মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুনের নেপথ্যে কী?

সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
সামদানী হক নাজুম, ঢাকা
মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুনের নেপথ্যে কী?
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এই বাড়ির আটতলার একটি ফ্ল্যাটে খুন হন লায়লা আফরোজ ও তার মেয়ে নাফিসা বিনতে আজিজ। ছবি: চরচা

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে গতকাল সোমবার সকালে হত্যার শিকার হন লায়লা আফরোজ ও তার মেয়ে নাফিসা বিনতে আজিজ। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জোড়া হত্যার খুনি প্রশিক্ষিত। নিজের আঙুলের ছাপ মুছতে গ্লাভসও পরেছিলেন তিনি। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে গোসলও করেন তিনি।

নিহত লায়লা আফরোজের বয়স ৪৮ বছর। মেয়ে নাফিসা বিনতে আজিজের বয়স ১৫ বছর। নাফিসা মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল, আর মা লায়লা আফরোজ ছিলেন গৃহিণী।

নাফিসার বাবা এ জেড আজিজুল ইসলাম উত্তরার সানবিমস স্কুলের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে ওই বাসায় প্রায় ১৩ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। তাদের গ্রামের বাড়ি নাটোরে।

স্ত্রী ও সন্তান হত্যার ওই ঘটনায় মোহম্মদপুর থানায় মামলা করেছেন আ জ ম আজিজুল ইসলাম। মামলায় একমাত্র আসামি কথিত গৃহকর্মী আয়েশা। তবে আয়েশাকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মাত্র চার দিন আগে কাজ নেওয়া ওই গৃহকর্মীর নাম আদৌ আয়েশা কি না তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ঠিকানা কিংবা পরিচয় সম্পর্কেও মেলেনি কোনো ধারণা।

তাই প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আপাতদৃষ্টিতে এই জোড়া হত্যার কারণ হিসেবে পরিকল্পিত ডাকাতিকেই মোটিভ হিসেবে দেখছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এমনকি ওই গৃহকর্মীর নাম আয়েশা নয়, ডাকাতির উদ্দেশ্যে ছদ্মনাম নিয়েই তিনি সে বাসায় কাজ নিয়েছিলেন বলেই ধারনা পুলিশের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার মতে, হত্যাকারী প্রশিক্ষিত এবং পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তিনি চরচাকে বলেন, “অনেকগুলো কারণে আমাদের মনে হচ্ছে ডাকাতির উদ্দেশ্যেই ওই মেয়ে এই বাসায় কাজ নিয়েছিল, এমনও হতে পারে এটাই তার পেশা, তার সঙ্গে সংঘবদ্ধ কোনো অপরাধী গ্রুপেরও যোগাযোগ থাকতে পারে।”

এমন ধারণার কারণ সম্পর্কে ওই কর্মকর্তা বলেন, “প্রথমত, সে কারও পরিচিত নয়, র‌্যান্ডমলি কাজ খুঁজতে এসে ওই বাসায় কাজ নেয়। তার কাজ নেওয়ার চার দিনের মাথায় এমন হত্যার ঘটনা ঘটল। দ্বিতীয়ত, সিসিটিভি ফুটেজে আমরা দেখলাম সে বোরখা পরে ঢোকে। আর বাচ্চার স্কুলড্রেস পরে পালিয়ে গেছে। তৃতীয়ত, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি ছুরি, যার একটি সুইচ গিয়ার এটি সম্ভবত সঙ্গে এনেছিল, অপরটি বাসায় ফল কাটার জন্য ব্যবহার হয়। আরও ইন্টারেস্টিং হল নিজের ফিঙ্গার প্রিন্ট না রাখতে গ্লাভস পড়েছিল। হত্যার পর সে শাওয়ার নিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে পরিচয় আড়াল করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পুরো বিষয়টাই ঠান্ডা মাথার কিলারের সিগনেচার বহন করে।”

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “পাশাপাশি আমরা কিছু মিসিং ক্লেইম পেয়েছি। যেমন একটা মোবাইল, একটা ল্যাপটপ মিসিং আছে, কিছু স্বর্ণালংকারও সম্ভবত মিসিং আছে। যদিও একদম সুনির্দিষ্টভাবে কী কী অলংকার মিসিং হয়েছে তা পরিবারের পক্ষ থেকে বলতে পারেনি। তবে হত্যার পর ঘরের সবকিছু যেভাবে ঘাঁটাঘাটি করা হয়েছে এবং মেয়েটা একটা স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তাই ধারণা করাই যায় শুধু মোবাইল-ল্যাপটপ নয় আরও কিছু সে নিয়েছে। পুরো ঘটনার টাইম ফ্রেম দেখলে এটি প্রাথমিকভাবে সুপরিকল্পিত ডাকাতির ঘটনা।”

তবে ডাকাতির বাইরেও অন্য কোন মোটিভ থাকলে তা জানা যাবে কথিত গৃহকর্মী আয়েশার গ্রেপ্তারের পরই। তাই আগে তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছে একাধিক পুলিশ, ডিবি এবং র‍্যাব তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে গৃহকর্মী আয়েশাকে গ্রেপ্তারে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন একজন র‍্যাব কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা চরচাকে বলেন, “মেয়েটি তার সঠিক নাম বলেনি এটা ধরে নিতেই হয়। তাছাড়া তাকে সরাসরি সনাক্ত করা যায় এমন এভিডেন্সও হাতের কাছে নেই। তাই আমরা প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তাকে ধরার কাজ চালাচ্ছি।”

এদিকে ঘটনার পর সন্দেহভাজন হিসেবে ভবনের নিরাপত্তার প্রহরীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। তবে এ হত্যাকাণ্ডে তার কোনো সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

মোহম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মেজবাহ উদ্দিন চরচাকে বলেন, “এই হত্যার সঙ্গে নিরাপত্তা কর্মীর কোনো সম্পৃক্ততা আমরা পাইনি। ওই গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে, তার কাছ থেকেই মূল কারণ জানা যাবে।”

হত্যাকাণ্ডের পর বাসা থেকে কী কী খোয়া গেছে জানতে চাইলে মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “একটা মোবাইল আর একটা ল্যাপটপের কথা বাদী জানিয়েছেন, আরও কিছু মিসিং আছে কি না তা যাচাই করা হচ্ছে।”

সম্পর্কিত