শেয়ার বাজার

গত এক বছরে একটি নতুন শেয়ার আসেনি!

গত এক বছরে একটি নতুন শেয়ার আসেনি!
পুঁজিবাজারের প্রতীকী ছবি

গত বৃহস্পতিবার [১৮-১২-২০২৫] ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) আগের দিনের চেয়ে লেনদেন শতকরা ১৯ ভাগ কম হয়েছে। মোট লেনদেনের পরিমাণ মাত্র ৩০৩ কোটি টাকা। অবশ্য বেশ দীর্ঘ সময় ধরে ডিএসইর লেনদেনের পরিমাণ কম। অর্থাৎ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমেই চলেছে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ধরা হয় ১৭ কোটি। বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। বিও অ্যাকাউন্ট মানে বেনিফিশারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট। শেয়ার বাজারে লেনদেন করতে হলে ব্রোকার হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক, বা ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। অবস্থাটা এমন হয়েছে যে জনসংখ্যার শতকরা একভাগও শেয়ার বাজারে আসছে না। কেননা মনে করা হয় যে, এই অ্যাকাউন্টের ভেতর কিছু নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আবার কিছু যৌথ ওনারশিপ রয়েছে। এ অবস্থায় শেয়ার বাজারের হাল এই।

এ অবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য কিছুদিন আগে শেয়ার বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুধীজনদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ চলতে থাকে। তবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এই দোষারোপ অমূলক নয়। এর ফলেই আজ শেয়ার বাজারের এ অবস্থা। দীর্ঘ সময় ধরেই শেয়ার বাজার চলছে। শেয়ার বাজারের চাঙা ভাব ও মন্দা ভাবকে বুল বিয়ার সেশন বলা হয়। অর্থাৎ ষাঁড় ভালুকের লড়াই। শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে বলা হয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। মাঝে মাঝে বিএসইসি এমন কিছু নির্দেশ জারি করছে। যে শেয়ার বাজারকে দুর্বল করেছে এর ভেতর বিএসইসির একটি বড় সিদ্ধান্ত ছিল ফ্লোর প্রাইস বিধি মানতে হবে। ফ্লোর প্রাইজ মানে একটি শেয়ারের বিক্রয় মূল্য স্থির করে দেওয়া হবে। কোন অবস্থাতেই এই নির্ধারিত মূল্যে নীচে শেয়ার বিক্রি করা যাবে না। বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিধিটি স্টক এক্সচেঞ্জ চালু করতে পারে। তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। কেননা এটি একজন বিনিয়োগকারীর মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হয়। তার অর্থের প্রয়োজন হলে তিনি যে কোনো মূল্যে বিক্রি করতে পারেন। যাহোক বিএসইসি দীর্ঘ সময় ধরে এই কালাকানুন চালু রেখেছিল। অনেক সমালোচনার পর এটি প্রত্যাহার করা হয়। এতে অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ার বাজার বিমুখ হন।

তবে ব্যাপকভাবে শেয়ার বাজার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা চলে যান শেয়ার কেলেঙ্কারি যারা করেন তাদের বিচার না হওয়ায়। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৯-২০১০ সালে যে ভয়াবহ শেয়ার কেলেঙ্কারি হয়, তার সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায়। ঘটনাচক্রে দুটো ঘটনা ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। এক শ্রেণির শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞদের উদ্ভট জ্ঞান দানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এই কেলেঙ্কারি সংঘটিত হওয়ার পেছনে। শেয়ারের দাম যখন অযৌক্তিকভাবে বাড়তে থাকে তখন তার লাগাম টেনে ধরতে হয়। কিন্তু এদের কথায় আকাশছোঁয়া হলো শেয়ারের মূল্য। অতএব সরকার তথা মার্চেন্ট ব্যাংকের দায়িত্ব হলো বেশি বেশি ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। অথচ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের প্রথম উপদেশ হলো: ধারের টাকা দিয়ে শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন না। নিজের উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে শেয়ার কিনবেন। আর এটাতো সাধারণ জ্ঞানেও বলে, নিজের সঞ্চয় না থাকলে কি বিনিয়োগ করার প্রশ্ন উঠে। এই সময়ে প্রচুর বিনিয়োগকারী শেয়ার বাজারে আসেন। এতে অনেক নারীও এসেছিলেন। যখন ধস নামল, সেটা ছিল ভয়াবহ। আমার এক আত্মীয়ের ২০ লাখ টাকার শেয়ার ৬ লাখে ঠেকে। তার দাম্পত্য জীবন সংকটাপন্ন হয়েছিল। শেয়ার ব্রোকারের কোন ক্ষতি হয়নি। তিনি তো নির্দিষ্ট কমিশন পেয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সাহেবের কথা মনে পড়ল। এক সময় যখন দেশে রুগ্‌ণ শিল্পের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন তিনি বলেছিলেন, শিল্প রুগ্‌ণ হয়, কিন্তু শিল্পের মালিক রুগ্‌ণ হন না।

তো শেয়ার বাজারের দুই ধসের সময় সহস্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে বাজার ছেড়ে পালিয়েছেন। কিন্তু ব্রোকাররা শানশৌকতে আছেন। স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাণ হলো প্রাইমারি মার্কেটে নতুন শেয়ারের আগমন। শুনে শিউরে উঠতে হলো যে, বাংলাদেশের মতো বিকাশমান শেয়ার বাজারে গত এক বছরে একটি নতুন শেয়ার আসেনি যা আইপিওর মাধ্যমে ছাড়া হয়। সেই সুধী সমাবেশের কার্যবিবরণী পড়ে বোঝা গেল যে কোম্পানি নতুন শেয়ার ছাড়ার জন্য নানা বিধি-বিধানের সম্মুখীন হতে হয়। একটি আইপিও আসতে দু বছর পর্যন্ত সময় লাগে। আমি নিশ্চিত যে বিশ্বের আর কোনো দেশে এই ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যাবে না। কোনো কোম্পানি শেয়ার ছাড়ার প্রস্তাব নিয়ে এলে সে বিএসইসি এবং ডিএসইর ক্ষমতা প্রদর্শনের শিকার হয় যাকে বলে বলির পাঁঠা। অথচ এই দুই প্রতিষ্ঠানকে জনমুখী কাজ ও মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হতো। কেননা যত বেশি নতুন শেয়ার আসবে শেয়ার বাজার তত বেশি ষাঁড়ের লড়াই এর শক্তি অর্জন করবে। বিধি বাম। আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্যের দেশ বাংলাদেশে দেখতে হবে বা সইতে হবে আমলাতান্ত্রিক অত্যাচার।

২৪-এর জুলাইয়ে সহস্রাধিক শহিদ জুলাই যোদ্ধার বুকের রক্তে ফ্যাসিবাদের উৎখাত হলো। সবার প্রত্যাশা যে, অনেক সংস্কার হবে। বিশেষ করে একটি পুলিশ কমিশন গঠিত হবে, যার মাধ্যমে পরিচালিত হবে একটি পুলিশ বাহিনী, যারা হবে মানবিক। রাজনীতির প্রভাবমুক্ত। এই পুলিশরা তো আমাদের গ্রহের মানুষ। তারা ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে কাজ করবে। বিনিময়ে জনগণের কাছে বন্ধুসুলভ ব্যবহার পাবে। সংস্কারের জন্য অনেক কমিশন ও সভা-সমিতি হয়েছে। কিন্তু টিআইবি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, যে পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব রয়েছে সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলাদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে। তাদের সহযোগী হবেন অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। আর রাজনৈতিক প্রভাব ঘটানোর জন্য আসছেন নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য। বাংলাদেশে সকল শ্রেণির আমলা এবং অন্যান্য প্রভাবশালী গোষ্ঠী যথা রাজনীতিক ও পেশাজীবী। এই ক্ষমতা দেখানোর একটা কৌতুক শুনেছিলাম এবং দেখেছিলাম সম্ভবত বিটিভিতে। মামা রেলওয়ের গেটকিপার। ভাগ্নে তাকে জিজ্ঞাসা করে তার ক্ষমতা কি? মামা তাকে অপেক্ষা করতে বলে। একটু পরে একটি ট্রেন এসে গেটে থেমে যায়। কেননা গেটকিপার সবুজ পতাকা না দেখিয়ে লাল পতাকা দেখান। রেলওয়ে গার্ড নেমে এসে গেটকিপারের কাছ থেকে সদুত্তর পাননি। তখন তিনি গেটকিপারকে খুব জোরে ঘুসি মেরে ভূপাতিত করে গাড়ি নিয়ে চলে যান। ভাগ্নে জানতে চাইল যে মামা কি হল। মামা উত্তরে বললেন, আমি আমার ক্ষমতা দেখিয়েছি। গার্ড তার ক্ষমতা দেখিয়েছে। এটাই হলো বাংলাদেশ স্টাইল।

ভয়াবহ দুটো শেয়ার কেলেঙ্কারি হলো যার কোনো বিচার হলো না। বিশ্বে স্টক এক্সচেঞ্জ চালু হওয়ার পর বহু শেয়ার কেলেঙ্কারি হয়েছে এবং আরো হতে থাকবে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তাহলো, এর সুষ্ঠু ও যথাযথ বিচার। ১৭২৪ সালে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে ভয়াবহ শেয়ার স্ক্যাম হয় যেটা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের ইতিহাসে সাউথ সি বাবল নামে পরিচিত। সে সময় শেয়ার বাজারের জন্য আজকের মতো কোন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ নামে পৃথক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ছিল না। বিশ্বে প্রথম এসইসি চালু হয় আমেরিকায়, ১৯৩৬ সালে। এখন অবশ্য যে দেশে স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৭২৪ সালের এই কেলেঙ্কারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে অনেকে দোষী সাব্যস্ত হন। তার ভেতর ছিলেন ব্রিটেনের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, যার সরকারি পদবি হলো চ্যান্সেলর অব দি এক্সচেকার। তখনকার রীতি অনুযায়ী তাকে লন্ডন টাওয়ার বন্দি করা হয়। আজও লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং বিশ্বের প্রথম ২-৩টা স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে এর অবস্থান। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের দায়িত্ব শুধু দলীয় প্রধানের স্তুতি গাইয়ে সময় কাটানো নয়। জনগণের স্বার্থের দিকে নজর রাখতে হয়।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা, আর্থিক খাত বিশ্লেষক, লেখক

সম্পর্কিত