সোহরাব হাসান

কখনো কখনো জীবন্ত মানুষের চেয়ে ইটপাথরের ভবন অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেটাই যদি না হবে, তাহলে না প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর কার্যালয় আক্রমণের শিকার হবে কেন? কেন এসব ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হবে?
এই হামলা তো কেবল নিষ্প্রাণ ভবনের ওপর নয়। এসব ভবনের পেছনে যে মানুষেরা আছেন, আক্রমণটা তাদের চিন্তা ও কাজের ওপর । নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, আঘাতটা কেবল গণতন্ত্রের ওপর নয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও মানবতার ওপরও আঘাত।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ভেবেছিলাম, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান হয়েছে। ভেবেছিলাম, সাংবাদিকেরা মুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারবেন। আগের মতো নিত্য হুমকি ও হয়রানির শিকার হতে হবে না। কিন্তু গত ১৬ মাসের অভিজ্ঞতা আমাদের মোটেই আশ্বস্ত করে না। সংবাদিকদের বিরুদ্ধে গয়রহ হত্যা ও হত্যা চেষ্টা মামলা দেওয়া হয়েছে। অনেকে জেলে আছেন। কিন্তু ১৬ মাসেও মামলার তদন্ত কাজ শেষ করা হয়নি।
আওয়ামী লীগ আমলে কথায় কথায় মামলা হতো, সম্পাদক-সাংবাদিকদের দৌড়ের ওপর রাখা হতো। এখন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম অফিস আক্রমণের শিকার হচ্ছে। কারও মত পছন্দ না হলেই মব সন্ত্রাস দিয়ে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করা হচ্ছে।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির হত্যার ঘটনাটি জঘন্য অপরাধ। সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই হত্যার নিন্দা করেছে। ইনকিলাব মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে, কোনো সমস্যা হয়নি।
কিন্তু এই হত্যার ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে কেন দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হলো তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। গত বছর নভেম্বরে যখন প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অফিসের সামনে জেয়াফত হয়েছিল তখন আরও অনেকের সঙ্গে শরিফ ওসমান হাদিও প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভিন্ন মতের কারণে প্রথম আলো অফিসে হামলা করাকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। দরকার হলে আপনারা ১০টি প্রথম আলো বানান। কিন্তু প্রথম আলো অফিসে হামলা করা হবে কেন? যিনি এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন, তার সংগঠন বা অনুসারীরা পত্রিকা অফিস বা সংগীতভবন পুড়িয়ে দিতে পারেন না।
তাহলে এই নৃশংস হামলা কারা ঘটিয়েছে? তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী? যারা হাদিকে হত্যা করেছে, তাদের উদ্দেশ্য যদি দেশকে নৈরাজ্যের পথে নিয়ে যাওয়া ও নির্বাচন বন্ধ করা হয়, যারা সেই হত্যাকাণ্ডকে উপলক্ষ করে পত্রিকা অফিস ও সঙ্গীত শিক্ষা ভবনে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো বীভৎস ঘটনা ঘটালো তাদের উদ্দেশ্যও ভিন্ন কিছু নয়। দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা থাকলে তারাই লাভবান হবে, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।
সরকার ওসমান হাদির ঘাতককে ধরতে না পারলেও প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবনে হামলাকারীদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে হয়তো এর নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের নাম ও রাজনৈতিক পরিচয়ও জানা যাবে।
কিন্তু এখানে সরকারের ব্যর্থতা সীমাহীন। প্রথম আলো ভবনে আগুন দেওয়ার ঘণ্টা খানিক পর ডেইলি স্টারে আগুন দেওয়া হয়। এই এক ঘণ্টার মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। তাহলে কি প্রশাসনের মধ্যেই এমন কেউ আছেন, যারা চাননি ভবন দুটি রক্ষা পাক। এর আগে কোনো কোনো সমাবেশ থেকে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচী তচনচ করে দেওয়ার কথা বলেছেন কেউ কেউ। প্রকাশ্যে এসব ঘোষণা কারা দিয়েছেন, তাদের নাম-পরিচয়ও সরকারের অজানা নয়।
আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যখন উল্লিখিত দুই ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব এলেন, তখন সব পুড়ে ছাই। একই ঘটনা ঘটেছে ছায়ানট ও উদীচী কার্যালয়ের ক্ষেত্রে। ছায়ানট ভবনের নিচে দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যালয় নালান্দার শিশুদের যে বই খাতা ও আসবাবপত্র ছিল তাও পুড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
সংবাদমাধ্যমের মূল কাজ হলো মানুষের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেওয়া। যাপিত জীবনের প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করা। সেই বিশ্লেষণের সঙ্গে সবাই একমত হবেন এমন কথা নেই। বহু মত ও পথের মানুষের দেশে মতাদর্শিক বিরোধের নিষ্পত্তি হতে হয় আলাপ, তর্ক ও যুক্তির নিরিখে। মানুষ খুন করে কিংবা ভবন পুড়িয়ে দিয়ে নয়। যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে বহু মত থাকবে। মতাদর্শিক লড়াই থাকবে। সেই লড়াইয়ের যৌক্তিক সমাধান হলো আলোচনা, একপক্ষের অন্য পক্ষকে বোঝার মাধ্যমে। মতের সঙ্গে না মিললেই কেউ মব সন্ত্রাস করে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করতে পারেন না। কোনো সভ্য দেশে সেটা চলতে দেওয়া যায় না।
অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন যে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন ভবনে হামলার ঘটনা আগেও ঘটেছে। আইন করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সাংবাদিকদের বেকার করা হয়েছে। এসব অভিযোগ সত্য। তারপরও বলব, এভাবে পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দিয়ে লুটপাটে মত্ত হওয়া কিংবা সেই পোড়া বাড়িতে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা সাংবাদিকদের উদ্ধার করতে যাওয়া সম্পাদক-সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের হেনস্তা হওয়ার ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে অতীতে ঘটেনি।

একাত্তরের মার্চে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যার শুরুতে সংবাদ, ইত্তেফাক ও পিপলস অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর ৫৪ বছর পর পুড়ল প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অফিস। এটা কীসের আলামত? গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এক ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করে আমরা আরেক ফ্যাসিবাদের কবলে পড়েছি কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কবি ও ভাব আন্দোলনের নেতা ফরহাদ মযহার।
গত কয়েক দিনে আরও বেশ কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, যা আমাদের ব্যথিত ও বিচলিত না করে পারে না। ময়মনসিংহে ধর্মাবমাননার অভিযোগ এনে দীপু দাস নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক শ্রমিককে হত্যা করে তার লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নোয়াখালীতে দরজা বন্ধ একটি ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে একটি শিশুকে। শিশুটি ঘরের ভেতর থেকে চিৎকার করে বলেছিল, “বাবা আমি মরে যাচ্ছি, আমাকে বাঁচাও।”
এই চিৎকার কেবল ওই শিশুটির নয়, পুরো বাংলাদেশের।
এই লেখা যখন লিখছি তখনই খবর পেলাম খুলনায় এনসিপি নেতাকে গুলি করা হয়েছে, যিনি এখন চিকিৎসাধীন। হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম নাসির উদ্দিন একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করে সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনা যে বিচ্ছিন্ন নয়, এমনকি তার মৃত্যুর পর যেসব অঘটন ঘটেছে, তার কোনোটাই যে বিচ্ছিন্ন নয়, সেটা বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
সোহরাব হাসান: সম্পাদক, চরচা

কখনো কখনো জীবন্ত মানুষের চেয়ে ইটপাথরের ভবন অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেটাই যদি না হবে, তাহলে না প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর কার্যালয় আক্রমণের শিকার হবে কেন? কেন এসব ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হবে?
এই হামলা তো কেবল নিষ্প্রাণ ভবনের ওপর নয়। এসব ভবনের পেছনে যে মানুষেরা আছেন, আক্রমণটা তাদের চিন্তা ও কাজের ওপর । নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, আঘাতটা কেবল গণতন্ত্রের ওপর নয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও মানবতার ওপরও আঘাত।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ভেবেছিলাম, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান হয়েছে। ভেবেছিলাম, সাংবাদিকেরা মুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারবেন। আগের মতো নিত্য হুমকি ও হয়রানির শিকার হতে হবে না। কিন্তু গত ১৬ মাসের অভিজ্ঞতা আমাদের মোটেই আশ্বস্ত করে না। সংবাদিকদের বিরুদ্ধে গয়রহ হত্যা ও হত্যা চেষ্টা মামলা দেওয়া হয়েছে। অনেকে জেলে আছেন। কিন্তু ১৬ মাসেও মামলার তদন্ত কাজ শেষ করা হয়নি।
আওয়ামী লীগ আমলে কথায় কথায় মামলা হতো, সম্পাদক-সাংবাদিকদের দৌড়ের ওপর রাখা হতো। এখন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম অফিস আক্রমণের শিকার হচ্ছে। কারও মত পছন্দ না হলেই মব সন্ত্রাস দিয়ে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করা হচ্ছে।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির হত্যার ঘটনাটি জঘন্য অপরাধ। সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই হত্যার নিন্দা করেছে। ইনকিলাব মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে, কোনো সমস্যা হয়নি।
কিন্তু এই হত্যার ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে কেন দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র অফিস জ্বালিয়ে দেওয়া হলো তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। গত বছর নভেম্বরে যখন প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অফিসের সামনে জেয়াফত হয়েছিল তখন আরও অনেকের সঙ্গে শরিফ ওসমান হাদিও প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভিন্ন মতের কারণে প্রথম আলো অফিসে হামলা করাকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। দরকার হলে আপনারা ১০টি প্রথম আলো বানান। কিন্তু প্রথম আলো অফিসে হামলা করা হবে কেন? যিনি এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন, তার সংগঠন বা অনুসারীরা পত্রিকা অফিস বা সংগীতভবন পুড়িয়ে দিতে পারেন না।
তাহলে এই নৃশংস হামলা কারা ঘটিয়েছে? তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী? যারা হাদিকে হত্যা করেছে, তাদের উদ্দেশ্য যদি দেশকে নৈরাজ্যের পথে নিয়ে যাওয়া ও নির্বাচন বন্ধ করা হয়, যারা সেই হত্যাকাণ্ডকে উপলক্ষ করে পত্রিকা অফিস ও সঙ্গীত শিক্ষা ভবনে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো বীভৎস ঘটনা ঘটালো তাদের উদ্দেশ্যও ভিন্ন কিছু নয়। দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা থাকলে তারাই লাভবান হবে, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না।
সরকার ওসমান হাদির ঘাতককে ধরতে না পারলেও প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভবনে হামলাকারীদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে হয়তো এর নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের নাম ও রাজনৈতিক পরিচয়ও জানা যাবে।
কিন্তু এখানে সরকারের ব্যর্থতা সীমাহীন। প্রথম আলো ভবনে আগুন দেওয়ার ঘণ্টা খানিক পর ডেইলি স্টারে আগুন দেওয়া হয়। এই এক ঘণ্টার মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। তাহলে কি প্রশাসনের মধ্যেই এমন কেউ আছেন, যারা চাননি ভবন দুটি রক্ষা পাক। এর আগে কোনো কোনো সমাবেশ থেকে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচী তচনচ করে দেওয়ার কথা বলেছেন কেউ কেউ। প্রকাশ্যে এসব ঘোষণা কারা দিয়েছেন, তাদের নাম-পরিচয়ও সরকারের অজানা নয়।
আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যখন উল্লিখিত দুই ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব এলেন, তখন সব পুড়ে ছাই। একই ঘটনা ঘটেছে ছায়ানট ও উদীচী কার্যালয়ের ক্ষেত্রে। ছায়ানট ভবনের নিচে দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যালয় নালান্দার শিশুদের যে বই খাতা ও আসবাবপত্র ছিল তাও পুড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
সংবাদমাধ্যমের মূল কাজ হলো মানুষের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেওয়া। যাপিত জীবনের প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করা। সেই বিশ্লেষণের সঙ্গে সবাই একমত হবেন এমন কথা নেই। বহু মত ও পথের মানুষের দেশে মতাদর্শিক বিরোধের নিষ্পত্তি হতে হয় আলাপ, তর্ক ও যুক্তির নিরিখে। মানুষ খুন করে কিংবা ভবন পুড়িয়ে দিয়ে নয়। যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে বহু মত থাকবে। মতাদর্শিক লড়াই থাকবে। সেই লড়াইয়ের যৌক্তিক সমাধান হলো আলোচনা, একপক্ষের অন্য পক্ষকে বোঝার মাধ্যমে। মতের সঙ্গে না মিললেই কেউ মব সন্ত্রাস করে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করতে পারেন না। কোনো সভ্য দেশে সেটা চলতে দেওয়া যায় না।
অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন যে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন ভবনে হামলার ঘটনা আগেও ঘটেছে। আইন করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সাংবাদিকদের বেকার করা হয়েছে। এসব অভিযোগ সত্য। তারপরও বলব, এভাবে পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দিয়ে লুটপাটে মত্ত হওয়া কিংবা সেই পোড়া বাড়িতে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা সাংবাদিকদের উদ্ধার করতে যাওয়া সম্পাদক-সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের হেনস্তা হওয়ার ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে অতীতে ঘটেনি।

একাত্তরের মার্চে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যার শুরুতে সংবাদ, ইত্তেফাক ও পিপলস অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর ৫৪ বছর পর পুড়ল প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অফিস। এটা কীসের আলামত? গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এক ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করে আমরা আরেক ফ্যাসিবাদের কবলে পড়েছি কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কবি ও ভাব আন্দোলনের নেতা ফরহাদ মযহার।
গত কয়েক দিনে আরও বেশ কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, যা আমাদের ব্যথিত ও বিচলিত না করে পারে না। ময়মনসিংহে ধর্মাবমাননার অভিযোগ এনে দীপু দাস নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক শ্রমিককে হত্যা করে তার লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নোয়াখালীতে দরজা বন্ধ একটি ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে একটি শিশুকে। শিশুটি ঘরের ভেতর থেকে চিৎকার করে বলেছিল, “বাবা আমি মরে যাচ্ছি, আমাকে বাঁচাও।”
এই চিৎকার কেবল ওই শিশুটির নয়, পুরো বাংলাদেশের।
এই লেখা যখন লিখছি তখনই খবর পেলাম খুলনায় এনসিপি নেতাকে গুলি করা হয়েছে, যিনি এখন চিকিৎসাধীন। হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম নাসির উদ্দিন একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করে সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনা যে বিচ্ছিন্ন নয়, এমনকি তার মৃত্যুর পর যেসব অঘটন ঘটেছে, তার কোনোটাই যে বিচ্ছিন্ন নয়, সেটা বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
সোহরাব হাসান: সম্পাদক, চরচা

সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতাও আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথ নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকার কি এই সংকটকালীন

সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অনেকটাই থমকে গেছে। সেইসঙ্গে ক্রমাগত অর্থপাচার দেশের আর্থিক খাতে ব্যাপক চাপ তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে- শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক আর্থিক খাত ছাড়া কি বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে পারবে?