অধ্যাপক কিশোর মাহবুবানি

ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সভ্যতার মতোই প্রাচীন। ইতিহাস জুড়ে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো প্রভাব, সম্পদ ও নিরাপত্তার জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছে। আজকের যুগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো আমেরিকা ও চীনের মধ্যে। অনেক বিশ্লেষক এই প্রতিযোগিতাকে শীতল যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি বলে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু এই তুলনা ভয়ানকভাবে বিভ্রান্তিকর। মার্কিন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বের বিপরীতে আমেরিকা-চীন সম্পর্ক অনেক বেশি জটিল, পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল এবং চাইলে সংঘাত এড়ানো সম্ভব।
শীতল যুদ্ধের তুলনার সীমাবদ্ধতা
শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন। খুব কম দেশই মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে নির্ভরশীল ছিল। আর তার আদর্শ ছিল সুস্পষ্ট, বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম ছড়িয়ে দেওয়া। চীন ভিন্ন। বেইজিং কোনো মতাদর্শ রপ্তানি করতে চায় না। বা তার ব্যবস্থাকে আমেরিকার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করে না। বরং তাদের বার্তা স্পষ্ট- আমেরিকার ব্যবস্থা আমেরিকার জন্য ভালো, চীনের ব্যবস্থা চীনের জন্য ভালো–প্রত্যেক দেশ তার নিজের পথ বেছে নেবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। নিকিতা ক্রুশ্চেভ একসময় গর্ব করে বলেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাকে ‘কবর’ দেবে। চীনের এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। বরং তারা চায় একটি শক্তিশালী আমেরিকা, যার সঙ্গে ব্যবসা করা সম্ভব হবে।
প্রতিরোধ নীতির অচলাবস্থা
চীনের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তি শীতল যুদ্ধের কৌশলগুলোকে অচল করে তুলেছে। আজ এক শরও বেশি দেশ, সম্ভবত ১৮০টিরও বেশি–চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করে, যা আমেরিকার চেয়ে বেশি। এত গভীরভাবে সংযুক্ত একটি অর্থনীতিকে আটকে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বরং আমেরিকাই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেকটি মারাত্মক ভুল ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে প্রধানত সামরিক প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখা। তারা প্রচুর সম্পদ ব্যয় করে মার্কিন সামরিক শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিল। কিন্তু অর্থনীতিকে অবহেলা করেছিল। চীন এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে। তারা বোঝে যে দীর্ঘমেয়াদি শক্তির মূল উৎস অর্থনৈতিক গতিশীলতা। আর তাই যখন আমেরিকা বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে বিমানবাহী রণতরী ও সামরিক বাজেটে, চীন বিনিয়োগ করছে অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যে।
আমেরিকার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা
আমেরিকার আসল চ্যালেঞ্জ বিদেশে নয়, ঘরেই। সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান হলো, গত ৩০ বছরে মার্কিন সমাজের নিচতলার ৫০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। কোনো উন্নত দেশে এমন হয়নি। একসময় আমেরিকান মধ্যবিত্তের আয় ক্রমাগত বেড়েছে। জীবনমান উন্নত হয়েছে। আর সেই আশাবাদ শীতল যুদ্ধের সময় তাদের শক্তির ভিত্তি ছিল।
আজ কিন্তু সাগর সমান হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন সমাজে, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে। অর্থনীতিবিদ অ্যান কেস ও অ্যাঙ্গাস ডিটন দেখিয়েছেন, এই হতাশা প্রতিফলিত হচ্ছে আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি ও অ্যালকোহল আসক্তিতে। এর রাজনৈতিক প্রতিফলন হলো ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা। কিন্তু ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান–কেউই প্রকৃত সমাধান দেয়নি। এ সমস্যা সমাধান না করলে আমেরিকার প্রতিযোগিতার শক্তি আরও ক্ষয় হবে।

বাণিজ্য যুদ্ধের ভুল
আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ হলো ওয়াশিংটনের কৌশলগত ভুলের উদাহরণ। ট্রাম্প যখন শুল্ক আরোপ করলেন, ডেমোক্র্যাটরা উল্লাস করল এই ভেবে যে, চীন দ্রুত আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু ইতিহাসের কারণে তা কখনো সম্ভব নয়। আফিম যুদ্ধ থেকে শুরু করে এক শতাব্দীর ধরে অপমানের সময় পশ্চিমা শক্তি চীনকে বারবার শোষণ করেছে। আজকের চীনা নেতৃত্ব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে তারা আর কখনো মিথ্যা চাপ মেনে নেবে না।
ফলত, ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধির জবাবে চীন দৃঢ় অবস্থান নিল। তারা আত্মসমর্পণ করেনি। বরং আরও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার দিকে ঝুঁকল। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, কোভিড-১৯ এর পর প্রকৃতপক্ষে আমেরিকাকেই বেশি দুর্বল দেখাচ্ছিল। আমেরিকা যদি বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে চাইত, তবে শুল্ক তুলে নেওয়াটাই ছিল/হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
চীনের শাসনব্যবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তি
পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি ভুল হলো চীনের ব্যবস্থা সোভিয়েত আমলের কঠোর স্বৈরতান্ত্রিক বলে মনে করা। বাস্তবে চীনের শাসনব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম মেধাভিত্তিক, হয়তো কেবল সিঙ্গাপুরই তার সমান। নেতৃত্ব বাছাই হয় কঠোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং প্রশাসনে দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হয়।
আমেরিকায় এর উল্টো ঘটনা ঘটছে। ৩০ বছর আগে আমেরিকান কূটনীতিকরা ছিলেন সবচেয়ে দক্ষ ও প্রভাবশালী। তখনকার চীনা কূটনীতিকরা প্রায় কেবল মাও-এর রেড বুক থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। কিন্তু আজকের চীনা কূটনীতিকেরা বহুভাষী, প্রযুক্তি-সচেতন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয়। বিপরীতে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুর্বল ও মনোবলহীন হয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতা ও আশাবাদ
সমালোচকরা ঠিকই বলেন, চীনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার দিকে তাকালে বোঝা যাবে না গত ৪০ বছরে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিস্ফোরণ কতটা হয়েছে। ১৯৮০ সালে চীনারা কোথায় থাকবে, কী পড়বে, কী পরবে–এমনকি বিদেশ ভ্রমণও করতে পারত না।
আজ কোটি কোটি মানুষ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করছে। প্রতি বছর তিন লাখেরও বেশি চীনা শিক্ষার্থী আমেরিকায় পড়তে আসে। আর ১৩ কোটির বেশি মানুষ বিদেশ ভ্রমণে যায়। যদি চীন সত্যিই এক অন্ধকার, দমনমূলক রাষ্ট্র হতো, তবে এত মানুষ বিদেশে গিয়ে আবার দেশে ফিরত না। বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত হলেও চীনারা ভবিষ্যৎ নিয়ে আমেরিকানদের তুলনায় অনেক বেশি আশাবাদী।
গণতন্ত্র: চীনের নিজস্ব পথে
চীন কি একদিন গণতান্ত্রিক হবে? হয়তো, তবে ধীরে ধীরে এবং নিজেদের শর্তে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তাদের শিক্ষা দিয়েছে–গর্বাচেভের হঠাৎ সংস্কার অর্থনৈতিক পতন, জীবনযাত্রার মান হ্রাস এবং জনদুর্ভোগ ডেকে এনেছিল। চীনের নেতারা এ ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না।
অন্যদিকে, আমেরিকা বারবার গণতন্ত্র ‘রপ্তানি’ করার নামে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, যা বিপর্যয় ডেকে এনেছে। জর্জ কেনান বহু আগে সতর্ক করেছিলেন, অন্য সমাজকে আমেরিকা কীভাবে চলবে তা বলে দেওয়া ঔদ্ধত্যের শামিল। চার হাজার সভ্যতার অধিকারী চীন নিজের পথ নিজেই বেছে নেবে।
ঔদ্ধত্যের বিপদ
দুঃখজনকভাবে, আমেরিকার চীনবিরোধী মনোভাব ক্রমেই উন্মাদনায় রূপ নিচ্ছে। এর একটি অংশ ‘ইয়েলো পেরিল’ বা ‘হলুদ বিপদ’ নামের পুরোনো বর্ণবাদী ভয়ের সঙ্গে যুক্ত। তাই প্রায়ই চীন নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য শোনা যায়। কিন্তু এটি কার্যকর নয়। আসলে, বিশ্বের অন্য কোনো দেশ আমেরিকার মতো এত শত্রুতাপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে না। ফলে আমেরিকা নিজেকেই বিচ্ছিন্ন করছে।
এগিয়ে যাওয়ার স্মার্ট পথ
আমেরিকা-চীন প্রতিযোগিতা যুদ্ধের দিকে গড়াতে হবে না। তবে এটি হবে কঠিন, বহু-মাত্রিক সংগ্রাম। এর মঞ্চ হবে অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও প্রভাব বিস্তার–কেবল সামরিক শক্তি নয়। জিততে হলে আমেরিকাকে নিজস্ব দুর্বলতাগুলো দূর করতে হবে। নতুন কৌশল ভাবতে হবে। শীতল যুদ্ধের তুলনা টানা অলস ভাবনা থেকে বাইরে আসতে হবে।
চীন সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। এটি অনেক বেশি সংযুক্ত, অনেক বেশি সহনশীল এবং অনেক বেশি বাস্তববাদী। আমেরিকা যদি এগিয়ে থাকতে চায়, তবে তাকে নিজের সমাজ ও অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে হবে। মধ্যবিত্তের আশা ফিরিয়ে আনতে হবে। হতাশার স্রোত থামাতে হবে।
সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল হবে চীনের পথকে সম্মান করা, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা এবং নিজের সমস্যাগুলো সমাধান করা। ২১ শতকের প্রতিযোগিতা যুদ্ধক্ষেত্রে নয় বরং অর্থনৈতিক শক্তি, সামাজিক স্থিতি এবং বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতার লড়াইয়ে নির্ধারিত হবে।
প্রশ্নটা আসলে চীন জিতেছে কি না তা নয়। আসল প্রশ্ন হলো, আমেরিকা কি আবার সেই শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে পারবে, যা একসময় তাকে বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল সমাজে পরিণত করেছিল?
(লেখাটি অধ্যাপক কিশোর মাহবুবানির ভিডিও বক্তব্য অবলম্বনে তৈরি।)

ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সভ্যতার মতোই প্রাচীন। ইতিহাস জুড়ে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো প্রভাব, সম্পদ ও নিরাপত্তার জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছে। আজকের যুগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো আমেরিকা ও চীনের মধ্যে। অনেক বিশ্লেষক এই প্রতিযোগিতাকে শীতল যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি বলে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু এই তুলনা ভয়ানকভাবে বিভ্রান্তিকর। মার্কিন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বের বিপরীতে আমেরিকা-চীন সম্পর্ক অনেক বেশি জটিল, পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল এবং চাইলে সংঘাত এড়ানো সম্ভব।
শীতল যুদ্ধের তুলনার সীমাবদ্ধতা
শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন। খুব কম দেশই মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে নির্ভরশীল ছিল। আর তার আদর্শ ছিল সুস্পষ্ট, বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম ছড়িয়ে দেওয়া। চীন ভিন্ন। বেইজিং কোনো মতাদর্শ রপ্তানি করতে চায় না। বা তার ব্যবস্থাকে আমেরিকার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করে না। বরং তাদের বার্তা স্পষ্ট- আমেরিকার ব্যবস্থা আমেরিকার জন্য ভালো, চীনের ব্যবস্থা চীনের জন্য ভালো–প্রত্যেক দেশ তার নিজের পথ বেছে নেবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। নিকিতা ক্রুশ্চেভ একসময় গর্ব করে বলেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাকে ‘কবর’ দেবে। চীনের এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। বরং তারা চায় একটি শক্তিশালী আমেরিকা, যার সঙ্গে ব্যবসা করা সম্ভব হবে।
প্রতিরোধ নীতির অচলাবস্থা
চীনের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তি শীতল যুদ্ধের কৌশলগুলোকে অচল করে তুলেছে। আজ এক শরও বেশি দেশ, সম্ভবত ১৮০টিরও বেশি–চীনের সঙ্গে বাণিজ্য করে, যা আমেরিকার চেয়ে বেশি। এত গভীরভাবে সংযুক্ত একটি অর্থনীতিকে আটকে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। বরং আমেরিকাই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেকটি মারাত্মক ভুল ছিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে প্রধানত সামরিক প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখা। তারা প্রচুর সম্পদ ব্যয় করে মার্কিন সামরিক শক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিল। কিন্তু অর্থনীতিকে অবহেলা করেছিল। চীন এই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে। তারা বোঝে যে দীর্ঘমেয়াদি শক্তির মূল উৎস অর্থনৈতিক গতিশীলতা। আর তাই যখন আমেরিকা বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে বিমানবাহী রণতরী ও সামরিক বাজেটে, চীন বিনিয়োগ করছে অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যে।
আমেরিকার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা
আমেরিকার আসল চ্যালেঞ্জ বিদেশে নয়, ঘরেই। সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান হলো, গত ৩০ বছরে মার্কিন সমাজের নিচতলার ৫০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। কোনো উন্নত দেশে এমন হয়নি। একসময় আমেরিকান মধ্যবিত্তের আয় ক্রমাগত বেড়েছে। জীবনমান উন্নত হয়েছে। আর সেই আশাবাদ শীতল যুদ্ধের সময় তাদের শক্তির ভিত্তি ছিল।
আজ কিন্তু সাগর সমান হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন সমাজে, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে। অর্থনীতিবিদ অ্যান কেস ও অ্যাঙ্গাস ডিটন দেখিয়েছেন, এই হতাশা প্রতিফলিত হচ্ছে আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি ও অ্যালকোহল আসক্তিতে। এর রাজনৈতিক প্রতিফলন হলো ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা। কিন্তু ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান–কেউই প্রকৃত সমাধান দেয়নি। এ সমস্যা সমাধান না করলে আমেরিকার প্রতিযোগিতার শক্তি আরও ক্ষয় হবে।

বাণিজ্য যুদ্ধের ভুল
আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ হলো ওয়াশিংটনের কৌশলগত ভুলের উদাহরণ। ট্রাম্প যখন শুল্ক আরোপ করলেন, ডেমোক্র্যাটরা উল্লাস করল এই ভেবে যে, চীন দ্রুত আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু ইতিহাসের কারণে তা কখনো সম্ভব নয়। আফিম যুদ্ধ থেকে শুরু করে এক শতাব্দীর ধরে অপমানের সময় পশ্চিমা শক্তি চীনকে বারবার শোষণ করেছে। আজকের চীনা নেতৃত্ব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে তারা আর কখনো মিথ্যা চাপ মেনে নেবে না।
ফলত, ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধির জবাবে চীন দৃঢ় অবস্থান নিল। তারা আত্মসমর্পণ করেনি। বরং আরও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার দিকে ঝুঁকল। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, কোভিড-১৯ এর পর প্রকৃতপক্ষে আমেরিকাকেই বেশি দুর্বল দেখাচ্ছিল। আমেরিকা যদি বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে চাইত, তবে শুল্ক তুলে নেওয়াটাই ছিল/হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
চীনের শাসনব্যবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তি
পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি ভুল হলো চীনের ব্যবস্থা সোভিয়েত আমলের কঠোর স্বৈরতান্ত্রিক বলে মনে করা। বাস্তবে চীনের শাসনব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম মেধাভিত্তিক, হয়তো কেবল সিঙ্গাপুরই তার সমান। নেতৃত্ব বাছাই হয় কঠোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং প্রশাসনে দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হয়।
আমেরিকায় এর উল্টো ঘটনা ঘটছে। ৩০ বছর আগে আমেরিকান কূটনীতিকরা ছিলেন সবচেয়ে দক্ষ ও প্রভাবশালী। তখনকার চীনা কূটনীতিকরা প্রায় কেবল মাও-এর রেড বুক থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। কিন্তু আজকের চীনা কূটনীতিকেরা বহুভাষী, প্রযুক্তি-সচেতন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয়। বিপরীতে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুর্বল ও মনোবলহীন হয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতা ও আশাবাদ
সমালোচকরা ঠিকই বলেন, চীনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার দিকে তাকালে বোঝা যাবে না গত ৪০ বছরে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিস্ফোরণ কতটা হয়েছে। ১৯৮০ সালে চীনারা কোথায় থাকবে, কী পড়বে, কী পরবে–এমনকি বিদেশ ভ্রমণও করতে পারত না।
আজ কোটি কোটি মানুষ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করছে। প্রতি বছর তিন লাখেরও বেশি চীনা শিক্ষার্থী আমেরিকায় পড়তে আসে। আর ১৩ কোটির বেশি মানুষ বিদেশ ভ্রমণে যায়। যদি চীন সত্যিই এক অন্ধকার, দমনমূলক রাষ্ট্র হতো, তবে এত মানুষ বিদেশে গিয়ে আবার দেশে ফিরত না। বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত হলেও চীনারা ভবিষ্যৎ নিয়ে আমেরিকানদের তুলনায় অনেক বেশি আশাবাদী।
গণতন্ত্র: চীনের নিজস্ব পথে
চীন কি একদিন গণতান্ত্রিক হবে? হয়তো, তবে ধীরে ধীরে এবং নিজেদের শর্তে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তাদের শিক্ষা দিয়েছে–গর্বাচেভের হঠাৎ সংস্কার অর্থনৈতিক পতন, জীবনযাত্রার মান হ্রাস এবং জনদুর্ভোগ ডেকে এনেছিল। চীনের নেতারা এ ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না।
অন্যদিকে, আমেরিকা বারবার গণতন্ত্র ‘রপ্তানি’ করার নামে ইরাক ও লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে, যা বিপর্যয় ডেকে এনেছে। জর্জ কেনান বহু আগে সতর্ক করেছিলেন, অন্য সমাজকে আমেরিকা কীভাবে চলবে তা বলে দেওয়া ঔদ্ধত্যের শামিল। চার হাজার সভ্যতার অধিকারী চীন নিজের পথ নিজেই বেছে নেবে।
ঔদ্ধত্যের বিপদ
দুঃখজনকভাবে, আমেরিকার চীনবিরোধী মনোভাব ক্রমেই উন্মাদনায় রূপ নিচ্ছে। এর একটি অংশ ‘ইয়েলো পেরিল’ বা ‘হলুদ বিপদ’ নামের পুরোনো বর্ণবাদী ভয়ের সঙ্গে যুক্ত। তাই প্রায়ই চীন নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য শোনা যায়। কিন্তু এটি কার্যকর নয়। আসলে, বিশ্বের অন্য কোনো দেশ আমেরিকার মতো এত শত্রুতাপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে না। ফলে আমেরিকা নিজেকেই বিচ্ছিন্ন করছে।
এগিয়ে যাওয়ার স্মার্ট পথ
আমেরিকা-চীন প্রতিযোগিতা যুদ্ধের দিকে গড়াতে হবে না। তবে এটি হবে কঠিন, বহু-মাত্রিক সংগ্রাম। এর মঞ্চ হবে অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও প্রভাব বিস্তার–কেবল সামরিক শক্তি নয়। জিততে হলে আমেরিকাকে নিজস্ব দুর্বলতাগুলো দূর করতে হবে। নতুন কৌশল ভাবতে হবে। শীতল যুদ্ধের তুলনা টানা অলস ভাবনা থেকে বাইরে আসতে হবে।
চীন সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। এটি অনেক বেশি সংযুক্ত, অনেক বেশি সহনশীল এবং অনেক বেশি বাস্তববাদী। আমেরিকা যদি এগিয়ে থাকতে চায়, তবে তাকে নিজের সমাজ ও অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে হবে। মধ্যবিত্তের আশা ফিরিয়ে আনতে হবে। হতাশার স্রোত থামাতে হবে।
সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল হবে চীনের পথকে সম্মান করা, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা এবং নিজের সমস্যাগুলো সমাধান করা। ২১ শতকের প্রতিযোগিতা যুদ্ধক্ষেত্রে নয় বরং অর্থনৈতিক শক্তি, সামাজিক স্থিতি এবং বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতার লড়াইয়ে নির্ধারিত হবে।
প্রশ্নটা আসলে চীন জিতেছে কি না তা নয়। আসল প্রশ্ন হলো, আমেরিকা কি আবার সেই শক্তি ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে পারবে, যা একসময় তাকে বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল সমাজে পরিণত করেছিল?
(লেখাটি অধ্যাপক কিশোর মাহবুবানির ভিডিও বক্তব্য অবলম্বনে তৈরি।)