১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

বাঙালির মুক্ত স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন পূরণের দিন

বাঙালির মুক্ত স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন পূরণের দিন
বিকেল ৪ টা ৩১ মিনিটে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রের সামনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। ছবি: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

ভারতীয় সেনা বাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি মধ্যরাত থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বিমান হামলা বন্ধ রাখে। তবে ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনী আর্টিলারি ইউনিটগুলো ঢাকা শহরের সামরিক অবস্থানে সর্বাত্মক গোলাবর্ষণ চালিয়ে যায়। মিরপুর ও টঙ্গী সেতু দখল করে ভারতীয় প্যারা ট্রুপার ও পদাতিক বাহিনী ঢাকার একদম উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়।

রণাঙ্গনে আর আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ধরাশায়ী পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু লজ্জা আর অহমিকার কারণে তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণে রাজি হচ্ছিলেন না পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। এই গোলাবর্ষণ তাকে আলোচনার টেবিলে বসানোর জন্য চূড়ান্ত সামরিক চাপ তৈরি করে।

ভারতীয় সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের কাছে দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠায়। ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ-এর পক্ষ থেকে জেনারেল নিয়াজিকে জানানো হয় যে, শর্তহীন আত্মসমর্পণ করলেই বেসামরিক নাগরিক এবং সামরিক বন্দীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। চরম মানসিক চাপ নিয়েই জেনারেল নিয়াজি ঢাকার গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠক থেকে সামরিক ও কূটনৈতিক উভয় ফ্রন্টে পরাজয় নিশ্চিত হওয়ায় শর্তহীন আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।

আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী সামরিক বন্দীদের (POWs) সঙ্গে ব্যবহার এবং তাদের সম্মান রক্ষা করার শর্ত পূরণ করে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব তৈরি করেন ‘Instruments of Surrender’ বা আত্মসমর্পণ দলিল।

অবশেষে বিকেল ৪ টা ৩১ মিনিটে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রের সামনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। যেখানে লেখা ছিলো “The Pakistan Eastern Command agrees to surrender all Pakistan Armed Forces in Bangladesh to the Joint Forces Commander, Eastern Theatre (পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানের সমস্ত সশস্ত্র বাহিনী ইস্টার্ন থিয়েটারের যৌথ বাহিনী কমান্ডারের নিকট আত্মসমর্পণে সম্মত হচ্ছে)।” নিয়াজি তার কোমরের পিস্তল খুলে জেনারেল অরোরার হাতে তুলে দেন। বিশ্বের মানচিত্রে নিশ্চিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘BANGLADESH LIBERATED’। এতে বলা হয়, স্বাধীন রাষ্ট্রের আবেগে ঢাকা শহর ফেটে পড়েছে। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর জনগণ রাস্তায় নেমে আসে, যা ছিল দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের পর স্বস্তি ও মুক্তির এক বাঁধভাঙা প্রকাশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস এর শিরোনাম ছিল, ‘PAKISTANIS SURRENDER IN DACCA; INDIA ORDERS CEASE-FIRE ON WEST’। এতে বলা হয় ঢাকায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ শেষ হলো। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিম রণাঙ্গনেও একতরফা যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন, যা উপমহাদেশে দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনবে। যুদ্ধ শেষে ঢাকার সামগ্রিক চিত্রকে ভয়াবহ ‘গণহত্যা-পরবর্তী ধ্বংসযজ্ঞ’-এর জ্বলন্ত সাক্ষী হিসাবে তুলে ধরে বিদেশি গণমাধ্যমগুলো। আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলো এটিকে কেবল সামরিক যুদ্ধ হিসেবে নয়, বরং জাতিগত নির্মূল (Ethnic Cleansing) এবং পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ধ্বংস হিসেবে বর্ণনা করে। একই সঙ্গে প্রায় সব খবরেই চূড়ান্ত উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয়ের মহানায়ক পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান নিয়ে।

বিশ্ববাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করেন। ভারতের লোকসভায় ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ এখন মুক্ত, স্বাধীন।

তথ্যসূত্র:

আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত

একাত্তরের দিনপঞ্জি, সাজ্জাদ শরিফ, রাশেদুর রহমান

সম্পর্কিত