ফুটবল আমাদের বার বার দাগা দেয় কেন

ফুটবল আমাদের বার বার দাগা দেয় কেন
ফুটবল কেন বারবার কাঁদায়

হংকং চায়নার বিপক্ষে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচটি হৃদয় ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের। ভাবা যায়, শুরুতে গোল করে এগিয়ে গিয়েও স্কোরলাইন যখন প্রতিপক্ষ ৩–১ করে ফেলে, সেই খেলার কি আর কিছু বাকি থাকে? কিন্তু সেই স্কোরলাইনকেই ৩–৩ করে ফেলার পর বাংলাদেশ যখন প্রায় জয়ের সমান অনুভূতিতে আচ্ছন্ন, ঠিক তখনই হংকং চায়নার চার নম্বর গোল। ম্যাচের যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটে ৩–৩ করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চার নম্বর গোল হজম করে হার! ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এমন হারের অনূভূতি ভয়াবহ।

ম্যাচ শেষে স্টেডিয়াম থেকে বাড়ি ফেরত জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম বৃহস্পতিবার রাতে। বিমর্ষ, বিধ্বস্ত। বাঁধভাঙা উল্লাসের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই হার দেখা গোল, ভাবাই যায় না। গোটা ব্যাপারটাই পাগলাটে। ফুটবলপ্রেমীদের অনেকের মুখেই আক্ষেপ, ‘এমন ব্যাপার বাংলাদেশ ফুটবলের সঙ্গেই বারবার কেন ঘটে? ফুটবল কেন বারবার আমাদের হৃদয় ভেঙে দেয়?

সবকিছু স্পষ্ট মনে নেই। দৃশ্যপটগুলো অস্পষ্ট, ভাসা ভাসা। তবুও ফুটবল নিয়ে বড়দের কষ্টের অনুভূতি ভালো করেই মনে আছে। তখন সাদাকালো টেলিভিশনের যুগ। ১৯৮৫ সালের সাফ গেমসের কথাই বলছি। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সেরা দলই ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেই সাফ গেমসে খেলেছিল। গ্রুপপর্বে মালদ্বীপকে ৮–০ গোলে হারানো সেই দল। ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি ভারতের মুখোমুখি। বাড়িতে বড়দের সঙ্গে বসে খেলা দেখছি। তীব্র উত্তেজনা। শুরুতেই আচমকা গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ল বাংলাদেশ। সবার হা হুতাশ। কিন্তু সেই গোল বাংলাদেশ শোধ করে দিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাইনাল হারতে হয় টাইব্রেকারে, ৪–১ ব্যবধানে। বড়দের আক্ষেপ, হার মেনে নিতে না পারার কষ্টটা সেদিন দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম। এরপর ৪০ বছর কেটে গেছে। একটা প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীরা সেই ম্যাচ নিয়ে এখনো আক্ষেপ করেন। কেউ কেউ বলেন, ১৯৮৫ সাফ গেমসের ফাইনালটা সেদিন যদি বাংলাদেশ জিতে যেত, তাহলে দেশের ফুটবলের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

Cabrera

তা হয়তো লেখা হতো, কিন্তু ফুটবল পরের ৪০ বছরে আমাদের বরাবরই হতাশ করে এসেছে। ১৯৮৯–এর ইসলামাবাদ সাফ গেমসের কথাই ধরুন। দেশের ফুটবলের আরেক সেরা দল। অনেকেই বলেন, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, রেজাউল করিম রেহান আর ইমতিয়াজ সুলতান জনিকে নিয়ে গড়া সেই দলের রক্ষণ ইতিহাসেরই সেরা রক্ষণ। অথচ, সেবারের ফাইনাল পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ হারে রক্ষণেরই মারাত্মক এক ভুলে। তাও ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে। ইউটিউবে সার্চ দিলে সেই গোল হজমের ভিডিওটি দেখে নিতে পারেন আগ্রহী পাঠকেরা। প্রয়াত মোনেম মুন্না আপাত নিরীহ এক বলে হেড করতে গিয়ে মিস হেড করে বসেন। এরপর গোলপোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসা গোলরক্ষক সাঈদ হাসান কাননের সঙ্গে কায়সার হামিদের অমার্জনীয় ভুল বোঝাবুঝি ফলশ্রুতিতে গোল। হৃদয় ভঙ্গের আরেক ইতিহাস।

দুটির উদাহরণ দিতে গিয়ে স্মৃতিপটে অনেক ম্যাচই ভেসে উঠছে। ফুটবলে আহামরি কখনোই ছিল না বাংলাদেশ। তারকা ফুটবলারদের বাড়–বাড়ন্তের যুগেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের ফলাফল ছিল হতাশাজনক। কিন্তু যে সাফ গেমস নাগালের মধ্যে ছিল বরাবর, সেই সাফ গেমস ফুটবলের সোনার পদক জিততেই বাংলাদেশের লেগে গেছে ১৫টা বছর। অনেক হা–হুতাশ, ক্ষোভ ইত্যাদি পেরিয়ে।

কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ দেশের ফুটবল নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের হাহাকার তুলে ধরেছিলেন নব্বইয়ের দশকে তাঁর এক লেখায়। ফুটবল নিয়েই লেখা। বইটার নাম ‘সকাল কাঁটা ধন্য করে।’ তিনি তাঁর এক ফুটবল–পাগল বন্ধুর কাহিনি তুলে ধরে দেশের ফুটবল নিয়ে মানুষের অনুভূতির গল্পটা বলেছিলেন তাঁর মায়ময় স্টাইলে। ১৯৯৩ সাফ গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায়। মানুষের সীমাহীন উৎসাহ। ফুটবল নিয়ে মানুষের আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশার বেলুন কীভাবে চুপসে গিয়েছিল হুমায়ূন তুলে ধরেছিলেন তাঁর লেখা। সেবার সাফ গেমসে মালদ্বীপের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র আর নেপালের কাছে ১–০ গোলে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল বাংলাদেশ। মালদ্বীপ তখন খুবই দুর্বল এক দল। মালদ্বীপের বিপক্ষে বাংলাদেশের লাখ টাকার ফুটবলাররা কেন গোল করতে পারল না, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সেই ফুটবলপাগল বন্ধুর জবানে সেই আক্ষেপের বর্ণনা দিয়েছিলেন। নেপালের বিপক্ষে হারের পর এক রিকশা চালকের কষ্টের অনুভূতি বর্ণনা করে শেষ করেন সেই লেখা। লিখেছিলেন, আজ পুরো দেশ বিষন্ন, সবার মন ভীষণ খারাপ। আমাদের ফুটবলারদের কি সেই অনুভূতি স্পর্শ করছে?

অনুভূমিত খেলোয়াড়দেরও ছুঁয়ে যায়। তাঁরাও কষ্ট পান। ৯ অক্টোবর রাতে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে হংকং চায়না যখন ১০০তম মিনিটে স্কোরলাইন ৪–৩ করে ফেলল, তখন বাংলাদেশের ফুটবলারদের চেহারাগুলো দেখেছেন? হামজা চৌধুরী যেন উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছিলেন না। ফাহমিদুল মাঠেই শুয়ে কাঁদছিলেন। যাঁর গোলে বাংলাদেশ ৩–৩ করল, সেই শমিত সোম হতভম্ব এক চেহারা নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন শমিত সোম। হুমায়ূন আজ বেঁচে নেই। তিনি থাকলে কি আরেকটা লেখা লিখতেন? ৯ অক্টোবরের হৃদয়ভঙ্গকে তিনি কীভাবে দেখতেন?

হংকং চায়নার বিপক্ষে ম্যাচের পর সবাই কোচ হাভিয়ের কাবরেরার দিকে আঙ্গুল তুলছে। তাঁর দল সিলেকশনের সমালোচনা করছে। কোনো কোনো খেলোয়াড়ের ভুল তুলে ধরছেন। কিন্তু দেশের ফুটবল যে প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে, বা অতীতে গেছে, তাতে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা, ফুটবল মাঠে বাংলাদেশের সঙ্গে নেতিবাচক, যা–ই ঘটে, সেটার জন্য দায়ী সেটিই। এখন হামজা চৌধুরী, শমিত সোম, ফাহমিদুল ইসলাম, কিউবা মিচেল, জায়ান আহমেদ, শেখ মোরছালিন, রাকিব হোসেনদের মতো ফুটবলারদের জন্য ফুটবলের বাইরের মোড়কটাকে গ্ল্যামারাস মনে হলেও মোড়কের নিচে বাকি ফুটবলটা কিন্তু বড় বেশি দীনহীন, বড় দরিদ্র। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্থানীয় ফুটবলাররা গড়ে ওঠেন, তাতে সোহেল রানা জুনিয়র, সাদউদ্দিন মাঠে যে ভুলগুলো করেন, সেগুলো খুবই স্বাভাবিক। তাদের ফুটবলার হয়ে ওঠা, ফুটবল শেখ থেকে শুরু করে বয়সভিত্তিক ফুটবল পেরিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসার প্রক্রিয়াটা যে ময়লা, কাদা, আবর্জনায় ভরা।

Hamza

আমাদের ফুটবল নিয়ে আগ্রহটা শুধুই জাতীয় দল–কেন্দ্রিক। বাকি ফুটবল দুনিয়ার চিত্র কিন্তু এমনটা নয়। ফুটবল ক্লাব কেন্দ্রিক খেলা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলের অবস্থাটা কি কেউ খবর রাখেন? বাফুফে নিজেরাই কি ক্লাব ফুটবল ও এর মান উন্নয়নের আগ্রহী। আমার অন্তত, তা মনে হয় না। বাংলাদেশ ফুটবল লিগের (বিএফএল) নামে যে জিনিস হয়, সেটিকে পাড়ার ফুটবলের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। ক্লাবগুলো দল গঠন করে কোটি কোটি টাকা খরচ করে, কিন্তু এই লিগের মেকওভার নিয়ে কারও কোনো ভাবনা নেই। সারা বিশ্বের ফুটবল ক্লাবগুলো খেলোয়াড় স্কাউটিং করে তাদের তুলে নিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের ক্লাবগুলোর তা নিয়ে কোনো ভাবনাই নেই। কিছু বললেই তারা বলে অর্থ সংকটের কথা। বেশিরভাগ ক্লাবের তো অনুশীলন করার মাঠই নেই। এ যুগে এসব ভাবা যায়! আচ্ছা, ৯ অক্টোবর বাংলাদেশের জার্সি পরে যারা স্টেডিয়ামে হংকং চায়নার বিপক্ষে ম্যাচটা দেখতে গিয়েছিলেন, তারা কি আদৌ চলমান লিগের খবর রাখেন। মাঠে গিয়ে দেখা বাদ দিন, কেউ কি টেলিভিশনের পর্দায় বা স্ট্রিমিংয়ে চোখ রাখেন। কী ধরনের মাঠে খেলা হয়, কী ধরনের স্টেডিয়াম ব্যবহার করা হয়। আমাদের ফুটবলপ্রেমীদের এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। দেশের ফুটবলের সিস্টেম যদি পোকায় খাওয়া কিংবা অগোছালো, অপরিস্কার হয়, তাহলে জাতীয় দল হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক ফুটবলে ম্যাচের পর ম্যাচে সবাইকে আনন্দ দেবে, এমনটা ভাবা খুবই অন্যায়। আমরা আগে দেশের ফুটবলের প্রক্রিয়াটাকে ঠিক করি, অন্তত একটা পর্যায়ে নিয়ে আসি। সেটি আনা খুব কঠিন নয়। দর্শকের আগ্রহ, ভালোবাসাটা তো আছেই। যে দেশের জনসংখ্যা ২০ কোটি, সে দেশের ফুটবল সুন্দর একটা ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে না, সেটি হতে পারে না।

আমরা চাই ফুটবল আনন্দ–উৎসব আর উদ্‌যাপনের প্রতীক হয়ে উঠুক। হৃদয়ভঙ্গের নয়।

সম্পর্কিত