব হলে এমন কোনো স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে যেখানে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং যারা তাকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই গুঞ্জন রয়েছে, বেলারুস বা কোনো উপসাগরীয় দেশে তাকে নেওয়া হতে পারে। তবে প্রশ্ন হলো, এত ‘দামি’ ব্যক্তিকে কেউ কি নিতে রাজি হবে?
হাসিনা হয়তো এখনো নয়াদিল্লির বিশেষ অতিথি, কিন্তু তার আতিথ্যের মেয়াদ হয়তো ফুরিয়ে আসছে। বিশেষ করে তখন, যখন বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ভারত ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সুযোগ খুঁজছে।
(লিখেছেন মাইকেল কুগেলম্যান–ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক)
রায়টি বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়া ও পরের ঘটনাগুলো প্রশ্ন তুলেছে
হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে রায় এসেছে, তা নিহতদের পরিবারের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। তাদের শোকের স্বীকৃতি এবং ন্যায়বিচারের একটি প্রতীক এটি।
তবে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি নিয়োগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সমালোচনা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের পরিধি বাড়িয়ে শেখ হাসিনাকে বিচারের আওতায় এনেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিচার প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করেছে। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অনুপস্থিতিতে বিচার, এবং ন্যায্যতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে রায়ের প্রতি জনআস্থার ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি মৃত্যুদণ্ড পেলেন। তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তিনি ভারতে নির্বাসিত এবং দেশে ফেরার পথ দিন দিন সংকীর্ণ হচ্ছে। তবুও তিনি তার দল আওয়ামী লীগকে ধরে রেখেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ভারত থেকেই দলকে নেতৃত্ব দেবেন তিনি।
ভারত এখন পর্যন্ত অত্যন্ত সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। মৃত্যুদণ্ড ও অনুপস্থিতিতে বিচার বিবেচনায় নিলে ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে, এমন সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশের ভেতরে প্রতিক্রিয়া খুব বিচিত্র। কিছু মানুষ মনে করছে, এই সিদ্ধান্ত অনেক দেরিতে এসেছে। অন্যদিকে অনেকে আশঙ্কা করছেন, এতে উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে।
আওয়ামী লীগ এখনো বিরাট সংখ্যক সমর্থক ধরে রেখেছে। রায়ের আগের কয়েক দিনে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাও দেখা গেছে। যা উত্তেজনা কমার বদলে আরও তীব্র হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে। আগামী সংসদ নির্বাচনের বাকি তিন মাস। আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে বাদ পড়েছে। ফলে অস্থিরতার ঝুঁকি উপেক্ষা করা যায় না।
(লিখেছেন ওয়াহিদুজ্জামান নূর–বাংলাদেশি জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কূটনীতিক।)
বাংলাদেশের প্রয়োজন স্থিতি, ঐক্য ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব
শেখ হাসিনাকে ঘিরে সাম্প্রতিক রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। আমার আশা, বাংলাদেশ ব্যাপারটিকে সংযম, আইনের শাসনের প্রতি সম্মান এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে পরিচালনা করবে।
বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং দেশের সব নাগরিকের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক, বিচার ন্যায্য হতে হবে। সমাজে শান্তি থাকতে হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ স্থিতিশীলতা, ঐক্য এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্ব দরকার।
(লিখেছেন এম. উসমান সিদ্দিক–ননরেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো, অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল সাউথ এশিয়া সেন্টার এবং সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত (ফিজি, টোঙ্গা, নাউরু ও টুভালু)।)

জুলাই অভ্যুত্থানে প্রাণঘাতী দমন-পীড়ন করায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়বে– তা নিয়ে আমেরিকান থিংকট্যাঙ্ক আটলান্টিক কাউন্সিল বলছে, গত বছর ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতেই দণ্ড দেওয়া হলো।
আটলান্টিক কাউন্সিল আমেরিকার অন্যতম থিংক ট্যাঙ্ক, যারা মূলত বৈদেশিক ব্যাপারে কথা বলে। এদিকে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন থেকে বেরিয়ে আসার পথে এই রায় কী অর্থ বয়ে আনবে তা নিয়ে তিন বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন। সেই মতামত আটলান্টিক কাউন্সিল তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।
হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে বাংলাদেশে মেরুকরণ বাড়বে
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড দেশের সহিংস রাজনীতিতে গভীর বিভাজনমূলক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
গত বছরের জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন সহিংসভাবে দমনে তার (শেখ হাসিনা) ভূমিকা নিয়ে এ রায়। তবে ট্রাইব্যুনালটির নিরপেক্ষতা নিয়ে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন রয়েছে। কারণ এই ট্রাইব্যুনালই গত সরকারের আমলে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিরুদ্ধে ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ রায় দিয়েছিল। এই কারণে আদালতের যেকোনো সিদ্ধান্তই ‘রাজনৈতিক স্মৃতিচারণ ও অবিশ্বাসের’ চোখে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
এ দণ্ডাদেশের প্রতি জনতার প্রতিক্রিয়ায় তীব্র বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। ১০ বছর আগে, হাজার হাজার বাংলাদেশি মিলেনিয়াল (যারা ১৯৮১-৯৬ এর মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন) শাহবাগে নেমে জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের সমর্থনে নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছিল। এখন, বাংলাদেশের জেন জি-দের বড় অংশ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডে উল্লাস করছে। দুটি সময়েই জনগণের দাবি ছিল মূল শক্তি। রাজনৈতিক স্রোত কত দ্রুত বদলে যেতে পারে এটা তারই প্রমাণ।
এখানে লক্ষণীয়, অনেকেই মৃত্যুদণ্ডের সমর্থক বলে উল্লাস করছেন না; তারা উদ্যাপন করছেন কারণ জুলাইয়ের আন্দোলনে তাদের ঘনিষ্ঠ জনদের হারিয়েছেন। এই আন্দোলন শেখ হাসিনার সরকার পতনের পাশাপাশি জাতীয় মনোভাবকেও পাল্টে দিয়েছিল।
ভারতের পক্ষ থেকে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা খুবই কম। নয়াদিল্লি ইতিমধ্যে বিচারের মানদণ্ড নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। দেশটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলবে যে, এটি ন্যায়বিচার নয়। এতে বর্তমান সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
দেশের ভেতরে নির্বাচন প্রক্রিয়া একেবারেই সহজ নয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে বাদ পড়েছে। দলটির নেতারা ক্রমাগত প্রতিরোধের হুমকি দিচ্ছেন। ফলে একতরফা রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এর ফলে বাংলাদেশ এখন দুই বিপরীত শিবিরে বিভক্ত- এক. যারা মনে করেন, বছরের পর বছর স্বৈরাচারী মনোভাবের পর এটিই জবাবদিহিতা নিশ্চিতের একমাত্র পথ। দুই. যারা বলেন, মৃত্যুদণ্ড ন্যায়বিচারকে দুর্বল করে এবং জাতীয় ঐকমত্য পুনর্মিলনই জরুরি।
সময় বলবে, কোন দৃষ্টিভঙ্গি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তবে দেশটির ইতিহাস বলছে, ঘটনায় নাটকীয় মোড় থাকা নিশ্চিত।
(লিখেছেন রুদাবেহ শাহিদ– ননরেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো, অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল সাউথ এশিয়া সেন্টার। ভিজিটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটি।
কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি নয়াদিল্লি
এই রায় ভারতকে কঠিন সংকটে ফেলেছে। এখন শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের ওপর নজিরবিহীন চাপ তৈরি হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা ভারতের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি ও তার পরিবারের সঙ্গে ভারতের সরকারি ও বিরোধীদলের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং নয়াদিল্লি এমন কিছু করবে না যাতে বিশ্বাসভঙ্গ হয়।
কিন্তু ভারত প্রত্যর্পণে রাজি না হলে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের পরিবর্তনগুলো নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষ করে ভারতবিরোধী রাজনৈতিক-ধর্মীয় শক্তির উত্থান। কিন্তু বাণিজ্য, যোগাযোগ, সীমান্ত নিরাপত্তা এসব ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। এগুলো একটি বন্ধুত্বপূর্ণ কিংবা কার্যকর সম্পর্ক ছাড়া সম্ভব নয়।

নয়াদিল্লির জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মধ্যপন্থা হলো, হাসিনাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। সম্ভব হলে এমন কোনো স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে যেখানে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং যারা তাকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই গুঞ্জন রয়েছে, বেলারুস বা কোনো উপসাগরীয় দেশে তাকে নেওয়া হতে পারে। তবে প্রশ্ন হলো, এত ‘দামি’ ব্যক্তিকে কেউ কি নিতে রাজি হবে?
হাসিনা হয়তো এখনো নয়াদিল্লির বিশেষ অতিথি, কিন্তু তার আতিথ্যের মেয়াদ হয়তো ফুরিয়ে আসছে। বিশেষ করে তখন, যখন বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ভারত ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সুযোগ খুঁজছে।
(লিখেছেন মাইকেল কুগেলম্যান–ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশ্লেষক)
রায়টি বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে, কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়া ও পরের ঘটনাগুলো প্রশ্ন তুলেছে
হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে রায় এসেছে, তা নিহতদের পরিবারের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। তাদের শোকের স্বীকৃতি এবং ন্যায়বিচারের একটি প্রতীক এটি।
তবে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি নিয়োগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সমালোচনা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের পরিধি বাড়িয়ে শেখ হাসিনাকে বিচারের আওতায় এনেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিচার প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করেছে। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অনুপস্থিতিতে বিচার, এবং ন্যায্যতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে রায়ের প্রতি জনআস্থার ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি মৃত্যুদণ্ড পেলেন। তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তিনি ভারতে নির্বাসিত এবং দেশে ফেরার পথ দিন দিন সংকীর্ণ হচ্ছে। তবুও তিনি তার দল আওয়ামী লীগকে ধরে রেখেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ভারত থেকেই দলকে নেতৃত্ব দেবেন তিনি।
ভারত এখন পর্যন্ত অত্যন্ত সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। মৃত্যুদণ্ড ও অনুপস্থিতিতে বিচার বিবেচনায় নিলে ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে, এমন সম্ভাবনা নেই।
বাংলাদেশের ভেতরে প্রতিক্রিয়া খুব বিচিত্র। কিছু মানুষ মনে করছে, এই সিদ্ধান্ত অনেক দেরিতে এসেছে। অন্যদিকে অনেকে আশঙ্কা করছেন, এতে উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে।
আওয়ামী লীগ এখনো বিরাট সংখ্যক সমর্থক ধরে রেখেছে। রায়ের আগের কয়েক দিনে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাও দেখা গেছে। যা উত্তেজনা কমার বদলে আরও তীব্র হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে। আগামী সংসদ নির্বাচনের বাকি তিন মাস। আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে বাদ পড়েছে। ফলে অস্থিরতার ঝুঁকি উপেক্ষা করা যায় না।
(লিখেছেন ওয়াহিদুজ্জামান নূর–বাংলাদেশি জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কূটনীতিক।)
বাংলাদেশের প্রয়োজন স্থিতি, ঐক্য ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব
শেখ হাসিনাকে ঘিরে সাম্প্রতিক রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। আমার আশা, বাংলাদেশ ব্যাপারটিকে সংযম, আইনের শাসনের প্রতি সম্মান এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে পরিচালনা করবে।
বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং দেশের সব নাগরিকের শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক, বিচার ন্যায্য হতে হবে। সমাজে শান্তি থাকতে হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ স্থিতিশীলতা, ঐক্য এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্ব দরকার।
(লিখেছেন এম. উসমান সিদ্দিক–ননরেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো, অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল সাউথ এশিয়া সেন্টার এবং সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত (ফিজি, টোঙ্গা, নাউরু ও টুভালু)।)