সুদানে সংকটের পেছনে কী

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারফুরের এল ফাশের এবং দক্ষিণ কোর্দোফানের কাডুগলি অঞ্চলে এখন দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

চরচা ডেস্ক
চরচা ডেস্ক
সুদানে সংকটের পেছনে কী
দারফুরের এল ফাশের এবং দক্ষিণ কোর্দোফানের কাডুগলি অঞ্চলে এখন দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

তেল, সোনা এবং কৃষির মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটি গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত। সুদানে গৃহযুদ্ধের ফলে দেশটির দারফুর এবং কোর্দোফান অঞ্চলের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারফুরের এল ফাশের এবং দক্ষিণ কোর্দোফানের কাডুগলি অঞ্চলে এখন দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অঞ্চলগুলোতে সংঘাত এবং অবরোধের কারণে খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে।

আরএসএফ কারা এবং কেন এই সংকট

২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে সুদানের সামরিক বাহিনীর সাথে আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। আরএসএফ গোষ্ঠীটি জানজাউইড মিলিশিয়া থেকে এসেছে। যারা ২০০০-এর দশকে দারফুর অঞ্চলে সংঘাতের ঘটনায় জড়িত ছিল। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সরকার সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ দমনে গোষ্ঠীটিকে ব্যবহার করেছিল।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার জানিয়েছে, সংঘাতে আনুমানিক ২৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল এবং তিন লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটররা দারফুরে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সরকারি কর্মকর্তা ও মিলিশিয়া কমান্ডারদের অভিযুক্ত করেছিলেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিলিশিয়া বাহিনীটি আরও বড় হয়। এটিকে ২০১৩ সালে আরএসএফ-এ রূপান্তরিত করা হয় এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। গোষ্ঠীটি ২০১৫ সালে সুদানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে ইয়েমেন যুদ্ধে সৈন্য পাঠানো শুরু করে। পরবর্তীতে আরএসএফ সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে।

গৃহযুদ্ধে ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
গৃহযুদ্ধে ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

আরএসএফ-এর কমান্ডার জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো। তিনি হেমেদতি বা ছোট মোহাম্মদ নামে পরিচিত। বর্তমানে সুদানের ক্ষমতাসীন সার্বভৌম পরিষদের উপপ্রধানের পদে রয়েছেন তিনি।

২০১৯ সালের এপ্রিলে, আরএসএফ সামরিক অভ্যুত্থানে অংশ নেয়। প্রেসিডেন্ট আল-বশিরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পর তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়।

সুদানের চলমান সংঘাত কেবল একটি সামরিক লড়াই নয়, যা লাখ লাখ মানুষের জন্য চরম মানবিক বিপর্যয়। ছবি: রয়টার্স
সুদানের চলমান সংঘাত কেবল একটি সামরিক লড়াই নয়, যা লাখ লাখ মানুষের জন্য চরম মানবিক বিপর্যয়। ছবি: রয়টার্স

অভ্যুত্থানের চার মাস পর, সামরিক বাহিনী এবং গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন একটি ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তিতে পৌঁছায়। যার মাধ্যমে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের কাজ ছিল নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী তিন বছর সুদানকে শাসন করা।

আল-বুরহানের নেতৃত্বাধীন এই পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে দাগালোর নাম ঘোষণা করা হয়।

২০২১ সালের অক্টোবরে আরএসএফ সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে আরেকটি অভ্যুত্থান শুরু করে। যা গণতান্ত্রিক সরকার তৈরির গতি থামিয়ে দেয়। এই পদক্ষেপ সুদানে নতুন করে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের জন্ম দেয়, যা এখন অবধি চলছে।

সেনাবাহিনী এবং গণতন্ত্রপন্থী দলগুলো আরএসএফ-কে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যোগ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। এই যোগ দেওয়ার বিষয়েই ছিল উত্তেজনার একটি প্রধান কারণ। যা একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিকে দেরি করেছে।

সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কে হবেন, তা নিয়ে দাগালো এবং আল-বুরহানের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। আরএসএফ বলেছিল, সর্বাধিনায়ক হবেন বেসামরিক রাষ্ট্রপ্রধান কিন্তু সেনাবাহিনী এই দাবী প্রত্যাখ্যান করে। এর ধারাবাহিকতায় দেশ জুড়ে শুরু হয় সশস্ত্র সংঘাত।

সুদানের চলমান সংঘাত কেবল একটি সামরিক লড়াই নয়, যা লাখ লাখ মানুষের জন্য চরম মানবিক বিপর্যয়। এল-ফাশের এবং কাডুগলিতে দুর্ভিক্ষ এবং গণহত্যা প্রমাণ করে, সংকটটি আর শুধু সুদানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়।

বুরহান এবং আরএসএফের পিছনে কারা

জেনারেল আল-বুরহানেকে সমর্থন করছে মিশর। যুদ্ধ শুরুর পরে চল্লিশ হাজারের বেশি মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিশর বুরহানের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে এরজন্য দুইদেশের মাঝে একটি স্বার্থ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বয়ে চলা নীল নদের উপর গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যামের জন্য।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সুদানের ২০১৯ সালের অভ্যুত্থান থেকে প্রধান বেসামরিক জোট নিয়ে নতুন পরিকল্পনার কথা বলছিল। তখন কায়রো সুদান সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের নিয়ে আলোচনার একটি অন্য পথ তৈরি করেছিল।

সংঘাতের সময় মিশর যুদ্ধবিরতির আহ্বান করলেও তারা সংঘাতটিকে সুদানের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বুরহানের ওপর যেকোনো চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কায়রোর ভূমিকা অত্যাবশ্যক।

অপরদিকে আরএসএফ প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালোকে সমর্থন করে আসছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।

লন্ডনের কিংস কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আন্দ্রেয়াস ক্রিগ রয়টার্সকে জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাত দাগালোকে তার অর্থ লেনদেনের জন্য সুবিধা এবং আরএসএফের জন্য জনসমর্থন তৈরি করতে সাহায্য করেছে। দাগালোর অর্থ উপার্জনের মূল মাধ্যম হিসেবে তিনি স্বর্ণ ব্যবসাকে তুলে ধরেন।

জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সুদানে সারা দেশে দুই কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ছবি: রয়টার্স
জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সুদানে সারা দেশে দুই কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ছবি: রয়টার্স

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত সতর্কভাবে সম্পর্ক বজায়ের চেষ্টা করেছে। তারা বুরহান এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এছাড়াও, সুদান নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনায় নেতৃত্ব দেওয়া কোয়াডেও তারা যোগ দিয়েছে। এই কোয়াডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব এবং ব্রিটেন আছে।

ক্রিগ আরও বলেন, “সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে কোয়াডের নীতিগত পদক্ষেপকে সমর্থন করলেও, তারা তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে দাগালো এবং আরএসএফের সাথে বিকল্প সম্পর্ক তৈরি করেছে।”

দাগালো রাশিয়ারসঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। দক্ষিণ সুদানে অবস্থানরত পশ্চিমা কূটনীতিকরা ২০২২ সালে বলেছিলেন, রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপ সুদানে অবৈধ স্বর্ণ খননে জড়িত আছে এবং ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে। তবে দাগালো দাবী করেন, আমেরিকা বেসরকারি সামরিক ঠিকাদারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর তিনি সুদানকে ওয়াগনারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওয়াগনার গ্রুপ জানিয়েছিল, তারা আর সুদানে কাজ করছে না। এভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে সুদান।

কার্যকর যুদ্ধবিরতি এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া লাখো সুদানির জীবন বাঁচানো যেন এক ধোঁয়াশার নাম। ছবি: রয়টার্স
কার্যকর যুদ্ধবিরতি এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া লাখো সুদানির জীবন বাঁচানো যেন এক ধোঁয়াশার নাম। ছবি: রয়টার্স

গৃহযুদ্ধের পরিণতি

জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে দুই কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গৃহযুদ্ধে ১ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মানুষকে তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের বিশ্লেষণকারী সংস্থা ইন্টেগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেস ক্লাসিফিকেশন জানিয়েছে, দারফুর এবং কোর্দোফানে প্রায় তিন লাখ ৭৫ হাজার মানুষ ক্ষুধার ‘চরম’ পর্যায়ে রয়েছে। খাদ্য সংকটকে পাঁচটি ধাপে বিভক্ত করা হয়। যার মধ্যে পঞ্চম ধাপ হলো দুর্ভিক্ষ এই অবস্থায় অনাহার, অপুষ্টি এবং ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।

প্রায় দেড় বছর ধরে অবরোধের পর আরএসএফ গত সপ্তাহে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলের এল ফাশের শহর দখল করে। একসময় সুদানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি ছিল এই শহর। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, এল ফাশের শহর দখলের পরে সেখানে শত শত বেসামরিক নাগরিক এবং মানবিক কর্মী নিহত হয়েছেন।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক গবেষণা ল্যাব কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণ করে এল ফাশের ও এর আশেপাশে গণহত্যা চলার দাবি করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব বলেছে, গত শুক্রবার পাওয়া কৃত্রিম উপগ্রহের ছবিতে ‘বড় ধরনের কোনো জমায়েত চোখে পড়েনি।’ এ কারণে মনে করা হচ্ছে, সেখানকার জনগণের বড় একটি অংশ হয় ‘মারা গেছে, বন্দী হয়েছে কিংবা লুকিয়ে আছে।’ সেখানে গণহত্যা অব্যাহত থাকার বিভিন্ন ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।

জাতিসংঘের তথ্য এবং আইপিসি রিপোর্টের ভিত্তিতে বোঝা যায়, সুদান চরম দুর্ভিক্ষ ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। এই সংঘাত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। কার্যকর যুদ্ধবিরতি এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া লাখো সুদানির জীবন বাঁচানো যেন এক ধোঁয়াশার নাম।

সম্পর্কিত