নাইর ইকবাল

বাবা রাষ্ট্রপতি থাকার সময় প্রথমবার কোনো টেলিভিশন প্রোগ্রামে আসা স্কুলপড়ুয়া যে ছেলেটিকে দেখে মনে হয়েছিল লাজুক, যাকে পরে বাবার কফিনের পাশে অঝোরে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল, সেই তারেক রহমানই এখন বাবার প্রতিষ্ঠিত সেই রাজনৈতিক দলের কাণ্ডারি। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির নেতা–কর্মীদের প্রত্যাশা পূরণ করে তিনি দেশে ফিরছেন অবশেষে। লাজুক সেই ছেলেটি কী করে আজকের কাণ্ডারি হয়ে উঠলেন–একটু দেখে নেওয়া যাক।
এ জন্য পেছনে ফিরতে হবে অনেকটা। জিয়াউর রহমান তখন দেশের রাষ্ট্রপতি। বলা যায় দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তিনি যখন রাষ্ট্রপতি, তখন জনসম্মুখে তার পরিবারের কোনো সদস্যকে খুব একটা দেখা যেত না। সবাই জানত, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে তার সংসার। কিন্তু কেন যেন রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে তার পরিবারের কাউকে আনতেন না। এমনকি টেলিভিশনে পরিবারের সদস্যদের না দেখানোর ব্যাপারে তার স্পষ্ট নির্দেশ ছিল। শুধু খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে জিয়াউর রহমানের সঙ্গী হতেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী বিদ্রোহী কর্মকর্তার অভিযানে নৃশংসভাবে নিহত হন। জিয়ার শাসনামলের শেষ দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় এক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’–এ উপস্থাপক প্রয়াত ফজলে লোহানী প্রথমবারের মতো নিয়ে আসেন জিয়া পরিবারকে। তখনই দেশের মানুষ প্রথম দেখতে পান জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে। তারেক তখন স্কুলে পড়ে, আরাফাত আরও ছোট। লাজুক ধরনের দুটি ছেলে, ব্যস্ত বাবার অবর্তমানে মা খালেদা জিয়াই যাদের যেকোনো আবদার মেটানোর জায়গা। বাবার মৃত্যুর পর টেলিভিশনে আবারও দেখা যায় তারেক আর আরাফাতকে। তখন তারা বাবার কফিনের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছে।
জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বড় সন্তান তারেক। জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। পড়াশোনা ঢাকার কয়েকটি অভিজাত স্কুলে। অভিজাত বলতে, ষাট ও সত্তরের দশকে ঢাকার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সন্তানদের যেসব স্কুলে পড়াতে চাইতেন—সেসব স্কুলই। প্রথমে বিএএফ শাহীন স্কুল, সেন্ট জোসেফ স্কুল ও রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ। রেসিডেন্সিয়াল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। সেখান থেকেই ১৯৮৮ সালে তিনি অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রি।
জিয়ার মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তিনিই ছিলেন স্বামীর রাজনৈতিক উত্তরসূরি। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি বিএনপিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতায়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তাকেও রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ করেছিল।
মায়ের ছায়াতলেই রাজনীতিতে প্রবেশ বড় ছেলে তারেক রহমানের। আশির দশকে বিএনপির কর্মসূচিতে তারেককে দেখা গেছে খালেদা জিয়ার সঙ্গেই। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারেক বিএনপির প্রচারে ছিলেন খালেদা জিয়ার পাশেই। তিনি নিজেও আলাদাভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচারে গেছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছেলে হিসেবে। নব্বই দশকের শুরুতেই বিএনপির বগুড়া জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন তারেক রহমান।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। জিয়াউর রহমান–পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপির প্রথম অধ্যায়ে তারেক রহমান ছিলেন নেপথ্যেই। সেভাবে প্রকাশ্যে দেখা যেত না তাকে। তবে ওই সময় শোনা যায়, তিনি ব্যবসায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ব্যবসা–বাণিজ্য আর টুকটাক জনসংযোগ—এভাবেই ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল কেটেছে তারেকের।
তারেক রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় হন মূলত বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকার সময়ই। ১৯৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে চলে যায় নির্বাচনে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও। বিরোধী দল বিএনপিকে সাংগঠনিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করার কাজ করতে থাকেন তারেক। ২০০১ সালের নির্বাচনে তারেক ছিলেন বিএনপির নির্বাচনী প্রচারের পেছনের মস্তিষ্ক। তার পরিকল্পনাতেই প্রথমবারের মতো স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিএনপি নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে চমকে দেয় সবাইকে। ২০০১ সালের নির্বাচনে ১৯৩ আসনে জিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা আসে। তারেক হয়ে যান বিএনপির নতুন প্রজন্মের মুখ। তিনি যে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন, দেশের মানুষ বুঝে যায় তখনই।

২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলে তারেক ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। ২০০২ সালে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি তাকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়। এর পর থেকে বিএনপির রাজনীতিতে তারেক হয়ে যান ক্ষমতাধর। তবে এর সঙ্গে তাকে নিয়ে সমালোচনারও জন্ম হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের বাইরে তারেক নিজস্ব একটি রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসতেন। যেটি একপর্যায়ে হয়ে ওঠে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র।
তারেক রহমান সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হয়ে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার ব্যাপক উদ্যোগ নেন। তিনি দেশব্যাপী তৃণমূল নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে শুরু করেন গণসংযোগ। বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ব্যাপক হারে। এসব মতবিনিময়, আলোচনা ও সভার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা বাড়ে, নিজের নেতৃত্বও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এসব কর্মসূচিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলের ইমেজের বাইরে নিজেকে বের করে এনে বিএনপির একজন সক্রিয় নেতার ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ওই সময়টায় দক্ষ সংগঠক হিসেবেও নিজেকে সামনে নিয়ে আসেন।
এত কিছুর পরও সমালোচনা তারেক রহমানের পিছু ছাড়েনি। বিরোধী পক্ষ আওয়ামী লীগ সব সময়ই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনেছে। তারেক বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হলেও সেই পদ তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি প্রধানের ছেলে হিসেবেই পেয়েছিলেন বলে সমালোচনামূখর ছিলেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সমালোচনাটা ছিল, বিএনপির সাধারণ একজন নেতা হিসেবে সাংগঠনিক দক্ষতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে তো আর তারেক এই পদ পাননি। এর পাশাপাশি বিএনপির অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দকে এড়িয়ে চলা, কিংবা তাদের অবজ্ঞা করার একটা অভিযোগ ছিল তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। তিনি বিএনপিতে তরুণ নেতাকর্মীদের নিয়ে নিজস্ব প্রভাব–বলয় তৈরি করেছেন বলেও বিতর্ক ছিল। তবে এসব অভিযোগ বা সমালোচনার পক্ষে দৃশ্যমান কোনো প্রমাণ স্বাভাবিকভাবেই কখনো সামনে আনা যায়নি।
তবে তারেকের দিক দিয়ে নিজেকে বিএনপির রাজনীতিতে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টার কোনো অভাব ছিল না। তিনি দলের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। সারা দেশ সফর করেছেন। গ্রামে–গঞ্জে হেঁটেছেন। সাধারণ নেতা–কর্মীদের চাওয়া–পাওয়ার খোঁজ খবর নিয়েছেন। তাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু যত দিন গেছে বিএনপিতে তারেকের অবস্থান মজবুতই হয়েছে। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়ার পর তারেকই হয়ে ওঠেন বিএনপির কাল্ট। বিএনপির রাজনীতির মুখ।
তবে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের একটি জনসভায় সে সময়ের বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। অল্পের জন্য হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই ঘটনায় নিহত হন ২৩ জন আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী। আহত হন অগণিত। এই হামলায় তারেক রহমান জড়িত বলে সরাসরি অভিযোগ আনা হয় আওয়ামী লীগের দিক থেকে। বিএনপি সরকারের কিছু পদক্ষেপে সে সময় সাধারণ মানুষের মধ্যেও একই ধরনের ধারণার জন্ম হয়। বিএনপি সেই সময় আওয়ামী লীগের সেই অভিযোগের বিপরীতে শক্ত কোনো বক্তব্য হাজির করতে পারেনি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তারেকের রাজনৈতিক জীবনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় ঠিকমতো প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই।
২০০৬ সালে বিএনপির শাসনক্ষমতার কাল শেষ হয়। তবে দেশে তৈরি হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিএনপি নিয়ে সেই সংকট এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যে, দেশে সেনা হস্তক্ষেপ হয় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। দেশে আসে একটি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিএনপির ওপর নেমে আসে খড়্গ। একই সঙ্গে তারেক রহমানের ওপর। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একের পর এক দুর্নীতি মামলা। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেককে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ছিল ১৩টি।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তারেক রহমানের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। সেই সময় তারেক রহমানকে প্রায়ই প্রিজন ভ্যানের বদলে অ্যাম্বুলেন্সে করে আদালতে আনা হতো। তাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে এজলাসে তোলা হতো। তার চেহারায় থাকত নির্যাতিত হওয়ার অভিব্যক্তি। এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন জিয়া–খালেদার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। ২০০৭–এর মার্চ থেকে ২০০৮–এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কারাবন্দী ছিলেন তারেক রহমান। তাকে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। যদিও রাজনৈতিক মহলে প্রচারণা ছিল তারেক লন্ডনে নির্বাসিত জীবন বেছে নিয়েছিলেন, তিনি আর কখনো রাজনীতি করবেন না—এমন মুচলেকা দিয়ে।
২০০৮ থেকে তারেকের নির্বাসিত জীবনের শুরু। এ সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসেছে অনেক চড়াই–উৎরাই। ২০০৮–এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। সেই আওয়ামী লীগ এরপর নানা কৌশলে একপেশে ও কারচুপির নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকেছে পরের ১৫ বছর। পুরো সময়টাই ছিল বিএনপির বড় দুঃসময়। তারেক রহমান দেশে নেই। খালেদা জিয়াকেও মামলায় মামলায় জর্জরিত করা হয়। ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ স্ট্রাস্টের এক মামলায় কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। প্রায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে বিএনপি। তারেক যদিও ভার্চুয়ালি লন্ডন থেকেই দলের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। কিন্তু দেশে সশরীরে থাকা আর বিদেশ থেকে দল পরিচালনার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। যদিও এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারেক কিন্তু দলের হাল ধরে রেখেছিলেন দৃঢ়তার সঙ্গেই। আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিকে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বিএনপির নেতাকর্মীরা তারেক রহমানকে বেশি করেই দলীয় কার্যক্রমে অনুভব করেছে।
নির্বাসিত জীবনের শুরুর দিকেই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন তারেক। ২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিলে তাকে এই পদ দেওয়া হয়। তিনি ভার্চুয়ালি কাউন্সিলে যোগ দেন এবং বক্তৃতা রাখেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাবন্দী থাকা অবস্থায় নিজের ওপর নির্যাতনের আবেগময় বর্ণনা দিয়েছিলেন সেই বক্তৃতায়।

খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে কারাবন্দী হওয়ার পর তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বা নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে তারেকই হয়ে ওঠেন বিএনপির মূল নেতা। আওয়ামী লীগের সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা যখন হামলা–মামলায় জর্জরিত, নির্যাতনের শিকার, তখন লন্ডনে বসেও তারেক খোঁজখবর নিতেন নেতাকর্মীদের। তিনিই ছিলেন তাদের আশা–ভরসার জায়গা।
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের। দীর্ঘ নির্বাসনের পর তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথ তৈরি হয়। কিন্তু তিনি তখন ফেরেননি। যদিও প্রত্যাশা ছিল তিনি দ্রুত ফিরবেন। বিএনপিকে নেতৃত্ব দেবেন মাঠে থেকে। তবে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তবে এর পেছনে যে নানা হিসাব–নিকাশ থাকতে পারে, সে ব্যাপারে ধারণা ছিল সাধারণ মানুষের। সবশেষ খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার মধ্যে তার ফেরার ব্যাপারটি আলোচিত হলেও তারেক নিজেই বলেছেন, মায়ের অসুস্থ অবস্থায় পাশে থাকতে চাইলেও দেশে ফেরার ব্যাপারটি পুরোপুরি তার হাতে নেই। এই স্বীকারোক্তি মানুষের জন্য কিছুটা ধাক্কা হয়ে এলেও তাতে তারা অবাক হয়নি।
অবশেষে তারেক রহমান ফিরছেন। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে তিনি বিএনপির রাজনীতিকে কোন উচ্চতায় নিতে পারেন, সেটিই দেখার অপেক্ষায় সবাই।

বাবা রাষ্ট্রপতি থাকার সময় প্রথমবার কোনো টেলিভিশন প্রোগ্রামে আসা স্কুলপড়ুয়া যে ছেলেটিকে দেখে মনে হয়েছিল লাজুক, যাকে পরে বাবার কফিনের পাশে অঝোরে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল, সেই তারেক রহমানই এখন বাবার প্রতিষ্ঠিত সেই রাজনৈতিক দলের কাণ্ডারি। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির নেতা–কর্মীদের প্রত্যাশা পূরণ করে তিনি দেশে ফিরছেন অবশেষে। লাজুক সেই ছেলেটি কী করে আজকের কাণ্ডারি হয়ে উঠলেন–একটু দেখে নেওয়া যাক।
এ জন্য পেছনে ফিরতে হবে অনেকটা। জিয়াউর রহমান তখন দেশের রাষ্ট্রপতি। বলা যায় দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তিনি যখন রাষ্ট্রপতি, তখন জনসম্মুখে তার পরিবারের কোনো সদস্যকে খুব একটা দেখা যেত না। সবাই জানত, স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে তার সংসার। কিন্তু কেন যেন রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে তার পরিবারের কাউকে আনতেন না। এমনকি টেলিভিশনে পরিবারের সদস্যদের না দেখানোর ব্যাপারে তার স্পষ্ট নির্দেশ ছিল। শুধু খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে জিয়াউর রহমানের সঙ্গী হতেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী বিদ্রোহী কর্মকর্তার অভিযানে নৃশংসভাবে নিহত হন। জিয়ার শাসনামলের শেষ দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় এক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’–এ উপস্থাপক প্রয়াত ফজলে লোহানী প্রথমবারের মতো নিয়ে আসেন জিয়া পরিবারকে। তখনই দেশের মানুষ প্রথম দেখতে পান জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে। তারেক তখন স্কুলে পড়ে, আরাফাত আরও ছোট। লাজুক ধরনের দুটি ছেলে, ব্যস্ত বাবার অবর্তমানে মা খালেদা জিয়াই যাদের যেকোনো আবদার মেটানোর জায়গা। বাবার মৃত্যুর পর টেলিভিশনে আবারও দেখা যায় তারেক আর আরাফাতকে। তখন তারা বাবার কফিনের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছে।
জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বড় সন্তান তারেক। জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। পড়াশোনা ঢাকার কয়েকটি অভিজাত স্কুলে। অভিজাত বলতে, ষাট ও সত্তরের দশকে ঢাকার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সন্তানদের যেসব স্কুলে পড়াতে চাইতেন—সেসব স্কুলই। প্রথমে বিএএফ শাহীন স্কুল, সেন্ট জোসেফ স্কুল ও রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ। রেসিডেন্সিয়াল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। সেখান থেকেই ১৯৮৮ সালে তিনি অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রি।
জিয়ার মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তিনিই ছিলেন স্বামীর রাজনৈতিক উত্তরসূরি। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি বিএনপিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতায়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তাকেও রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ করেছিল।
মায়ের ছায়াতলেই রাজনীতিতে প্রবেশ বড় ছেলে তারেক রহমানের। আশির দশকে বিএনপির কর্মসূচিতে তারেককে দেখা গেছে খালেদা জিয়ার সঙ্গেই। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারেক বিএনপির প্রচারে ছিলেন খালেদা জিয়ার পাশেই। তিনি নিজেও আলাদাভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচারে গেছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছেলে হিসেবে। নব্বই দশকের শুরুতেই বিএনপির বগুড়া জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন তারেক রহমান।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। জিয়াউর রহমান–পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপির প্রথম অধ্যায়ে তারেক রহমান ছিলেন নেপথ্যেই। সেভাবে প্রকাশ্যে দেখা যেত না তাকে। তবে ওই সময় শোনা যায়, তিনি ব্যবসায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ব্যবসা–বাণিজ্য আর টুকটাক জনসংযোগ—এভাবেই ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল কেটেছে তারেকের।
তারেক রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় হন মূলত বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থাকার সময়ই। ১৯৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে চলে যায় নির্বাচনে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও। বিরোধী দল বিএনপিকে সাংগঠনিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করার কাজ করতে থাকেন তারেক। ২০০১ সালের নির্বাচনে তারেক ছিলেন বিএনপির নির্বাচনী প্রচারের পেছনের মস্তিষ্ক। তার পরিকল্পনাতেই প্রথমবারের মতো স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিএনপি নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে চমকে দেয় সবাইকে। ২০০১ সালের নির্বাচনে ১৯৩ আসনে জিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট দুই–তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা আসে। তারেক হয়ে যান বিএনপির নতুন প্রজন্মের মুখ। তিনি যে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরসূরি হতে যাচ্ছেন, দেশের মানুষ বুঝে যায় তখনই।

২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলে তারেক ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। ২০০২ সালে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি তাকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়। এর পর থেকে বিএনপির রাজনীতিতে তারেক হয়ে যান ক্ষমতাধর। তবে এর সঙ্গে তাকে নিয়ে সমালোচনারও জন্ম হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের বাইরে তারেক নিজস্ব একটি রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসতেন। যেটি একপর্যায়ে হয়ে ওঠে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র।
তারেক রহমান সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হয়ে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার ব্যাপক উদ্যোগ নেন। তিনি দেশব্যাপী তৃণমূল নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে শুরু করেন গণসংযোগ। বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ব্যাপক হারে। এসব মতবিনিময়, আলোচনা ও সভার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা বাড়ে, নিজের নেতৃত্বও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এসব কর্মসূচিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলের ইমেজের বাইরে নিজেকে বের করে এনে বিএনপির একজন সক্রিয় নেতার ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ওই সময়টায় দক্ষ সংগঠক হিসেবেও নিজেকে সামনে নিয়ে আসেন।
এত কিছুর পরও সমালোচনা তারেক রহমানের পিছু ছাড়েনি। বিরোধী পক্ষ আওয়ামী লীগ সব সময়ই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনেছে। তারেক বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হলেও সেই পদ তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি প্রধানের ছেলে হিসেবেই পেয়েছিলেন বলে সমালোচনামূখর ছিলেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সমালোচনাটা ছিল, বিএনপির সাধারণ একজন নেতা হিসেবে সাংগঠনিক দক্ষতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে তো আর তারেক এই পদ পাননি। এর পাশাপাশি বিএনপির অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দকে এড়িয়ে চলা, কিংবা তাদের অবজ্ঞা করার একটা অভিযোগ ছিল তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। তিনি বিএনপিতে তরুণ নেতাকর্মীদের নিয়ে নিজস্ব প্রভাব–বলয় তৈরি করেছেন বলেও বিতর্ক ছিল। তবে এসব অভিযোগ বা সমালোচনার পক্ষে দৃশ্যমান কোনো প্রমাণ স্বাভাবিকভাবেই কখনো সামনে আনা যায়নি।
তবে তারেকের দিক দিয়ে নিজেকে বিএনপির রাজনীতিতে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টার কোনো অভাব ছিল না। তিনি দলের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। সারা দেশ সফর করেছেন। গ্রামে–গঞ্জে হেঁটেছেন। সাধারণ নেতা–কর্মীদের চাওয়া–পাওয়ার খোঁজ খবর নিয়েছেন। তাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু যত দিন গেছে বিএনপিতে তারেকের অবস্থান মজবুতই হয়েছে। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়ার পর তারেকই হয়ে ওঠেন বিএনপির কাল্ট। বিএনপির রাজনীতির মুখ।
তবে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের একটি জনসভায় সে সময়ের বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। অল্পের জন্য হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই ঘটনায় নিহত হন ২৩ জন আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী। আহত হন অগণিত। এই হামলায় তারেক রহমান জড়িত বলে সরাসরি অভিযোগ আনা হয় আওয়ামী লীগের দিক থেকে। বিএনপি সরকারের কিছু পদক্ষেপে সে সময় সাধারণ মানুষের মধ্যেও একই ধরনের ধারণার জন্ম হয়। বিএনপি সেই সময় আওয়ামী লীগের সেই অভিযোগের বিপরীতে শক্ত কোনো বক্তব্য হাজির করতে পারেনি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তারেকের রাজনৈতিক জীবনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় ঠিকমতো প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই।
২০০৬ সালে বিএনপির শাসনক্ষমতার কাল শেষ হয়। তবে দেশে তৈরি হয় রাজনৈতিক অচলাবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিএনপি নিয়ে সেই সংকট এতটাই ভয়াবহ রূপ নেয় যে, দেশে সেনা হস্তক্ষেপ হয় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। দেশে আসে একটি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিএনপির ওপর নেমে আসে খড়্গ। একই সঙ্গে তারেক রহমানের ওপর। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় একের পর এক দুর্নীতি মামলা। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেককে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ছিল ১৩টি।

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তারেক রহমানের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। সেই সময় তারেক রহমানকে প্রায়ই প্রিজন ভ্যানের বদলে অ্যাম্বুলেন্সে করে আদালতে আনা হতো। তাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে এজলাসে তোলা হতো। তার চেহারায় থাকত নির্যাতিত হওয়ার অভিব্যক্তি। এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন জিয়া–খালেদার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। ২০০৭–এর মার্চ থেকে ২০০৮–এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কারাবন্দী ছিলেন তারেক রহমান। তাকে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। যদিও রাজনৈতিক মহলে প্রচারণা ছিল তারেক লন্ডনে নির্বাসিত জীবন বেছে নিয়েছিলেন, তিনি আর কখনো রাজনীতি করবেন না—এমন মুচলেকা দিয়ে।
২০০৮ থেকে তারেকের নির্বাসিত জীবনের শুরু। এ সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসেছে অনেক চড়াই–উৎরাই। ২০০৮–এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। সেই আওয়ামী লীগ এরপর নানা কৌশলে একপেশে ও কারচুপির নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকেছে পরের ১৫ বছর। পুরো সময়টাই ছিল বিএনপির বড় দুঃসময়। তারেক রহমান দেশে নেই। খালেদা জিয়াকেও মামলায় মামলায় জর্জরিত করা হয়। ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ স্ট্রাস্টের এক মামলায় কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। প্রায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে বিএনপি। তারেক যদিও ভার্চুয়ালি লন্ডন থেকেই দলের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। কিন্তু দেশে সশরীরে থাকা আর বিদেশ থেকে দল পরিচালনার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। যদিও এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তারেক কিন্তু দলের হাল ধরে রেখেছিলেন দৃঢ়তার সঙ্গেই। আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিকে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বিএনপির নেতাকর্মীরা তারেক রহমানকে বেশি করেই দলীয় কার্যক্রমে অনুভব করেছে।
নির্বাসিত জীবনের শুরুর দিকেই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন তারেক। ২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিলে তাকে এই পদ দেওয়া হয়। তিনি ভার্চুয়ালি কাউন্সিলে যোগ দেন এবং বক্তৃতা রাখেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাবন্দী থাকা অবস্থায় নিজের ওপর নির্যাতনের আবেগময় বর্ণনা দিয়েছিলেন সেই বক্তৃতায়।

খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে কারাবন্দী হওয়ার পর তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বা নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে তারেকই হয়ে ওঠেন বিএনপির মূল নেতা। আওয়ামী লীগের সময় বিএনপির নেতাকর্মীরা যখন হামলা–মামলায় জর্জরিত, নির্যাতনের শিকার, তখন লন্ডনে বসেও তারেক খোঁজখবর নিতেন নেতাকর্মীদের। তিনিই ছিলেন তাদের আশা–ভরসার জায়গা।
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের। দীর্ঘ নির্বাসনের পর তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথ তৈরি হয়। কিন্তু তিনি তখন ফেরেননি। যদিও প্রত্যাশা ছিল তিনি দ্রুত ফিরবেন। বিএনপিকে নেতৃত্ব দেবেন মাঠে থেকে। তবে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তবে এর পেছনে যে নানা হিসাব–নিকাশ থাকতে পারে, সে ব্যাপারে ধারণা ছিল সাধারণ মানুষের। সবশেষ খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার মধ্যে তার ফেরার ব্যাপারটি আলোচিত হলেও তারেক নিজেই বলেছেন, মায়ের অসুস্থ অবস্থায় পাশে থাকতে চাইলেও দেশে ফেরার ব্যাপারটি পুরোপুরি তার হাতে নেই। এই স্বীকারোক্তি মানুষের জন্য কিছুটা ধাক্কা হয়ে এলেও তাতে তারা অবাক হয়নি।
অবশেষে তারেক রহমান ফিরছেন। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে তিনি বিএনপির রাজনীতিকে কোন উচ্চতায় নিতে পারেন, সেটিই দেখার অপেক্ষায় সবাই।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই ক্রমশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এ অবস্থায় খোদ নির্বাচন নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন আশা করছেন, ভোটের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা কেটে যাবে।