নাইর ইকবাল

ভাঙা-গড়ার খেলায় জাতীয় পার্টিকে টেক্কা দেবে–এমন সাধ্য কার? বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দলের বিভক্তি, ভাঙা-গড়া রীতিমতো মুখরোচক এক বিষয়।
সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলটি গঠিত হয়েছিল বিভিন্ন মত ও পথের রাজনীতিকদের এক মঞ্চে জড়ো করে। নেতারা ছিলেন এরশাদের ‘হ্যান্ডপিক’। তারার হাট যাকে বলে, সেটিই ছিল জাতীয় পার্টি। প্রতিষ্ঠার পর বছর চারেকের ‘ক্ষমতাসীন দল’ হিসেবে সাংগঠনিক শক্তিও একেবারে কম ছিল না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘তৃতীয় শক্তি’ কিংবা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমান্তরাল শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার সব উপকরণ থাকার পরও ক্ষমতার বাইরে এসে এই দল বড় দুই দলের ক্ষমতার রাজনীতির ‘মেকানিজম টুল’ ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনি। গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবেও কুখ্যাতি পেয়েছে দলটি।
আগেই বলা হয়েছে, বিভিন্ন মত ও পথের রাজনীতিকদের নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ এই দল গড়েছিলেন। মূলত এই দলে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য দলে অপাংক্তেয় হয়ে পড়া রাজনীতিবিদেরা। একইসঙ্গে বৈষয়িক প্রাপ্তির আশাতেও কিছু রাজনীতিক জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদের পতনের পর এই দলের আসল চরিত্র বেরিয়ে পড়ে। শীর্ষ নেতৃত্বের (এরশাদ) দুর্বলতা ও সদা পরিবর্তনশীল নীতি ও ভাবনার কারণে এই দল কখনোই এককাট্টা হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। বিভিন্ন দল ও মতের রাজনীতিকেরা জাতীয় পার্টিকে সব সময়ই ব্যবহার করেছেন নিজেদের স্বার্থে। কেউ আওয়ামী লীগের পক্ষে বাতাস দিয়েছেন, কেউ বিএনপির পক্ষে। এমন করতে করতেই জাতীয় পার্টি ভাগ হয়েছে বিভিন্ন সময়। কোনো আদর্শিক কারণে নয়, এই ভাগাভাগি সব সময়ই হয়েছে নানা ধরনের স্বার্থান্বেষী বিষয়কে কেন্দ্র করে।

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের কয়েক মাসের মধ্যে হঠাৎ করে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন দেখা দেয়। এরশাদ তখন জেলবন্দী। আর দল ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকার পতনের পর এরশাদের মতোই অনেক নেতা জেলে, অনেকেই পলাতক। সেই সময় জাতীয় পার্টিকে ‘ব্র্যাকেটবন্দী’ করেছিলেন, ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরী ও এরশাদ সরকারের এক সময়ের উপপ্রধানমন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতা ডা. আবদুল মতিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, সরকার পতনের পর এরশাদের জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এমনটা ভেবেই হুদা-মতিন দল ভাগ করেছিলেন। তবে সেই বিভক্তি বেশি দিন টেকেনি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ৩৫ আসন পাওয়ার পর ব্র্যাকেটবন্দী অংশ নিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি দুই প্রবীণ রাজনীতিবিদ। দুজনেই ফিরে এসেছিলেন মূল দলে।

এরশাদ পতনের পর জাতীয় পার্টির ওপর খড়্গহস্ত ছিল বিএনপি সরকার। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির রাজনীতি অনেকের মধ্যেই আশার সঞ্চার করেছিল। দলটি রাজপথে সক্রিয় ছিল, সংসদেও ৩৫ আসন নিয়ে রেখেছিল শক্তিশালী ভূমিকা। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচনে কেউ কেউ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সম্ভাবনা দেখেছিলেন ভালোই। সরকার থেকে নামার পর ছয় বছরের মাথায় এসে দলটির সাংগঠনিক ভিত্তিও ছিল যথেষ্ট মজবুত। কিন্তু নির্বাচনের আগে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে একটি বিশাল জনসভার মঞ্চে প্রকাশ্যে দুই শীর্ষ নেতা কাজী জাফর আহমেদ আর নাজিউর রহমান মঞ্জুর হাতাহাতি দলটির নেতৃত্বে বিভক্তি মানুষের সামনে প্রকাশ্য করে দেয়। তবুও সেই নির্বাচনে ৩২ আসন নিয়ে পরবর্তী সরকার গঠনে ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেছিল এরশাদের দল।
সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬, আর বিএনপি ১১৬ আসন পেয়েছিল। জাতীয় পার্টির ৩২ আসন হয়ে যায় মহা গুরুত্বপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সেবার জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। ওই সময় জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির দরকষাকষি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে। আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে জাতীয় পার্টি ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে’ যোগ দিয়েছিল। দলের মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু হয়েছিলেন সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী।

জাতীয় পার্টির বিভক্তির ইতিহাসের শুরুটা আসলে ১৯৯৬ সাল থেকেই। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মন্ত্রিত্ব দলটাকে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দিয়েছিল। তার মন্ত্রিত্বের কারণে দলটি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা কীভাবে পালন করবে, তা নিয়ে দলীয় কোন্দল চরমে পৌঁছেছিল। কোন্দল মেটাতেই এরশাদ মঞ্জুকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলে মনোযোগী হতে বললে প্রথমবারের মতো পার্টিতে বড় ধরনের বিভক্তি দেখা দেয়। মিজানুর রহমান চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আর শেখ শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির ‘আওয়ামী লীগ ঘরানা’ গঠন করে জাতীয় পার্টি (মিজান-মঞ্জু), যেটি পরবর্তীকালে জাতীয় পার্টি (জেপি) হিসেবে পরিচিতি পায়। এ অংশ বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্ষমতার ভাগ পেয়েছে।
সেই ভাঙনের পর জাতীয় পার্টির ফাটল আরও জোরদার হয়ে ১৯৯৮ সালে। জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে দুই মেরুতে অবস্থান করতেন সাবেক মহাসচিব শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন আর এরশাদ সরকারের শেষ প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। এরশাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে এ দুজন জাতীয় পার্টি তৃতীয়বারের মতো ভাগ করে গঠন করেন জাতীয় পার্টি (জাফর-মোয়াজ্জেম)। এই ভাগ নিয়ে হুদা, মতিনের মতোই সুবিধা করতে পারেননি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও কাজী জাফর আহমেদ। দুজনেই ফিরেছিলেন এরশাদের মূল জাতীয় পার্টিতে।

১৯৯৯ সালে এরশাদ তার জাতীয় পার্টি নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে। ভোটভিত্তিক এই জোটের মূল লক্ষ্যই ছিল আওয়ামী লীগ-বিরোধী ভোটকে এক বাক্সে আনা। বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের এই জোট নিয়ে প্রমাদ গুণেছিল তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা ত্যাগের পর এরশাদ ৬ বছর জেল খেটেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ছিল বহু মামলা। খালেদা জিয়ার সঙ্গ এরশাদ যেন ছেড়ে দেন, সে জন্য তাকে মামলার ভয় দেখানো শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ। একটি মামলা সচল করে এরশাদকে জেল পর্যন্ত খাটানো হয় আবার। জামিনে মুক্ত হয়ে এরশাদ চারদলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। যদিও নেতার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি নাজিউর রহমান মঞ্জু ও ডা. আবদুল মতিনসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। দল আবারও বিভক্ত হয়।

এই জাতীয় পার্টি অবশ্য নাম বদলে রাখে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বা বিজেপি। এই বিজেপি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত চারদলীয় জোটের অংশীদার হিসেবে ক্ষমতার ভাগ কিছুটা পেয়েছিল। ওই বিজেপিকেই বাবা নাজিউরের মৃত্যুর পর নেতৃত্ব দিচ্ছেন আন্দালিভ রহমান পার্থ।
এখানে আরও একটি বিভক্তির কথা বলে রাখা ভালো। ২০০৩ সালে হঠৎ করেই ডা. আবদুল মতিন নিজের নামে একটা জাতীয় পার্টি খুলেছিলেন। অথচ, তিনি তখন চারদলীয় জোটের সংসদ সদস্য।
ক্ষমতার অংশীদারত্ব কীভাবে পাওয়া যায়, এরপর থেকে সেটিই হয়ে ওঠে জাতীয় পার্টির মূল রাজনীতি। এ জন্য এরশাদের দুর্বলতাও বড় ব্যাপার। জিয়াউর রহমানও ক্ষমতায় বসে বিএনপি গড়েছিলেন। কিন্তু জিয়ার যোগ্য ও কঠোর নেতৃত্ব বিএনপির জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার পথ সুগম করেছিল। তার মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার রাজপথের রাজনীতি বিএনপিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। কিন্তু জাতীয় পার্টি সেই নেতৃত্ব পায়নি।

পতনের পর এরশাদকে মামলা দিয়ে কাবু করে ফেলা হয়। পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীনেরা এরশাদের বিরুদ্ধে সেই মামলা ব্যবহার করেছে খুব কৌশলে। আর এই মামলার আতঙ্কেই এরশাদ নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন সদা পরিবর্তনশীল। নেতার বিভ্রান্ত আচরণের কারণেই জাতীয় পার্টি স্বার্থ ছাড়া গঠনমূলক রাজনীতি থেকে ছিল অনেক দূরে।
তবুও এই দলের ভোট ব্যাংক তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে যদিও এই ভোট ব্যাংক হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু। ২০০৬ সালে ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোটই মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ দুই ভাগের জন্যই। ২০০৬ সালে এরশাদকে নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের টানাহেঁচড়া রাজনৈতিক কৌতুকের কারণ হয়েছিল। এরশাদের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ কয়েকজন সংসদ সদস্য নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনের পথে ছিলেন। তবে জাতীয় পার্টির মূল অংশ ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দিয়েছিল। ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে ২৮টি আসনসহ ক্ষমতার অংশীদারও হয়েছিল তারা। মন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়া এরশাদের ছোটভাই জি এম কাদের। এরশাদ নিজে হয়েছিলেন সিনিয়র মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিশেষ দূত’।

এর পরের ১৫ বছর জাতীয় পার্টির ইতিহাস ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ আবারও নিজের পছন্দের রাজনীতি করার চেষ্টা করেছিলেন, একতরফা নির্বাচনের প্রতিবাদ জানিয়ে ভোট বর্জন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের চাপে এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার ‘রহস্যজনক বন্দিত্বের’ কারণে, সেই সিদ্ধান্ত ধরে রাখতে পারেননি এরশাদ। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২১টি আসন ভাগে পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অবস্থান হয়েছে আরও দুর্বল। ওই সময় কাজী জাফর আহমেদ আর মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করেছিল আওয়ামী লীগ-বিরোধী আরেকটি জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যদিও সেই নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। সংসদে প্রধান বিরোধী দল হলেও তাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেই সরকারের বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যু জাতীয় পার্টির অস্তিত্বকে খাদের কীনারায় দাঁড় করিয়ে দেয়। যদিও ২০২৪ পর্যন্ত ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে জাতীয় পার্টি প্রসাঙ্গিক ছিল রাজনীতির আলোচনায়। ২০২৪ সালের আরেকটি একতরফা নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়েও জাতীয় পার্টির নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। নির্বাচনে ১১টি আসন দেওয়া হয় তাদের। ১৯৯৬ সাল থেকে ধরলে ২০২৪ সালে এসে মেকানিজম পার্টনার হিসেবে জাতীয় পার্টির গুরুত্বও কমে দাঁড়ায় তলানিতে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পতন, আওয়ামী লীগের পতন জাতীয় পার্টির অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে তাদেরও নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। হালুয়া-রুটির ভাগাভাগি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব আবারও সংকটে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে আর সহ্য করতে পারেননি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হক চুন্নুদের মতো নেতারা। দলকে নতুন করে না ভাঙলেও না করলেও নানা মেরুকরণ চলছে দলটির মধ্যে।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদরা জি এম কাদেরকে ত্যাগ করার পরই গত জুলাই মাসে এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতীয় পার্টিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার তাগাদা এসেছিল। এবার সে অনুযায়ী জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন (যেটিকে মূল জাতীয় পার্টি বলা যায়) অংশকে বাদ দিয়ে বাকিরা এক হচ্ছেন। আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, এমনকি জাতীয় পার্টির বাকি অংশগুলোও।
রাজনীতিতে ‘মাইনাস ফর্মূলা’র কথা শোনা যায়। জাতীয় পার্টির নেতারা নিজেরাই কি এখন মূল দলকে মাইনাস করে দিতে চাইছেন–এ প্রশ্ন উঠছেই। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আর আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি জোটও হচ্ছে। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নামের এই জোটের অংশীদার ১৮টি রাজনৈতিক দল। রাজনীতি সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠছেই–এই ১৮টি রাজনৈতিক দল কারা?
২০০১ সালে চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে এরশাদ নিজেই জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে একটি নির্বাচনী জোট করেছিলেন। ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের সেই জোটের অংশীদার ছিল দেশের কয়েকটি ইসলামি দল। চারদলীয় জোটের ভোট কাটার সেই জোট খুব সফল না হলেও তারা পেয়েছিল ১৪টি আসন (সব সংসদ সদস্য ছিলেন জাতীয় পার্টিরই)। এবার মঞ্জু-আনিসুল ইসলামদের জোটের উদ্দেশ্য কী, সেটা বোঝা যাবে সময়ের সঙ্গেই।

ভাঙা-গড়ার খেলায় জাতীয় পার্টিকে টেক্কা দেবে–এমন সাধ্য কার? বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দলের বিভক্তি, ভাঙা-গড়া রীতিমতো মুখরোচক এক বিষয়।
সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলটি গঠিত হয়েছিল বিভিন্ন মত ও পথের রাজনীতিকদের এক মঞ্চে জড়ো করে। নেতারা ছিলেন এরশাদের ‘হ্যান্ডপিক’। তারার হাট যাকে বলে, সেটিই ছিল জাতীয় পার্টি। প্রতিষ্ঠার পর বছর চারেকের ‘ক্ষমতাসীন দল’ হিসেবে সাংগঠনিক শক্তিও একেবারে কম ছিল না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘তৃতীয় শক্তি’ কিংবা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমান্তরাল শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার সব উপকরণ থাকার পরও ক্ষমতার বাইরে এসে এই দল বড় দুই দলের ক্ষমতার রাজনীতির ‘মেকানিজম টুল’ ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনি। গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবেও কুখ্যাতি পেয়েছে দলটি।
আগেই বলা হয়েছে, বিভিন্ন মত ও পথের রাজনীতিকদের নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ এই দল গড়েছিলেন। মূলত এই দলে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য দলে অপাংক্তেয় হয়ে পড়া রাজনীতিবিদেরা। একইসঙ্গে বৈষয়িক প্রাপ্তির আশাতেও কিছু রাজনীতিক জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদের পতনের পর এই দলের আসল চরিত্র বেরিয়ে পড়ে। শীর্ষ নেতৃত্বের (এরশাদ) দুর্বলতা ও সদা পরিবর্তনশীল নীতি ও ভাবনার কারণে এই দল কখনোই এককাট্টা হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। বিভিন্ন দল ও মতের রাজনীতিকেরা জাতীয় পার্টিকে সব সময়ই ব্যবহার করেছেন নিজেদের স্বার্থে। কেউ আওয়ামী লীগের পক্ষে বাতাস দিয়েছেন, কেউ বিএনপির পক্ষে। এমন করতে করতেই জাতীয় পার্টি ভাগ হয়েছে বিভিন্ন সময়। কোনো আদর্শিক কারণে নয়, এই ভাগাভাগি সব সময়ই হয়েছে নানা ধরনের স্বার্থান্বেষী বিষয়কে কেন্দ্র করে।

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের কয়েক মাসের মধ্যে হঠাৎ করে জাতীয় পার্টিতে ভাঙন দেখা দেয়। এরশাদ তখন জেলবন্দী। আর দল ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকার পতনের পর এরশাদের মতোই অনেক নেতা জেলে, অনেকেই পলাতক। সেই সময় জাতীয় পার্টিকে ‘ব্র্যাকেটবন্দী’ করেছিলেন, ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরী ও এরশাদ সরকারের এক সময়ের উপপ্রধানমন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতা ডা. আবদুল মতিন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, সরকার পতনের পর এরশাদের জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ অন্ধকার, এমনটা ভেবেই হুদা-মতিন দল ভাগ করেছিলেন। তবে সেই বিভক্তি বেশি দিন টেকেনি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ৩৫ আসন পাওয়ার পর ব্র্যাকেটবন্দী অংশ নিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি দুই প্রবীণ রাজনীতিবিদ। দুজনেই ফিরে এসেছিলেন মূল দলে।

এরশাদ পতনের পর জাতীয় পার্টির ওপর খড়্গহস্ত ছিল বিএনপি সরকার। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির রাজনীতি অনেকের মধ্যেই আশার সঞ্চার করেছিল। দলটি রাজপথে সক্রিয় ছিল, সংসদেও ৩৫ আসন নিয়ে রেখেছিল শক্তিশালী ভূমিকা। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জাতীয় পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচনে কেউ কেউ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে সম্ভাবনা দেখেছিলেন ভালোই। সরকার থেকে নামার পর ছয় বছরের মাথায় এসে দলটির সাংগঠনিক ভিত্তিও ছিল যথেষ্ট মজবুত। কিন্তু নির্বাচনের আগে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে একটি বিশাল জনসভার মঞ্চে প্রকাশ্যে দুই শীর্ষ নেতা কাজী জাফর আহমেদ আর নাজিউর রহমান মঞ্জুর হাতাহাতি দলটির নেতৃত্বে বিভক্তি মানুষের সামনে প্রকাশ্য করে দেয়। তবুও সেই নির্বাচনে ৩২ আসন নিয়ে পরবর্তী সরকার গঠনে ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেছিল এরশাদের দল।
সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬, আর বিএনপি ১১৬ আসন পেয়েছিল। জাতীয় পার্টির ৩২ আসন হয়ে যায় মহা গুরুত্বপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সেবার জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। ওই সময় জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির দরকষাকষি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে। আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে জাতীয় পার্টি ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে’ যোগ দিয়েছিল। দলের মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু হয়েছিলেন সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী।

জাতীয় পার্টির বিভক্তির ইতিহাসের শুরুটা আসলে ১৯৯৬ সাল থেকেই। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মন্ত্রিত্ব দলটাকে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দিয়েছিল। তার মন্ত্রিত্বের কারণে দলটি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা কীভাবে পালন করবে, তা নিয়ে দলীয় কোন্দল চরমে পৌঁছেছিল। কোন্দল মেটাতেই এরশাদ মঞ্জুকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলে মনোযোগী হতে বললে প্রথমবারের মতো পার্টিতে বড় ধরনের বিভক্তি দেখা দেয়। মিজানুর রহমান চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আর শেখ শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির ‘আওয়ামী লীগ ঘরানা’ গঠন করে জাতীয় পার্টি (মিজান-মঞ্জু), যেটি পরবর্তীকালে জাতীয় পার্টি (জেপি) হিসেবে পরিচিতি পায়। এ অংশ বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্ষমতার ভাগ পেয়েছে।
সেই ভাঙনের পর জাতীয় পার্টির ফাটল আরও জোরদার হয়ে ১৯৯৮ সালে। জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে দুই মেরুতে অবস্থান করতেন সাবেক মহাসচিব শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন আর এরশাদ সরকারের শেষ প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। এরশাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে এ দুজন জাতীয় পার্টি তৃতীয়বারের মতো ভাগ করে গঠন করেন জাতীয় পার্টি (জাফর-মোয়াজ্জেম)। এই ভাগ নিয়ে হুদা, মতিনের মতোই সুবিধা করতে পারেননি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও কাজী জাফর আহমেদ। দুজনেই ফিরেছিলেন এরশাদের মূল জাতীয় পার্টিতে।

১৯৯৯ সালে এরশাদ তার জাতীয় পার্টি নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে। ভোটভিত্তিক এই জোটের মূল লক্ষ্যই ছিল আওয়ামী লীগ-বিরোধী ভোটকে এক বাক্সে আনা। বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের এই জোট নিয়ে প্রমাদ গুণেছিল তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা ত্যাগের পর এরশাদ ৬ বছর জেল খেটেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ছিল বহু মামলা। খালেদা জিয়ার সঙ্গ এরশাদ যেন ছেড়ে দেন, সে জন্য তাকে মামলার ভয় দেখানো শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ। একটি মামলা সচল করে এরশাদকে জেল পর্যন্ত খাটানো হয় আবার। জামিনে মুক্ত হয়ে এরশাদ চারদলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। যদিও নেতার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি নাজিউর রহমান মঞ্জু ও ডা. আবদুল মতিনসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। দল আবারও বিভক্ত হয়।

এই জাতীয় পার্টি অবশ্য নাম বদলে রাখে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বা বিজেপি। এই বিজেপি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত চারদলীয় জোটের অংশীদার হিসেবে ক্ষমতার ভাগ কিছুটা পেয়েছিল। ওই বিজেপিকেই বাবা নাজিউরের মৃত্যুর পর নেতৃত্ব দিচ্ছেন আন্দালিভ রহমান পার্থ।
এখানে আরও একটি বিভক্তির কথা বলে রাখা ভালো। ২০০৩ সালে হঠৎ করেই ডা. আবদুল মতিন নিজের নামে একটা জাতীয় পার্টি খুলেছিলেন। অথচ, তিনি তখন চারদলীয় জোটের সংসদ সদস্য।
ক্ষমতার অংশীদারত্ব কীভাবে পাওয়া যায়, এরপর থেকে সেটিই হয়ে ওঠে জাতীয় পার্টির মূল রাজনীতি। এ জন্য এরশাদের দুর্বলতাও বড় ব্যাপার। জিয়াউর রহমানও ক্ষমতায় বসে বিএনপি গড়েছিলেন। কিন্তু জিয়ার যোগ্য ও কঠোর নেতৃত্ব বিএনপির জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার পথ সুগম করেছিল। তার মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার রাজপথের রাজনীতি বিএনপিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। কিন্তু জাতীয় পার্টি সেই নেতৃত্ব পায়নি।

পতনের পর এরশাদকে মামলা দিয়ে কাবু করে ফেলা হয়। পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীনেরা এরশাদের বিরুদ্ধে সেই মামলা ব্যবহার করেছে খুব কৌশলে। আর এই মামলার আতঙ্কেই এরশাদ নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন সদা পরিবর্তনশীল। নেতার বিভ্রান্ত আচরণের কারণেই জাতীয় পার্টি স্বার্থ ছাড়া গঠনমূলক রাজনীতি থেকে ছিল অনেক দূরে।
তবুও এই দলের ভোট ব্যাংক তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে যদিও এই ভোট ব্যাংক হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু। ২০০৬ সালে ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোটই মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ দুই ভাগের জন্যই। ২০০৬ সালে এরশাদকে নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের টানাহেঁচড়া রাজনৈতিক কৌতুকের কারণ হয়েছিল। এরশাদের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদ কয়েকজন সংসদ সদস্য নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনের পথে ছিলেন। তবে জাতীয় পার্টির মূল অংশ ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দিয়েছিল। ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে ২৮টি আসনসহ ক্ষমতার অংশীদারও হয়েছিল তারা। মন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়া এরশাদের ছোটভাই জি এম কাদের। এরশাদ নিজে হয়েছিলেন সিনিয়র মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিশেষ দূত’।

এর পরের ১৫ বছর জাতীয় পার্টির ইতিহাস ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ আবারও নিজের পছন্দের রাজনীতি করার চেষ্টা করেছিলেন, একতরফা নির্বাচনের প্রতিবাদ জানিয়ে ভোট বর্জন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের চাপে এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার ‘রহস্যজনক বন্দিত্বের’ কারণে, সেই সিদ্ধান্ত ধরে রাখতে পারেননি এরশাদ। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২১টি আসন ভাগে পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অবস্থান হয়েছে আরও দুর্বল। ওই সময় কাজী জাফর আহমেদ আর মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করেছিল আওয়ামী লীগ-বিরোধী আরেকটি জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যদিও সেই নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। সংসদে প্রধান বিরোধী দল হলেও তাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেই সরকারের বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যু জাতীয় পার্টির অস্তিত্বকে খাদের কীনারায় দাঁড় করিয়ে দেয়। যদিও ২০২৪ পর্যন্ত ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে জাতীয় পার্টি প্রসাঙ্গিক ছিল রাজনীতির আলোচনায়। ২০২৪ সালের আরেকটি একতরফা নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়েও জাতীয় পার্টির নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। নির্বাচনে ১১টি আসন দেওয়া হয় তাদের। ১৯৯৬ সাল থেকে ধরলে ২০২৪ সালে এসে মেকানিজম পার্টনার হিসেবে জাতীয় পার্টির গুরুত্বও কমে দাঁড়ায় তলানিতে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পতন, আওয়ামী লীগের পতন জাতীয় পার্টির অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে তাদেরও নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। হালুয়া-রুটির ভাগাভাগি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব আবারও সংকটে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে আর সহ্য করতে পারেননি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মুজিবুল হক চুন্নুদের মতো নেতারা। দলকে নতুন করে না ভাঙলেও না করলেও নানা মেরুকরণ চলছে দলটির মধ্যে।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদরা জি এম কাদেরকে ত্যাগ করার পরই গত জুলাই মাসে এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতীয় পার্টিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করার তাগাদা এসেছিল। এবার সে অনুযায়ী জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন (যেটিকে মূল জাতীয় পার্টি বলা যায়) অংশকে বাদ দিয়ে বাকিরা এক হচ্ছেন। আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, এমনকি জাতীয় পার্টির বাকি অংশগুলোও।
রাজনীতিতে ‘মাইনাস ফর্মূলা’র কথা শোনা যায়। জাতীয় পার্টির নেতারা নিজেরাই কি এখন মূল দলকে মাইনাস করে দিতে চাইছেন–এ প্রশ্ন উঠছেই। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আর আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি জোটও হচ্ছে। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নামের এই জোটের অংশীদার ১৮টি রাজনৈতিক দল। রাজনীতি সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠছেই–এই ১৮টি রাজনৈতিক দল কারা?
২০০১ সালে চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে এরশাদ নিজেই জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে একটি নির্বাচনী জোট করেছিলেন। ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের সেই জোটের অংশীদার ছিল দেশের কয়েকটি ইসলামি দল। চারদলীয় জোটের ভোট কাটার সেই জোট খুব সফল না হলেও তারা পেয়েছিল ১৪টি আসন (সব সংসদ সদস্য ছিলেন জাতীয় পার্টিরই)। এবার মঞ্জু-আনিসুল ইসলামদের জোটের উদ্দেশ্য কী, সেটা বোঝা যাবে সময়ের সঙ্গেই।