উন্নয়ন বনাম পরিবেশ–শেষ হতে যাচ্ছে অতিদীর্ঘ টেস্ট ম্যাচ

রিসালাত খান
রিসালাত খান
উন্নয়ন বনাম পরিবেশ–শেষ হতে যাচ্ছে অতিদীর্ঘ টেস্ট ম্যাচ
শিল্পবিপ্লবের দুই শতাব্দী পর, কয়লা অধিনায়কের পদ থেকে নামলো। সূর্য একবিংশ শতাব্দীর অধিনায়ক। ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

বিশ্ব এখন ব্রাজিলে কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনের ময়দানে। তবে সম্মেলন শেষের পথে। ভূ-রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ, বাতাসে অনিশ্চয়তা। কিন্তু দিগন্তে দেখা যায়–মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে।

‘উন্নয়ন বনাম পরিবেশ’–মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ আর ধৈর্য-পরীক্ষার ম্যাচগুলোর একটি। দুই দল মাঠে, খেলা চলছে যুগের পর যুগ, কিন্তু কারও জয় নেই। সেই টেস্ট ম্যাচ এখন শেষের দিকে। কারণ খেলার নিয়মই বদলে গেছে। এখন সেই দল জিতবে, যে দলে উন্নয়ন আর পরিবেশ একসাথে খেলবে।

আর যে তারকা খেলোয়াড় পুরো খেলার হিসাবটাই বদলে দিচ্ছে? নবায়নযোগ্য শক্তি–সূর্য, বায়ু আর ব্যাটারি।

দুনিয়া বদলে গেছে: সূর্য এখন নতুন অধিনায়ক

২০২৪ সালে পৃথিবীজুড়ে যোগ হয়েছে রেকর্ড ৫৮৫ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ– গত পাঁচ বছরের গড়ের প্রায় দ্বিগুণ! এর প্রায় সবটাই এসেছে সৌর আর বায়ু থেকে, এর মধ্যে বেশির ভাগই সৌরবিদ্যুৎ।

কিন্তু আসল বিপ্লবটা ঘটেছে দামে। এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নতুন সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো নতুন কয়লা বা গ্যাস প্ল্যান্টের চেয়ে সস্তা আর দ্রুত–কখনো কখনো বিদ্যমান জীবাশ্ম জ্বালানীর প্ল্যান্ট চালানোর খরচের চেয়েও কম।

এই বছর নবায়নযোগ্য শক্তি প্রথমবারের মতো কয়লাকে টপকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎসে পরিণত হয়েছে –কয়েক বছর আগেও যা কল্পনা করা যেত না।

শিল্পবিপ্লবের দুই শতাব্দী পর, কয়লা অধিনায়কের পদ থেকে নামলো। সূর্য একবিংশ শতাব্দীর অধিনায়ক। গত পঞ্চাশ বছরে সৌরবিদ্যুতের দাম কমেছে ৯০ শতাংশেরও বেশি, অথচ কয়লা-গ্যাসের খরচ মোটামুটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। নবায়নযোগ্য শক্তি যে শক্তির লিডারবোর্ডে প্রথম স্থানে চলে এসেছে, আমরা অনেকেই সেটা টেরই পাইনি।

এটা কেবল শুরু। নবায়নযোগ্য শক্তির গতি এক্সপোনেনশিয়াল–প্রতিবছর আরও সস্তা, আরও দ্রুত, আরও সহজলভ্য হচ্ছে। ব্যাটারির দামও পড়ছে উল্কাপাতের মতো করে। সৌর + বায়ু + স্টোরেজ এখন ‘বিকল্প’ নয়–এটাই নতুন নর্মাল।

নির্বাচিত সরকারকে স্পিনের মোড় বুঝে ব্যাট করতে হবে

দুনিয়ার মানুষ সেই ধীরগতির আমলাতন্ত্র দেখে ক্লান্ত, যারা জনগণের জীবনে সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে পারছে না। ফল? রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাস্তায় ক্ষোভ, আর ভোটে প্রতিশোধ।

বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। বিদ্যুতের দামের ওপর নির্ভর করে সংসারের ব্যয় থেকে শুরু করে রপ্তানির প্রতিযোগিতা। যেই সরকার দ্রুত নতুন বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে না পারে, সে সরকার নাগরিকের চোখে আস্থা হারাবে।

ব্রাজিলের বেলেমে বসেছে এবারের জলবায়ু সম্মেলন। ছবি: রয়টার্স
ব্রাজিলের বেলেমে বসেছে এবারের জলবায়ু সম্মেলন। ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের দিকে তাকালে এটা বোঝা যায়। সরকার যখন সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ দিতে ব্যর্থ হলো, জনগণ তখন খেলা নিজের হাতে তুলে নিল। শুধুমাত্র ২০২৪ সালে পাকিস্তানিরা চীন থেকে এত সৌর প্যানেল আমদানি করে বসিয়েছে যে তা প্রায় দেশের গ্রিডের অর্ধেক সমান ক্ষমতা। রাতারাতিই এক নতুন বাজার তৈরি হলো: আমদানিকারক, ইলেকট্রিশিয়ান, টেকনিশিয়ান–সবাই ব্যস্ত। কিন্তু গ্রিড প্রস্তুত না থাকাতে সরকার এখন সামলে নিতে হিমশিম খাচ্ছে।

এই গল্পে আছে সতর্কবার্তা, আবার আশাও। যদি জনগণ এত দ্রুত নবায়নযোগ্য শক্তিতে ঝুঁকতে পারে তাদের নিজেদের আর্থিক চাহিদার ফলে, তাহলে সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা মানুষের সাথে হাত লাগালে কি না সম্ভব?

বায়ুদূষণ– যা অনেকটাই জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে ঘটে। এই বায়ুদূষণের বিশ্বের প্রতি পাঁচটি অকাল মৃত্যুর একটির জন্য দায়ী। পরিষ্কার বাতাস মানে সুস্থ মানুষ, কম চিকিৎসা খরচ, বেশি উৎপাদনশীলতা।

জ্বালানিতে আত্মনির্ভর হওয়া মানে বিদেশি জ্বালানির দামের খামখেয়ালি ওঠানামার ওপরে নির্ভরতা কমানো। বাংলাদেশ প্রতি বছর ৬০০ কোটি ডলার খরচ করে জ্বালানি আমদানিতে। প্রতিটি সৌর প্যানেল কারখানার বা বাড়ির ছাদে, বা এগ্রিভল্টাইক্স প্রযুক্তিতে (একসাথে চাষাবাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন) করা গেলে, আমরা আমাদের অর্থ দেশে রাখতে পারি এবং তা জনকল্যাণে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ও এতে বাড়বে।

আর পরিবেশের দিকটা? সেটা আরও স্পষ্ট। প্যারিস চুক্তির দশ বছর পর বিশ্ব এখন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মুখে, যা বাংলাদেশের মত দেশের জন্য খাঁড়ার ঘা-র মতো। ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো আর তাদের পাশে থাকা বাংলাদেশের ড. সালিমুল হকই ছিলেন এই লক্ষ্য অর্জন করার লড়াই-এর সামনের সারিতে, যে লড়াই এখনো চলছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে বিশ্ব যত দ্রুত এগিয়ে যাবে, আমাদের ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তত কম মূল্য দিতে হবে।

প্রকৃতি ও পরিবেশ-এর দিক দিয়ে আমাদের সবচেয়ে বড় ঢাল সুন্দরবন। এই বন ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপটা থেকে আমাদের রক্ষা করে। রামপালের মতো কয়লাভিত্তিক প্রকল্প তার গলা টিপে ধরছে। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য শক্তি পথ খুলে দিচ্ছে সুন্দরবনের প্রাণ ফেরানোর।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর: বাংলাদেশের শতরানের প্রস্তুতি

গত বছর দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের ভেতরের পরিবর্তনের ক্ষুধা এখনো তীব্র। জুলাই আন্দোলন ভেঙে দিয়েছে বহুদিনের নিরুৎসাহ আর অবিশ্বাস। কয়েক সপ্তাহের জন্য যেন বাতাসে একরকম বিদ্যুতের শিহরণ ছিল। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, রাজনীতি আবারও মানুষের স্বপ্নের অভয়ারণ্য ও সেবার জায়গা হয়ে উঠতে পারে।

আজ সে আশার সঙ্গে ক্লান্তি আর পুরনো অবিশ্বাস আবার মিলেমিশে একাকার। পুরনো ব্যবস্থা, নষ্ট রাজনীতি, আগের অভ্যাস সবই ফণা তুলেছে। তবু একটা জিনিস আর আগের মতো নেই, এক প্রজন্ম নিজের কণ্ঠ খুঁজে পেয়েছে। এই প্রজন্ম জানে, দুনিয়া বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড়। শক্তিধর দেশগুলোর প্রযুক্তি আর বাণিজ্য-যুদ্ধ, রপ্তানিতে নতুন শুল্ক, ভারতীয় আগ্রাসন, আর তার ওপর জলবায়ুর কালো মেঘ–সব মিলিয়ে আমরা এক চৌরাস্তার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।

এমন সময়ে আমাদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো, আমরা কি ন্যূনতম জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে পারব? জুলাই সনদ সেই পরীক্ষার আয়না। ঐক্য মানে সবাই এক কথা বলবে, তা নয়; বরং যেখানে মুক্তভাবে কথা বলা যায়, মতভেদও মর্যাদা পায়, তবু একটা বড় জাতীয় স্বপ্নে সবাই অংশ নেয়। রাজনীতি যেন হয় আইডিয়ার খেলা, মারামারি কাটাকাটির ময়দান নয়।

তিন মাস পরে নির্বাচন। তারপর যে সরকার আসবে, তার জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে কি না, সেটাই আসল প্রশ্ন। আমরা কি দেখাতে পারব, বিশ্বের দক্ষিণ কোণে গণতন্ত্র হতে পারে উত্তেজনাপূর্ণ অথচ শান্তিপূর্ণ–যেখানে মতভেদ আছে, কিন্তু সহিংসতা নেই? এই উত্তরটাই ঠিক করবে, বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ কতটা বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠ হতে পারে।

জলবায়ুর খেলায় আমরা টসে হেরেছিলাম। কিন্তু খেলা ছেড়ে দিইনি। বরং সেই প্রতিকূলতাতেই গড়ে উঠেছে কমিউনিটি নির্ভর উদ্ভাবন আর অভিযোজন, যা আজ বিশ্বে ঈর্ষার পাত্র। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, মৌসুমি চাষাবাদ, স্থানীয় অসংখ্য উদাহরণ আমরাই করে দেখিয়েছি যা ধনী দেশগুলো এখন শিখতে শুরু করেছে।

আজ ধনী দেশগুলোতেও ‘অভিযোজন’ রাজনীতির নতুন আলোচ্য বিষয়। কিন্তু সেই সহমর্মিতা তাদের সীমান্তেই থেমে যায়। তারা নিজেদের ঘর বাঁচাতে ব্যস্ত। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠের ঋণ শোধ হয়নি, এই কপ৩০-তেও হবে না।

বিশ্বের ময়দানে জলবায়ু এখন বড় খেলা। ক্ষমতাধর দেশগুলো ঋণখেলাপি। আর এই ঋণ আদায় করে না নিলে কখনোই মিলবে না। জুলাই বিপ্লবের সাহস নিয়ে আমাদের বিশ্বের ময়দানে নেতৃত্ব দিতে হবে।

কিন্তু সেই ভূমিকা নিতে হলে আগে আমাদের নিজেদের ভেতরের দানবের মুখোমুখি হতে হবে। দুর্নীতি, অন্ধ দলাদলি, আর সেই পুরনো অভ্যাস–যেখানে একে অন্যকে টেনে হিঁচড়ে নামাই। অথচ এটা একসাথে ওঠার সময়। যদি সেই ভেতরের শয়তান কে হারাতে পারি, তাহলে আমরা বিশ্বমঞ্চে নেতৃত্ব দিতে পারব–ভুক্তভোগী হিসেবে নয়, অভিজ্ঞ যোদ্ধার সুরে।

আমেরিকায় জোহরান মামদানি দেখিয়েছেন, কীভাবে একজন তরুণ নেতা নিজের মুসলিম পরিচয়ে গর্বিত থেকে বহুত্ববাদী রাজনীতির মাধ্যমে মানুষকে এক করা যায়। এবং তা বিদ্বেষ, অর্থবল, ইসলামোফোবিয়া–সবকিছুকে হারিয়ে। আমাদের জন্য এটা এক দৃষ্টান্ত–যে ধর্মীয় বিশ্বাস ভিন্নতাকে ভয় পায়, সেটাই দুর্বল বিশ্বাস। আর যে বিশ্বাস ভিন্নতাকে আপন করে নেয়, সেই বিশ্বাস মানুষকে নাড়া দেয়, মানুষের সমর্থন পায়।

যদি আমরা বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারি, আর দেখাতে পারি যে উন্নয়ন ও পরিবেশ একসাথে এগোতে পারে এবং তা প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যেও–তাহলে আমরা পৃথিবীকে এক অনুপ্রেরণার গল্প উপহার দেব। আমাদের থেকে অনেক ছোট ছোট দেশ, যেমন বার্বাডোস আর মার্শাল আইল্যান্ডস–তারা বিশ্ব মঞ্চে নেতৃত্ব দিয়ে দেখিয়েছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?

এইভাবেই আমরা আমাদের স্বাধীনতার শতরানের ইনিংস এর জন্য তৈরি হতে পারি–সাহস, আত্মবিশ্বাস, আর বৈচিত্র্যের ভেতরকার ঐক্য দিয়ে।

টেস্ট ম্যাচ শেষের পথে।

নতুন খেলা শুরু।

রিসালাত খান: আন্তর্জাতিক জলবায়ু-বিষয়ক আন্দোলনের কর্মী। ইনসিওর আওয়ার ফিউচার ক্যাম্পেইন-এর সিনিয়র স্ট্রাটেজিস্ট।

সম্পর্কিত