ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা—এটি জেনেই আমাদের অনেকের বেড়ে ওঠা। কিন্তু হালে খেলাটায় যা যা চলছে, ঘটছে, তাতে ক্রিকেটের সঙ্গে ভদ্রলোকের সম্পর্ক কতটা বজায় আছে, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতেই পারে। বিশেষ করে এশিয়া কাপে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচের পর সকলের মধ্যেই সন্দেহ আরও জোরদার—ক্রিকেট কি আদৌ এখন পুরোপুরি ভদ্রলোকের খেলা?
দুবাইয়ে রোববার এশিয়া কাপে ভারত–পাকিস্তানের ম্যাচটি নিয়ে শুরুর আগে অনেক আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক ছিল। এপ্রিলে কাশ্মীরের পাহেলগাঁওয়ে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটকের মৃত্যু ও সেই ঘটনার জেরে মে মাসে ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি ম্যাচটাকে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি বয়কট করার কথাও উঠেছিল ভারতে। যদিও ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত হয়েছে, পাকিস্তানকে ভারত সহজেই হারাতে পেরেছে। কিন্তু ম্যাচের পর বিতর্কটা অন্যমাত্রা পেয়েছে।
ম্যাচের আগে টসের সময় ভারতীয় অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব পাকিস্তানের অধিনায়ক আগা সালমানের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেননি। ম্যাচটা শেষ করেও সূর্যকুমার আর শিবম দুবে যা করেছেন, সেটি ছিল চোখে পড়ার মতো। জয়সূচক রান নিয়েই সূর্যকুমার সোজা হাঁটা দিলেন ড্রেসিং রুমের দিকে। পেছন পেছন দুবে। পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা চেয়ে দেখলেন, ম্যাচের পর দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে হাত মেলানোর যে চিরাচরিত রীতি, সেটিও মানল না ভারতীয় দল। এখানে শেষ হলেও কথা ছিল। হনহন করে ড্রেসিং রুমে ঢুঁকে দরাম করে দরজাও বন্ধ করে দিলেন তারা। যেন পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা তাদের পিছু ধাওয়া করেছে। ভারতীয় দলের এমন আচরণের প্রতিবাদ পাকিস্তান জানিয়েছে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান বয়কট করে। টসের সময় দুই দলের অধিনায়কের হ্যান্ডশেক না করার বিষয়টি ‘মেনে নেওয়ায়’ তাদের ক্ষোভের তির এখন ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফটের দিকে। পাকিস্তান পাইক্রফটকে সরিয়ে দেওয়ারও দাবি করেছে।
এশিয়া কাপ এমনিতেই বড় টুর্নামেন্ট। ক্রিকেটে যে কয়টি বহুজাতিক টুর্নামেন্ট আছে, সেটির অন্যতম। ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাদ দিলে ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরোনো বহুজাতিক প্রতিযোগিতাও। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) আয়োজিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। কিন্তু এই টুর্নামেন্ট বরাবরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত–পাকিস্তানের মধ্যকার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে ঘিরে। ১৯৯০ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে পাকিস্তানের অংশগ্রহণের প্রতিবাদে রাজনৈতিক দল শিবসেনার কর্মীরা পিচ খুঁড়ে রেখেছিল। পাকিস্তান সেবার ভারতে যায়–ই নি। এরপর থেকে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতে এশিয়া কাপ একাধিকবার আয়োজিত হলেও ভারত কিংবা পাকিস্তানে এশিয়া কাপ আয়োজন সেভাবে হয়নি। পাকিস্তান যেন না আসে ভারত এই আয়োজন বেশিরভাগ সময়ই এড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানে গিয়ে শুধু ২০০৮ সালেই ভারত এশিয়া কাপ খেলেছে। ২০২৩ সালে পাকিস্তানে অনেক দিন পর এশিয়া কাপ আয়োজিত হলেও সেটি হয়েছে ‘হাইব্রিড’ নামের এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে। এই হাইব্রিড পদ্ধতিতে টুর্নামেন্ট পাকিস্তানে হলেও ভারত তাদের ম্যাচগুলো খেলেছে শ্রীলঙ্কায়। এবার (২০২৫) ভারতে এশিয়া কাপ হওয়ার কথা থাকলেও ভারত সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এটি আয়োজন করেনি। পাকিস্তানও ভারতে গিয়ে এশিয়া কাপ খেলার ব্যাপারে রাজি ছিল না। ফলে এসিসির সামনে সংযুক্ত আরব আমিরাতই ছিল আয়োজক হিসেবে একমাত্র বিকল্প। কিন্তু এত কিছুর পরেও ভারত–পাকিস্তান দ্বন্দ্বের ছায়া থেকে এশিয়া কাপকে বের করা গেল না।
দুবাইয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে নাজুক কূটনৈতিক সম্পর্কের জেরে ভারত যেটি করেছে, সেটিতে ক্রিকেটীয় চেতনা, খেলোয়াড়ি মনোভাব কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এশিয়া কাপ নিয়ে ভারত সামনের দিনগুলোতেও কি কি করবে তা সামনে নিয়ে এসেছে। ফাইনালে উঠে তারা যদি শিরোপা জেতে, তাহলে এসিসির চেয়ারম্যান মহসিন নকভির হাত থেকে ট্রফি গ্রহণ না করারই সিদ্ধান্তও হয়েছে। মহসিন নকভি পাকিস্তানি, সেটি বলাই বাহুল্য। মাঠের বাইরের বিষয়গুলো মাঠে নিয়ে এসে ভারত যা যা করছে বা করবে, তাতে তারা এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ কেন করছে, প্রশ্ন উঠেছে সেটি নিয়েও। ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটে ভারতের এসব কর্মকাণ্ড ‘ভদ্রোচিত’ কিনা, সাধারণ নীতি–নৈতিকতার সঙ্গে যায় কিনা, এনিয়েও চলছে সমালোচনা।
খেলার মাঠে রাজনীতি না নিয়ে আসার একটা আপ্তবাক্য খুব প্রচলিত। তবে এশিয়া কাপে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচে যা যা ঘটেছে, সেগুলো রাজনীতিই। আপনি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবেন একটি দেশের বিরুদ্ধে, সে দেশের মাটিতে খেলবেন না, তাদের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাবেন না, সেই দেশের কারও হাত থেকে পুরস্কার নেবেন না, এসব খেলার চেতনার পুরোপুরি বিরোধী। ভারতের বিরুদ্ধে এ ধরনের সমালোচনা বহু পুরোনো। ভারতের অবশ্য তা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তারা খুব করেই বিশ্বাস করে রাজনীতি খেলার বাইরের কোনো বিষয় নয়। পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত না মেলানোর ব্যাপারটিও ব্যাখ্যাসহ বুঝিয়েছে তারা। ক্রিকেটের চাইতেও জাত্যাভিমান তাদের কাছে অনেক বড় ব্যাপার। যে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিস্থিতি, তাদের সঙ্গে সামান্যতম সৌহার্দপূর্ণ পরিস্থিতিও তারা তৈরি করতে চায় না।
রাজনীতি ও কূটনীতি ভারত ও পাকিস্তানের মতো দুই ঐতিহ্যবাহী ক্রিকেট শক্তির ক্রিকেটীয় সম্পর্কটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বরাবরই। ২০১২ সাল থেকে এই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কোনো সিরিজ হয় না। দুই দল মুখোমুখি হয় শুধু বৈশ্বিক ও বহুজাতিক প্রতিযোগিতায়। ক্রিকেটের ধ্রুপদী সংস্করণ টেস্টে এই দুই দেশ সবশেষ মুখোমুখি হয়েছে ২০০৭ সালে। এর দায়ভার যতোটা পাকিস্তানের, তারচেয়ে অনেক বেশি ভারতের। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্বিপাক্ষিক সিরিজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তাই ব্যাপারটিতে পাকিস্তানের দায় যতোটা, ভারতের তারচেয়ে অনেক বেশি। ভারত বরাবরই নানা অছিলায় পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ এড়িয়ে গেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ক্রিকেট খেলাটা তো আর ভারতের একার সম্পত্তি নয়। এর একটি বৈশ্বিক সংস্থা আছে। তারা কি করছে? আইসিসি নামের সেই সংস্থাটি এই সমস্যা সমাধানে পুরোপুরি ব্যর্থ। এই যে দুদিন আগে এশিয়া কাপে পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে ভারত রীতি ভাঙল, এতে আইসিসির কোনো হস্তক্ষেপ নেই। এমনকি পাকিস্তান ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফটের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছে, সেটিতেও আইসিসি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা পাইক্রফটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। তার মানে একটি দেশ তাদের গায়ের জোরে নিয়ম ভাঙতে পারবে, এতে আইসিসির কিছুই করার থাকবে না! এ ধরনের কোনো বিষয় ফুটবলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ফুটবলে কোনো খেলোয়াড় বা দল যদি ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিক সিদ্ধান্তে মাঠে কোনো রাজনৈতিক বিষয় তুলে ধরে, তাহলে ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা কিংবা অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা সেই খেলোয়াড় আর দলের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেই। এটা নিয়ে কোনো ছাড় নেই। প্রসঙ্গক্রমে ১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপের একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সেবার একই গ্রুপে ছিল আমেরিকা ও ইরান। দুই বৈরি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কই নেই। তবুও মাঠে দুই দল একে অন্যের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ মনোভাবই দেখিয়েছিল। ফুটবলে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব বা অন্য কোনো প্রতিযোগিতায় কোনো দেশের সাহস নেই যে তারা বলে যে আমরা অমুক দেশের মাটিতে খেলতে যাব না।
ক্রিকেটে ভারত এমনটা করতে পারে। তারা ইচ্ছে করলেই পারে। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা তাদের চোখ রাঙায় না। তারা ভারতকে শাস্তিও দেয় না। রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক বিষয়গুলো ক্রিকেট মাঠে টেনে নিয়ে এসে খেলাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত করাটাকেই ভারত পরিণত করে ফেলেছে নিয়মে। এভাবে কি তবে চলতে থাকবে ক্রিকেট? ক্রিকেট যে ভদ্রলোকের খেলা, রাজনীতির ঘেরাটোপে খেলাটিকে ফেলে ভারতই কি সেটি অস্বীকার করছে না?