ফজলে রাব্বি

শুরু হয়েছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধে জয় ছিনিয়ে আনে বাংলার সূর্যসন্তানেরা। ১৯৭১ সালে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রতিটি দিন ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল।
চূড়ান্ত মুক্তির হাতছানি নিয়ে ৭১ সালের ডিসেম্বর হাজির হয় বাঙালির দরজায়। নভেম্বরজুড়ে মুক্তিবাহিনীর একের পর এক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সারাদেশ থেকে আসতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে হানাদারদের পরাস্ত হওয়ার খবর।
এমনকি ঢাকায়ও গেরিলাদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে হানাদাররা। পহেলা ডিসেম্বর সকাল শুরু হয়েছিল ঢাকার পাকিস্তান পিপলস পার্টির কার্যালয়ে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে। রণক্ষেত্রের মতোই কূটনীতিতেও বাংলাদেশ ও মিত্রশক্তি ভারত নানা মাত্রিক চাপ তৈরি করে পাকিস্তানের ওপর।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ প্রশ্নে স্পষ্ট হতে থাকে পরাশক্তিগুলোর অবস্থান। ভূরাজনৈতিক স্বার্থের আলোকে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দৌড়ঝাপের গতি বাড়তে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ও মিত্রশক্তি ভারতের কূটনৈতিক সফলতা দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক সমর্থন দুর্বল হতে থাকে পাকিস্তানের পক্ষে। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রাক্কালে উত্তেজনাপূর্ণ জটিল পরিস্থিতি নিয়ে শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাঙালির ডিসেম্বর।
মুক্তিযুদ্ধে পর্যুদস্ত হওয়ার বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পাকিস্তান ভারতে আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে দিল্লি। সম্ভাব্য আক্রমণের জবাব দিতে ভারতের সামরিক তৎপরতার কথাও উঠে আসে বিশ্ব গণমাধ্যমে।
ডিসেম্বরের এক তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্যসভায় দেওয়া ভাষণে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। অন্যদিকে, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে পরাজয় এড়ানোর কৌশল হিসেবে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির জন্য জোর তৎপরতা শুরু করে।
পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগে চীনের সমর্থনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে আসে। সে সময় ভারতের কৌশলগত মিত্র হিসেবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে উত্থাপিত হতে যাওয়া সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করবে বলে চাউর হয়ে যায়। এই ঘটনা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
সবকিছু মিলিয়ে কোনঠাসা ও আতঙ্কিত পাকিস্তানি বাহিনী আবারও নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। ১ ডিসেম্বর আমেরিকার সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে বলা হয়, “বাংলাদেশের ভেতরে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তার সহযোগী বাহিনীর লোকেরা আবারও গ্রামবাসীদের হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার বর্বর অভিযান শুরু করেছে। গেরিলা সন্দেহে জিঞ্জিরার কতজন যুবককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে তার সঠিক হিসাব নেই। বুড়িগঙ্গার অপর পারের এই গ্রামটিতে অন্তত ৮৭ জনকে সামরিক বাহিনীর লোকেরা হত্যা করেছে। এদের অধিকাংশই যুবক। নারী ও শিশুরাও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।”
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সংবাদদাতা ঢাকা থেকে জানান, আগুনের শিখায় ঢাকার দিগন্ত রক্তিম। বুড়িগঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে অসংখ্য মৃতদেহ।
গাজীপুরের কালীগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের খলাপাড়া গ্রামে ন্যাশনাল জুট মিলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন ১৩৬ জন নিরীহ মানুষ। এদিন রাঙামাটি ব্যাপটিস্ট মিশনে ঢুকে হানাদার বাহিনী ধর্মযাজক চার্লস আর. হাউজারসহ বহু বাঙালিকে হত্যা করে।
অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পিছু হটতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় এতোটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, ডিসেম্বরের এক তারিখে সচিব কমিটির বৈঠকে বিজয়োত্তর বাংলাদেশের শৃঙ্খলা, বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনে আইন প্রণয়ন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, আয় ও আমদানি, দালালদের প্রতি কী আচরণ করা হবে- এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে কমিটির সদস্যদের তাগিদ দেওয়া হয়।
বিজয়ের পতাকা উড়লেই শুরু হয়ে যাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কাজ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাবিধি তৈরি, বিদেশ ভ্রমণে ট্রাভেল পাস ইস্যু, মুদ্রানীতি তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রবাসী সরকার হাত দিয়েছিল ডিসেম্বরের আগেই।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, এইচ. টি. ইমাম
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র অষ্টম, একাদশ ও দ্বাদশ খন্ড।
দৈনিক ইত্তেফাক ২ ডিসেম্বর ১৯৭১

শুরু হয়েছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধে জয় ছিনিয়ে আনে বাংলার সূর্যসন্তানেরা। ১৯৭১ সালে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রতিটি দিন ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল।
চূড়ান্ত মুক্তির হাতছানি নিয়ে ৭১ সালের ডিসেম্বর হাজির হয় বাঙালির দরজায়। নভেম্বরজুড়ে মুক্তিবাহিনীর একের পর এক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সারাদেশ থেকে আসতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে হানাদারদের পরাস্ত হওয়ার খবর।
এমনকি ঢাকায়ও গেরিলাদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে হানাদাররা। পহেলা ডিসেম্বর সকাল শুরু হয়েছিল ঢাকার পাকিস্তান পিপলস পার্টির কার্যালয়ে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে। রণক্ষেত্রের মতোই কূটনীতিতেও বাংলাদেশ ও মিত্রশক্তি ভারত নানা মাত্রিক চাপ তৈরি করে পাকিস্তানের ওপর।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ প্রশ্নে স্পষ্ট হতে থাকে পরাশক্তিগুলোর অবস্থান। ভূরাজনৈতিক স্বার্থের আলোকে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দৌড়ঝাপের গতি বাড়তে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ও মিত্রশক্তি ভারতের কূটনৈতিক সফলতা দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক সমর্থন দুর্বল হতে থাকে পাকিস্তানের পক্ষে। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রাক্কালে উত্তেজনাপূর্ণ জটিল পরিস্থিতি নিয়ে শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাঙালির ডিসেম্বর।
মুক্তিযুদ্ধে পর্যুদস্ত হওয়ার বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পাকিস্তান ভারতে আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে দিল্লি। সম্ভাব্য আক্রমণের জবাব দিতে ভারতের সামরিক তৎপরতার কথাও উঠে আসে বিশ্ব গণমাধ্যমে।
ডিসেম্বরের এক তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্যসভায় দেওয়া ভাষণে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। অন্যদিকে, পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে পরাজয় এড়ানোর কৌশল হিসেবে জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির জন্য জোর তৎপরতা শুরু করে।
পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগে চীনের সমর্থনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে আসে। সে সময় ভারতের কৌশলগত মিত্র হিসেবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে উত্থাপিত হতে যাওয়া সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করবে বলে চাউর হয়ে যায়। এই ঘটনা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
সবকিছু মিলিয়ে কোনঠাসা ও আতঙ্কিত পাকিস্তানি বাহিনী আবারও নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। ১ ডিসেম্বর আমেরিকার সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে বলা হয়, “বাংলাদেশের ভেতরে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তার সহযোগী বাহিনীর লোকেরা আবারও গ্রামবাসীদের হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার বর্বর অভিযান শুরু করেছে। গেরিলা সন্দেহে জিঞ্জিরার কতজন যুবককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে তার সঠিক হিসাব নেই। বুড়িগঙ্গার অপর পারের এই গ্রামটিতে অন্তত ৮৭ জনকে সামরিক বাহিনীর লোকেরা হত্যা করেছে। এদের অধিকাংশই যুবক। নারী ও শিশুরাও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।”
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সংবাদদাতা ঢাকা থেকে জানান, আগুনের শিখায় ঢাকার দিগন্ত রক্তিম। বুড়িগঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে অসংখ্য মৃতদেহ।
গাজীপুরের কালীগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের খলাপাড়া গ্রামে ন্যাশনাল জুট মিলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন ১৩৬ জন নিরীহ মানুষ। এদিন রাঙামাটি ব্যাপটিস্ট মিশনে ঢুকে হানাদার বাহিনী ধর্মযাজক চার্লস আর. হাউজারসহ বহু বাঙালিকে হত্যা করে।
অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা পিছু হটতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় এতোটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, ডিসেম্বরের এক তারিখে সচিব কমিটির বৈঠকে বিজয়োত্তর বাংলাদেশের শৃঙ্খলা, বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনে আইন প্রণয়ন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, আয় ও আমদানি, দালালদের প্রতি কী আচরণ করা হবে- এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে কমিটির সদস্যদের তাগিদ দেওয়া হয়।
বিজয়ের পতাকা উড়লেই শুরু হয়ে যাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কাজ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাবিধি তৈরি, বিদেশ ভ্রমণে ট্রাভেল পাস ইস্যু, মুদ্রানীতি তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রবাসী সরকার হাত দিয়েছিল ডিসেম্বরের আগেই।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, এইচ. টি. ইমাম
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র অষ্টম, একাদশ ও দ্বাদশ খন্ড।
দৈনিক ইত্তেফাক ২ ডিসেম্বর ১৯৭১

ভারতের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো, এটা প্রমাণ করা যে, এখন থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এক-দু’জন নেতা এবং রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে থাকবে। পুরোনো রাজনৈতিক মিত্রকে রক্ষার চেয়ে তাদের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত, রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাস্তবতা মেনে নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ।

এই অস্থিতিশীল পরিবেশে মতাদর্শিক গোষ্ঠী, বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক শক্তিগুলো অস্বাভাবিক প্রভাব অর্জন করছে। জামায়াত ঘনিষ্ঠ সংগঠনগুলো তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধ অফিস খুলে ফেলেছে। ছাত্রশিবির ক্যাম্পাস ইউনিটগুলো ফের সক্রিয় করছে; ছোট ইসলামি দলগুলো নির্বাচনের আগে জোট নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ব