শাপলা আদায়ে কোন পথে হাঁটবে এনসিপি

তাসীন মল্লিক
তাসীন মল্লিক
শাপলা আদায়ে কোন পথে হাঁটবে এনসিপি
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) লোগো

রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নিবন্ধন পাওয়া নিশ্চিত। তবে দলটির কাঙ্ক্ষিত প্রতীক ‘শাপলা’ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। শাপলা না পেলে আন্দোলনের মাধ্যমে তা আদায়ের যে হুশিয়ারি দিয়েছিল দলটি, তা কানে তোলেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

প্রতীক নির্ধারণে সম্প্রতি এনসিপিকে চিঠি পাঠিয়ে ৭ অক্টোবরের মধ্যে তফসিলভুক্ত ৫০টি প্রতীক থেকে যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইসি।

এনসিপির অবস্থান স্পষ্ট যে তারা ‘শাপলা’কে দলীয় প্রতীক হিসেবেই দেখতে চায়। প্রতীক ইস্যুতে এনসিপির অবস্থান নিয়ে দলটির নেতারা বলছেন, তারা আন্দোলনের পথেই হাঁটবেন।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, বিষয়টির সমাধান আদালতের মাধ্যমে হওয়া উচিত। আবার কেউ বলছেন, রাজনীতির বিষয় আদালতে টানা ঠিক হবে না।

দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদিন শিশির চরচাকে বলেন, ‘‘শাপলা প্রতীকটি জনগণ ভাবে গ্রহণ করেছে। এটি পেতে কোনো আইনি বাধাও নেই। শাপলা না দিলে প্রমাণ হবে যে ইসি পক্ষপাতদুষ্ট।’’

নির্বাচন কমিশন ভোটের মার্কা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে ‘শাপলা’ বাদ দিয়ে। এনসিপিকে কেন শাপলা প্রতীক দেওয়া হবে না—এ বিষয়ে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন।

‘শিগগিরই’ কর্মসূচি

নিবন্ধন পাওয়া নতুন দল হিসেবে এনসিপি রাজনৈতিক মাঠে নিজেদের জায়গা তৈরি করতে চাইছে। প্রতীক না পেলে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হলেও কর্মসূচি ঘোষণার ক্ষেত্রে কিছুটা সতর্ক অবস্থান নেওয়ার কথা বলছে দলটির নেতারা।

এনসিপির নেতারা জানিয়েছেন, ইসির চিঠির জবাবে দলের পক্ষ থেকে একটি চিঠি পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হবে যে প্রতীক হিসেবে শাপলা পেতে কোনো আইনি এবং রাজনৈতিক বাধা নেই। চিঠি পাঠানোর পর ইসির পরবর্তী পদক্ষেপ অনুযায়ী মাঠের কর্মসূচি নির্ধারণ করবে দলটি। গত ৩ অক্টোবর ফেসবুকে এনসিপির নেতারা দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নামে একটি ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করেন। যাতে ‘শাপলা’ নিয়ে দলটির যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।

এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিকুস সালেহীন চরচাকে বলেন, ‘‘আমরা শাপলা প্রতীকের দাবি থেকে সরছি না। ইসি শাপলা প্রতীক না দিলে অবশ্যই মাঠের কর্মসূচিতে যাব।’’

এনসিপি নেতা সারজিস আলম গত ২৩ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে লেখেন, শাপলা না পেলে ‘নির্বাচন প্রতিহতের’ ঘোষণা দেন।

প্রতীকের জন্য লড়াই

গত ১০ মার্চ নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর নাগরিক ঐক্য ইসির নিবন্ধন পায় এবং তাদের দলীয় প্রতীক হয় কেটলি এরপর ওই বছরের ১৭ জুন প্রতীক পরিবর্তনের জন্য ইসিতে আবেদন করে তারা, যেখানে বিকল্প প্রতীক হিসেবে শাপলা বা দোয়েল পাখির দাবি জানানো হয়।

ইসির বিজ্ঞপ্তির পর ২২ জুন নিবন্ধনের আবেদনের সঙ্গে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা, কলম ও মোবাইল প্রতীক চায় এনসিপি। পরে ৩ আগস্ট ইসি সচিব বরাবর আরেক আবেদনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পছন্দের প্রতীকে সংশোধনী এনে শাপলা, সাদা শাপলা ও লাল শাপলা চান।

এ নিয়ে প্রথমে আইনি বাধার কথা জানায় ইসি। কিন্তু এনসিপির পক্ষ থেকে পাল্টা যুক্তি আসে যে প্রতীক পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা নেই এবং বিষয়টি ইসির আইন বিভাগকেও বোঝানো হয়েছে। তবুও কমিশন রাজনৈতিক বাধার কথা বলে।

এরপর নাগরিক ঐক্য আগে থেকেই শাপলা প্রতীক চেয়েছে জানিয়ে এনসিপির আবেদন খারিজ করে ইসি। সংস্থাটির যুক্তি—প্রতীক দিতে হলে আগে নাগরিক ঐক্যকেই দিতে হবে।

সমাধানের খোঁজ আইনি পথ এড়িয়ে

সংবিধানে জাতীয় সংগীত, পতাকা ও প্রতীক অনুচ্ছেদে (৪) রয়েছে শাপলার স্পষ্ট অবস্থান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইসহ একাধিক সরকারি সংস্থার লোগোতেও রয়েছে শাপলার উপস্থিতি। শাপলা প্রতীক না দেওয়ার এসব বিষয় উল্লেখ করে আইনি যুক্তি তুলে ধরেছিল ইসি।

তবে এনসিপির পক্ষ থেকে এসব যুক্তি খণ্ডন করা হয়। এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল আলম মুসা চরচাকে বলেন, ‘‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি যে শাপলা ভোটের প্রতীক হিসেবে ব্যবহারে কোনো আইনি বাধা নাই। শাপলা হচ্ছে জাতীয় প্রতীকের চারটি আলাদা স্বতন্ত্র উপাদানের একটি।’’

প্রতীক পেতে এনসিপি কোনো আইনি পদক্ষেপ নেবে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজেও একজন আইনজীবী। তারপরও আমাদের বক্তব্য হলো, এই জিনিসগুলো রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। এখানে আদালতকে টেনে আনা উচিত না। রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। কারণ, ইসিকে তার জবাবদিহির জায়গা স্পষ্ট করতে হবে। তার নিরপেক্ষতা জনগণের কাছে প্রমাণ করতে হবে, যে কোনো দলের কথায় চলে না, ডিজিএফআইয়ের কথায় চলে না।”

প্রতীক নিয়ে নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসারও চেষ্টা করেছিল এনসিপি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ অক্টোবর ফেসবুকে দলটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না লেখেন, ইসি যদি এনসিপিকে ‘শাপলা’ প্রতীক দেয়, তিনি কোনো মামলা করবেন না। মান্না আরও লেখেন, শাপলা প্রতীক নিলে তিনি আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেবেন না। তবে যেহেতু প্রতীক তারা আগে দাবি করেছেন, তাই প্রতীক অন্য কেউ পেলে ইসির সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে দায়ী করবে তার দল।

আদালতে মীমাংসার প্রশ্নে ভিন্নমত বিশেষজ্ঞদের

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আলীম চরচাকে বলেন, ‘‘প্রতীক নিয়ে নির্বাচন কমিশন এবং এনসিপি উভয়ই নিজেদের যুক্তি উত্থাপন করেছেন। এখন সবচেয়ে হয়, বিষয়টি আদালতে মীমাংসা করা। এনসিপির উচিত হবে বিষয়টি আদালতে নিয়ে যাওয়া।”

তবে বিষয়টি আদালতে নেওয়ার বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবি ব্যারিষ্টার ওমর ফারুক। তিনি বিষয়টি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষেই মত দিয়েছেন। চরচাকে তিনি বলেন, ‘‘আইনের ভাষায় একটা বিষয় আছে ব্যালেন্স অব কনভিনিয়েন্স ইনকনভিনিয়েন্স– আপনি চিন্তা করবেন এটা দিলে কী জনমতের খুব বেশি রিপারকেশন হবে কি না, বা খুব বেশি আইনের ব্যত্যয় হবে কি না। আবার না দিলেও কি খুব বেশি ব্যত্যয় হবে? তার (এনসিপির) প্রতি জুলুম হবে কিনা। তবে এটিকে আদালতে আনা উচিত না বলেই মনে করি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো আদালতে না আনাই ভালো। অতীতে এতে খারাপ রেজাল্ট হয়েছে।”

নিবন্ধন ও প্রতীকের ইতিহাস

২০০৮ সালে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আইন করার আগে প্রার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় প্রতীক বরাদ্দ দিত ইসি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনের জন্য আলাদা প্রতীক নির্ধারণ করে বিধি সংশোধন করে ইসি।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর সংসদ নির্বাচনের জন্য মোট ১১৫টি প্রতীক নিবন্ধিত দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দ করে বিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি। এর আগে নির্ধারিত প্রতীক ছিল ৬৯টি।

বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে ৫৬টি। অর্থাৎ, যেকোনো নির্বাচনে এসব দলগুলোর প্রতীক অপরিবর্তিত। এর বাইরের সংসদ নির্বাচনের ৫৯টি প্রতীক স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য বরাদ্দ। একইভাবে ইউপি চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য ১০টি, উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ১৩টি, পৌরসভার মেয়র পদে ১২টি, সিটি মেয়র পদে ১২টি এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদের জন্য ১২টি প্রতীক বরাদ্দ রয়েছে।

বিধি প্রণয়নের আগে প্রতীক বরাদ্দের ক্ষেত্রে কমিশন বৈঠকে নীতি নির্ধারণ করত ইসি। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফের নেতৃত্বে ইসি পাঁচটি মূলনীতি অনুসরণ করেছিল। এর মধ্যে ছিল—১৯৭৯ সালের পর যেসব দল একটি নির্দিষ্ট প্রতীক পেয়েছে, তা যথাসম্ভব বজায় রাখা; রাজনৈতিক দলের সদস্য সংখ্যা, পূর্ববর্তী নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতীক বরাদ্দ; নির্দিষ্ট প্রতীকের জন্য একক আবেদনকারী থাকলে সেটি তার অনুকূলে রাখা; একই প্রতীকের জন্য একাধিক দাবি থাকলে সমঝোতার চেষ্টা, ব্যর্থ হলে শুনানি বা লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ এবং একাধিক পছন্দ থাকলে তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা।

সম্পর্কিত