আক্কু চৌধুরী

পঞ্চাশ বছরেরও আগের স্মৃতি। আমি আর আমার সহযোদ্ধা আরিফ, আমাদের প্লাটুন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে সাতক্ষীরা অভিযান শুরু করেছিলাম। স্যারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সেই ঘটনার পর অনেক বছর কেটে গেছে, সব কথা এখন পুরোপুরি মনে নেই। তবুও কিছু টুকরো মুহূর্ত ফিরে ফিরে আসে। আমার বন্ধু আরিফ হোসেন এই সময়ের ঘটনাগুলো নোট রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু যুদ্ধের ক্ষত ও বীভৎসতা আমার মনে এমনভাবে দাগ কেটেছিল যে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা আমাকে স্বপ্নের মধ্যেও তাড়া করত দীর্ঘ সময়। আমি সেই সময়ের রক্তক্ষয়ের মুহূর্তগুলোকে ভুলে গিয়ে নির্ঘুম রাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর। লেফটেন্যান্ট স্যার আমাকে, আরিফকে এবং আরও দেড়শোজনকে মহকুমা শহর সাতক্ষীরার দিকে অভিযানের প্রস্তুতি নিতে বললেন। উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয়–সব মিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। আমরা হয়তো এমন একটা সময়ের জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। আর সেই বয়সের উন্মাদনা আমাদের যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার জন্য উন্মুখ করে তুলেছিল। শত্রুপক্ষের গুলিতে যদি প্রাণও যায়- সেটাই আমাদের নিয়তি আর তার মাধ্যমে আমরা পরিশোধ করব জন্মভূমির ঋণ। এটা এমন এক অনুভূতি, যা শুধু একজন প্রকৃত যোদ্ধাই অনুভব করতে পারে।
৪ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় আমরা ১৫ মাইল পথ হেঁটে ‘ঘোনা’ নামক এক গ্রামে পৌঁছাই। ঠান্ডা রাত, কাদামাটি আর ধানক্ষেত পেরিয়ে, হাঁটুসমান পানির ভেতর দিয়ে ধীর পায়ে এগোচ্ছিলাম। মাথার ওপর দিয়ে ভারতীয় কামানের গোলা শোঁ শোঁ করে ছুটে যাচ্ছিল। অস্ত্র, গুলির বাক্স, ভারতীয় সেনাবাহিনীর দেওয়া সোয়েটার ও কম্বল–সব কিছু নিয়ে এগোতে হচ্ছিল আমাদের। পানির নিচের কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের কারণে হাঁটার সময় ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হচ্ছিল, তবু আমরা অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছিলাম।
ঘোনা ছিল সাতক্ষীরা থেকে সাত মাইল দূরে। চার ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা সেখানে ক্যাম্প করি। আক্রমণের নির্দেশ আসার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। এর মধ্যে খবর আসে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, ফলে ছোট ছোট সংঘর্ষ চলতেই থাকে। অবশেষে ৭ তারিখ সকালে আমরা সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করি। আমাদের অগ্রযাত্রা ঠেকানোর জন্য পাকিস্তানিরা পিছু হটতে হটতে সেতুগুলো উড়িয়ে দিচ্ছিল।
শহরে ঢোকার আগে আমাদের কমান্ডার আহসানউল্লাহ পাকিস্তানিদের একটি জিপ দখল করে নেন। আমরা ছয়জন সেই জিপে উঠে পাকিস্তানি বাহিনীকে তাড়া করতে থাকি, যাতে তারা সংঘবদ্ধ হতে না পারে। আমাদের ওপর পাল্টা হামলা না চালাতে পারে। কিন্তু সেতু ধ্বংস করে দেওয়ায় আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। তাই আমাদের আদেশ দেওয়া হয় শহর থেকে চার মাইল উত্তরে বিনেরপোতা নামক জায়গায় অবস্থান নিতে। ভারতীয় বাহিনীর কয়েকটি ইউনিট আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় কিছুক্ষণের মধ্যে। তারপর শুরু হয় টহল, বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান। আমি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমার সেই সহযোদ্ধাদের, যাদের অনেকের নামও জানি না, যারা শুধু চেয়েছিল এক টুকরো মুক্ত ভূমি যেখানে তারা মানুষের মতো সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে।
বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছরে অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জন্য কিছু চাইনি, আমাদের স্বপ্ন ছিল এমন একটি দেশ গড়ে তোলার, যেখানে আমাদের সন্তানেরা ঔপনিবেশিক মানসিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে বেড়ে উঠবে। শুধু একটা মুক্ত ভূমি নয়, মানুষের সার্বিক মুক্তি। অনেক বড় স্বপ্ন, কিন্তু অসম্ভব নয়। কোনো একদিন আমরা অবশ্যই তা অর্জন করব।
আরিফকে ধন্যবাদ। ওর সেই নোটগুলোর জন্যই আজ এই স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারলাম।
আক্কু চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ও পর্যটন উদ্যোক্তা

পঞ্চাশ বছরেরও আগের স্মৃতি। আমি আর আমার সহযোদ্ধা আরিফ, আমাদের প্লাটুন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে সাতক্ষীরা অভিযান শুরু করেছিলাম। স্যারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সেই ঘটনার পর অনেক বছর কেটে গেছে, সব কথা এখন পুরোপুরি মনে নেই। তবুও কিছু টুকরো মুহূর্ত ফিরে ফিরে আসে। আমার বন্ধু আরিফ হোসেন এই সময়ের ঘটনাগুলো নোট রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু যুদ্ধের ক্ষত ও বীভৎসতা আমার মনে এমনভাবে দাগ কেটেছিল যে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা আমাকে স্বপ্নের মধ্যেও তাড়া করত দীর্ঘ সময়। আমি সেই সময়ের রক্তক্ষয়ের মুহূর্তগুলোকে ভুলে গিয়ে নির্ঘুম রাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর। লেফটেন্যান্ট স্যার আমাকে, আরিফকে এবং আরও দেড়শোজনকে মহকুমা শহর সাতক্ষীরার দিকে অভিযানের প্রস্তুতি নিতে বললেন। উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয়–সব মিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। আমরা হয়তো এমন একটা সময়ের জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। আর সেই বয়সের উন্মাদনা আমাদের যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার জন্য উন্মুখ করে তুলেছিল। শত্রুপক্ষের গুলিতে যদি প্রাণও যায়- সেটাই আমাদের নিয়তি আর তার মাধ্যমে আমরা পরিশোধ করব জন্মভূমির ঋণ। এটা এমন এক অনুভূতি, যা শুধু একজন প্রকৃত যোদ্ধাই অনুভব করতে পারে।
৪ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় আমরা ১৫ মাইল পথ হেঁটে ‘ঘোনা’ নামক এক গ্রামে পৌঁছাই। ঠান্ডা রাত, কাদামাটি আর ধানক্ষেত পেরিয়ে, হাঁটুসমান পানির ভেতর দিয়ে ধীর পায়ে এগোচ্ছিলাম। মাথার ওপর দিয়ে ভারতীয় কামানের গোলা শোঁ শোঁ করে ছুটে যাচ্ছিল। অস্ত্র, গুলির বাক্স, ভারতীয় সেনাবাহিনীর দেওয়া সোয়েটার ও কম্বল–সব কিছু নিয়ে এগোতে হচ্ছিল আমাদের। পানির নিচের কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের কারণে হাঁটার সময় ভারসাম্য রাখতে সমস্যা হচ্ছিল, তবু আমরা অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছিলাম।
ঘোনা ছিল সাতক্ষীরা থেকে সাত মাইল দূরে। চার ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা সেখানে ক্যাম্প করি। আক্রমণের নির্দেশ আসার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। এর মধ্যে খবর আসে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, ফলে ছোট ছোট সংঘর্ষ চলতেই থাকে। অবশেষে ৭ তারিখ সকালে আমরা সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করি। আমাদের অগ্রযাত্রা ঠেকানোর জন্য পাকিস্তানিরা পিছু হটতে হটতে সেতুগুলো উড়িয়ে দিচ্ছিল।
শহরে ঢোকার আগে আমাদের কমান্ডার আহসানউল্লাহ পাকিস্তানিদের একটি জিপ দখল করে নেন। আমরা ছয়জন সেই জিপে উঠে পাকিস্তানি বাহিনীকে তাড়া করতে থাকি, যাতে তারা সংঘবদ্ধ হতে না পারে। আমাদের ওপর পাল্টা হামলা না চালাতে পারে। কিন্তু সেতু ধ্বংস করে দেওয়ায় আমাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। তাই আমাদের আদেশ দেওয়া হয় শহর থেকে চার মাইল উত্তরে বিনেরপোতা নামক জায়গায় অবস্থান নিতে। ভারতীয় বাহিনীর কয়েকটি ইউনিট আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় কিছুক্ষণের মধ্যে। তারপর শুরু হয় টহল, বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান। আমি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আমার সেই সহযোদ্ধাদের, যাদের অনেকের নামও জানি না, যারা শুধু চেয়েছিল এক টুকরো মুক্ত ভূমি যেখানে তারা মানুষের মতো সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে।
বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছরে অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জন্য কিছু চাইনি, আমাদের স্বপ্ন ছিল এমন একটি দেশ গড়ে তোলার, যেখানে আমাদের সন্তানেরা ঔপনিবেশিক মানসিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে বেড়ে উঠবে। শুধু একটা মুক্ত ভূমি নয়, মানুষের সার্বিক মুক্তি। অনেক বড় স্বপ্ন, কিন্তু অসম্ভব নয়। কোনো একদিন আমরা অবশ্যই তা অর্জন করব।
আরিফকে ধন্যবাদ। ওর সেই নোটগুলোর জন্যই আজ এই স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারলাম।
আক্কু চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ও পর্যটন উদ্যোক্তা

‘ব্যাটল অব শিরোমণি’র শুরুটা হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারতীয় বাহিনীর মেজর মহেন্দ্র সিং ও মুক্তিবাহিনীর মেজর ওসমান গনির নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর একটা বড় কনভয় খুলনা শহর মুক্ত করতে রওনা দেয়। কিন্তু এই কনভয়ের শিরোমণি এলাকায় পৌঁছলে পাকিস্তান বাহিনী চতুর্দিক থেকে অ্যামবুশ করে। এতে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর

বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছরে অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জন্য কিছু চাইনি, আমাদের স্বপ্ন ছিল এমন একটি দেশ গড়ে তোলার, যেখানে আমাদের সন্তানেরা ঔপনিবেশিক মানসিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে বেড়ে উঠবে। শুধু একটা মুক্ত ভূমি নয়, মানুষের সার্বিক মুক্তি।